সৈয়দ রিয়াজ মোহাম্মদ বায়েজিদ : একজন হত্যাকারী, ধর্ষণকারী বা এসিড নিক্ষেপকারী আসামীর পক্ষে একজন আইনজীবী কথা বলবে কেন? কেন এমন ঘৃণিত অপরাধীর পক্ষে একজন আইনজীবী দাঁড়াবে? কেন আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে এমন অপরাধীদের পক্ষে কথা বলার জন্য আইনী অধিকার প্রদান করা হবে? প্রায়শই দেশের সাধারণ মানুষ এমন প্রশ্নগুলো করে থাকে।
দেশে উল্লেখযোগ্য কিছু মামলা রয়েছে যেমন- “নুসরাত হত্যা মামলা”, “আবরার হত্যা মামলা”, কক্সবাজারের “সিনহা হত্যা মামলা” এবং চট্টগ্রামের “মিতু হত্যা মামলা”। একটি “হত্যা মামলার” খুনের আসামীপক্ষে একজন আইনজীবী দাড়াঁনোর বা আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া এটি আসামীর আইনগত অধিকার।
যদি আসামী নিজে আইনজীবী নিয়োগ দিতে অপারগ হয় তবে সেক্ষেত্রে আদালত নিজেই আসামীপক্ষে একজন আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারেন। এটাই “রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী” বা ‘স্টেট ডিফেন্স’। এই অধিকারটি আসামীর সাংবিধানিক অধিকারও বটে।
সাধারণ মানুষের ভাষ্য মতে হত্যা বা ঘৃণিত অপরাধের মামলায় আসামীপক্ষে আইনজীবী দাড়াঁনো উচিত নয়। সাধারণ মানুষের আইন বা সাংবিধানিক আইন সম্পর্কে না জানা বা আবেগাপ্লুত হওয়ার কারণেইতারা এই ধরণের কথা বলে থাকে। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩(১)- এ বলা হয়েছে
“গ্রেফতারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথা সম্ভব শীঘ্রই গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবেনা এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবেনা।”
সরকার আদি বা আপীল আদালতে অভিযোগকারীর সমর্থনে অধিকার হিসেবে আইন উপদেষ্টা কর্তৃক বক্তব্য শুনতে অধিকারী, তেমনি অভিযুক্ত তার আইনজীবীর মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারী। তাকে প্রয়োজনীয় সুযোগ দেওয়ার দায়িত্ব আদালতের (AIR 1951SC. 441)। ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ৩৪০ ধারামতে কোন ব্যক্তি জন্য আত্মপক্ষ সমর্থন করা না হলে মারাত্মক ক্ষেত্রে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বিচারের ব্যবস্থা করবে। যেক্ষেত্রে কয়েদীকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সরকারী ব্যয়ে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়, সেক্ষেত্রে সাক্ষীকে জেরা করতে অভিজ্ঞ আইনজীবীকে নিযুক্ত করতে হবে।
এই ধারানুযায়ী অভিযুক্ত যাতে হেফাজতে থাকাকালে তার আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করতে ও আত্মপক্ষ সমর্থনে তৈরী হতে পারে তার জন্য যুক্তি সঙ্গত সুযোগ তাকে দিতে হবে (AIR 1935 Lah. 230)।
আইনের বিধান এই যে, অভিযুক্ত পলাতক থাকুক বা না থাকুক আদালত কর্তৃক নিয়োজিত আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থন করার অধিকার তার আছে এবং বিচার শুরু করার পূর্বে আইনজীবী নিয়োগ করার বিষয়টি বিচারিক আদালতের দ্বারা নিশ্চিত হতে হবে, অন্যথায় প্রদত্ত দন্ড কলুষিতহবে [50 DLR 10]।
[52 DLR 370 (HCD)] এ মামলায় অভিযুক্তকে হেফাজতে রাখা হয়েছিল এবং সময়ে সময়ে আদালতে তাকে হাজির করা হলেও নিজের পছন্দমত কোন আইনজীবী দ্বারা তার পক্ষ অবলম্বন করা হয়নি। এই অপরাধটি মৃত্যুদন্ডযোগ্য হওয়ায় তার পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী নিয়োগ করার দায়িত্ব আদালতের ছিল। যার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে তার পক্ষে যদি কোন আইনজীবী না দাড়াঁয় বা তার পক্ষে কথা বলার জন্য কোন আইনজীবী না থাকে বা আসামী যদি ‘আত্মপক্ষ সমর্থনের’ সুযোগ না পায় তবে আদালত কর্তৃক ঐ বিচার কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আইনের এই বিধান রাখার মূল কারণ হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মামলার অভিযোগকারী ও আসামী উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনা প্রয়োজন।
একটি বিখ্যাত আইনের প্রবাদ রয়েছে- “Let thousands of guilties go unpunished, but not a single innocent be punished”।এছাড়া, যতক্ষণ পর্যন্ত একজন অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণিত হবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত অভিযুক্তকে অপরাধী হিসাবে গণ্য করা যাবে না।” এমনকি একটি ল্যাটিন ম্যাক্সিম রয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, “AudiAlteramPartem” কোন ব্যক্তিকে শুনানী সুযোগ প্রদান না করে বা তার পক্ষে কোন বক্তব্য না শুনে তাকে শাস্তি প্রদান করা যাবেনা।”
১৯৬০ সালের এল.আর ম্যানুয়ালের ১২ অধ্যায়ের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রত্যেক হত্যা মামলার সব আসামীর মামলার ট্রায়ালের সময়ে আইনজীবী নিয়োগ দিতে সাহায্য করা হবে। এছাড়া, বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে রয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। মামলার অভিযোগকারী তার বক্তব্য প্রদান করার আইনগত অধিকার যেমন রয়েছে আসামীরও তার পক্ষে বক্তব্য প্রদান করার সমান অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সত্য উৎঘাটনে মামলার উভয়পক্ষের বক্তব্য শ্রবণ করা বা সুযোগ প্রদান করা অত্যাবশ্যক। অন্যথায়, সংবিধান পরিপন্থি ও একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিচার হওয়ার সুযোগ থেকে যায়।
লেখক : অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।