কামরুজ্জামান পলাশ : ১লা মে বিশ্ব শ্রমিক দিবস। এই দিবসটি সারা বিশ্বব্যাপি যথাযথ পালিত হয়। এই দিনটিকে শ্রমিকের অধিকার রক্ষা ও আদায় করার দিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। শ্রমিক হল, আমাদের দৈনন্দিন কাজে যারা আমাদের অর্থের বিনিময়ে সাহায্য করেন কিংবা আমাদের দৈনিন্দিন কাজকে সঠিক ভাবে পরিচালনা করার লক্ষ্যে বা আমাদের প্রয়োজন মেটনোর জন্য জন্য যারা অর্থের বিনিময়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। উদাহরণ স্বরূপ দেখুন, আপনার-আমার ঈদে পরিধান করার জন্য শখের জামাটি তৈরিতে দেশের কোন না কোন প্রান্তে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন কোন শ্রমিক ভাই- বোন।
ইসলামেও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আমরা যাদের আদর্শ হিসেবে মানি সে সকল নবীগণও কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মহা পবিত্র আল-কোরান এ মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে আর কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করো না, পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার করো, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, দরিদ্র, নিকট প্রতিবেশী, দূরের প্রতিবেশী, ভ্রমনের সহযাত্রী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাসদাসীর সাথে সদয় আচরণ করো। নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক, গর্বিত ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। (সুরা নিসা: ৩৬)।
তাছাড়া আমদের প্রিয় নবী রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করো তার ঘাম শুকানোর আগেই’ (বায়হাকি, মিশকাত)।
এইবার দেখা যাক এই শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে আমাদের দেশের প্রচিলিত আইনে কোন বিশেষ সুবিধা বা বিধান আছে কিনা? শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করণে আমাদের দেশে ২০০৬ সালে ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬’ প্রণীত হয়। যা ২০০৬ সালের ৪২ নং আইন।
বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর পঞ্চম অধ্যায় অর্থাৎ ধারা (৫১-৬০) এ শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষার বিধানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠান পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করণ ,প্রর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ,বর্জ্য পদার্থ অপসারণ, পর্যাপ্ত আলোর ব্যাবস্থা ও পায়খানা ও প্রস্রাব খানা ব্যবস্থা নিশ্চিত করনের বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর ষষ্ঠ অধ্যায় অর্থাৎ ধারা (৬১-৭৮) এ শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের কথা আলোচনা করা হয়েছে। অবাঞ্ছিত ঘটনা হতে তৈরি কোন দূর্ঘটনাজনিত কারনে যাতে কোন শ্রমিকের প্রানহানি না ঘটে এতে তার কিছু সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা গ্রহনের তাগিত প্রদান করা হয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর অষ্টম অধ্যায় অর্থাৎ ধারা (৮৯-৯৯) এ শ্রমিকের কল্যাণমূলক ব্যবস্থার কথা আলোকপাত করা হয়েছে। যাতে,কর্মপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা,প্রর্যাপ্ত আলাদা গোসল খানা, ক্যান্টিন, বিশ্রাম কক্ষ ও শিশু কক্ষ রাখার পাশাপাশি চা-বাগান শ্রমিকদের জন্য বিনোদন,শিক্ষা ও গৃহায়ন এর উপর জোর দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর নবম অধ্যায় অর্থাৎ ধারা (১০০-১১৯) এ দৈনিক কর্মঘন্টা ও বিশ্রাম, সাপ্তাহিক কর্মঘন্টা ও সাপ্তাহিক ছুটি বা ক্ষতিপূরণ মূলক ছুটি, মহিলা শ্রমিকের জন্য কর্মঘন্টা ও সড়ক পরিবহনে নিয়োজিত শ্রমিকের জন্য বয়সের সীমা নির্ধারন সহ উৎসব ছটির বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর দ্বাদশ অধ্যায় অর্থাৎ ধারা (১৫০-১৭৪) একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। কেননা এতে শ্রমিকের দূর্ঘটনাজনিত কারনে জখমের জন্য ক্ষতিপূরনের কথা বলা হয়েছে। এতে ক্ষতিপূরণের জন্য মালিকের দায়িত্ব, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ, ক্ষতিপূরণ বন্টন এমনকি মারাত্মক দূর্ঘটনার সম্পর্কে মালিকের নিকট হতে বিবৃতি তলবের ক্ষমতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া ও বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এ শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করণে অনেক বিধান রয়েছে। একটি সুন্দর ও সাম্য সমাজ গঠনে আমাদের সকলের উচিত শ্রমিককে তাঁর পাপ্য বুঝিয়ে দেয়া। কেননা তাদের শ্রম ও ঘামের বিনিময়েই গড়ে উঠছে আকাশচুম্বী ইমারত সহ অনেক স্থাপনা। দিন শেষে আমরা সবাই মানুষ।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,
গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান
লেখক: শিক্ষানবিস আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।