অবসরে যাচ্ছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নূরুজ্জামান। দীর্ঘ ১৪ বছরের বিচারিক জীবনের ইতি টানতে যাচ্ছেন তিনি।
আগামী ৩০ জুন বিচারপতি নূরুজ্জামানের বয়স ৬৭ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে এদিন তাঁর শেষ কর্মদিবস। তবে সে সময় অবকাশকালীন ছুটি থাকায় এবং পবিত্র হজ পালনের জন্য ছুটি নেওয়ায় আজই বিচারক হিসেবে তাঁর শেষ কর্ম দিবস।
জন্ম ও পরিচয় ও শিক্ষা
নূরুজ্জামান কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন থানাধীন চারিগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৫৬ সালের ১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন।
মো. বজলুর রহমান এবং আমেনা বেগম দম্পত্তির সন্তান নূরুজ্জামান ১৯৭২ সালে ন্যামতপুর স্কুল থেকে এস.এস.সি পাস করেন। ১৯৭৫ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচ.এস.সি এবং একই কলেজ থেকে ১৯৭৮ সালে বি.এ পাস করেন।
পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এস.এস এবং আইন বিষয়ে এল এল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ১৯৮৩ সালে জেলা আদালতে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। এরপর ১৯৮৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।
তিনি ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন।
একই বছরের ৩০ জুন হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে উন্নীত হন এবং ২০১১ সালের ৬ জুন একই বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর আপিল বিভাগের বিচারক হন।
সর্বোচ্চ আদালতের জ্যেষ্ঠতম বিচারক হিসেবে একাধিকবার কার্যভাররত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও আপিল বিভাগের চেম্বার জাজ, জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের সদস্য এবং বার কাউন্সিলের এনরোলমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন।
একইসঙ্গে তিনি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে এবং জুডিসিয়াল সার্ভিস পে কমিশনের সদস্য হিসেবেও নিযুক্ত হন। দায়িত্ব প্লাওন করেছেন সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকী উদযাপন সংক্রান্ত স্মারক গ্রন্থ, স্মরণিকা বিষয়ক জাজেজ উপ-কমিটির ও সম্পাদনা পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক মুজিববর্ষ স্মারক প্রকাশনা ‘বঙ্গবন্ধু ও বিচার বিভাগ’ এবং ‘ন্যায়কণ্ঠ’ নামক মুজিববর্ষ স্মরণিকা প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
নজির সৃষ্টিকারী রায়সমূহ
১. চুক্তি প্রবলের মামলাকে স্বত্ত্ব ঘোষণা ও দলিল বাতিলের মামলায় রূপান্তর করা যাবে না। [31 BLT (AD)(2023)180]
২. ঋণ আদায় ও সুদ মওকুফ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তা রিট পিটিশনের মাধ্যমে নিষ্পত্তির বিষয় নয়। [11 LM (AD) (2021)70]
৩. বকেয়া পরিশোধের জন্য সময় ও শুনানির সুযোগ দেওয়ার পরই কেবল ক্লাবের পরিচালনা পর্ষদ ক্লাবের সদস্যকে প্রদত্ত স্বাধিকার রদ করার ক্ষমতা রাখে। ক্লাবের সচিবের মতো কর্মচারী তা করতে পারে না। [10 LM (AD)(2021)155]
৪. খাস জমি প্রকৃত কৃষককে চাষের উদ্দেশ্য ছাড়া বন্দোবস্ত দেওয়া উচিৎ নয়। [10 LM (AD) (2021) 168]
৫. যদি কোন সাক্ষী কোন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বয়ান দেন তখন অপরপক্ষ যদি তা অস্বীকার না করেন, তবে আইনানুযায়ী তা স্বীকৃত বলে গণ্য হবে। [10 LM (AD) (2021) 397
৬. মামলার মেরিটের উপর উভয় পক্ষের শুনানির পর রায়ের জন্য ধার্য্য তারিখে মামলাটি তদবিরের অভাবে খারিজ করা যাবে না। [8 LM (AD) (2020) 74
৭. আন্তঃমন্ত্রণালয় যোগাযোগ হচ্ছে সরকারের কোন বিষয়ের ক্ষেত্রে নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। এগুলো অধগ্রহণকৃত অব্যবহৃত জমি কারো বরাবরে ফেরত দেওয়ার আইনগত অধিকারের জন্ম দেয়না। [2020] 20 ALR (AD) 18
৮. জবানবন্দির ভিত্তিতে অপর সহ-আসামিদের দোষীসাব্যস্ত করা যায় না, যদি না অত্যন্ত শক্ত পারিপার্শ্বিক এবং অনুসমর্থনীয় সাক্ষ্য দ্বারা সেই দোষ স্বীকারোক্তি প্রমাণিত হয়। [2019] (2) 16 ALR (AD) 19
৯. বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের MPO-ভুক্তির নির্দেশ দেওয়ার বিষয়টি রিট এর এখতিয়ার বহির্ভূত। 2019] (2) 16 ALR (AD) 118
১০. মামলার তদন্ত বা বিচারিক কার্যক্রম বিলম্বে সম্পন্ন হবে মর্মে যদি প্রতীয়মান হয় তাহলে পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় আসামিকে জামিন দেয়া যায়। 6 ALR [2015] (2) 157
১১. কোন মামলায় কোন পক্ষ যখন সালিসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ না নিয়ে স্বেচ্ছায় লিখিত জবাব দাখিল করেন, তখন তিনি সালিস আইনের ৭ ধারার অধিকার পরিত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হবে। 27 BLT (2019 (AD) 171
১২. কোম্পানির Articles of Association এ যদি ‘may’ থাকে, তাহলে তাকে ‘shall’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। 29 BLT (2021) (AD) 47
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
তাঁর পিতা মো. বজলুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক ছিলেন। তিনি নিজ ছেলে অর্থাৎ আজকের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামানসহ ১৫ জন যুবককে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভারত গমন করেন। এরমধ্যে ১৩ জন যুবক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। তাঁরা সশ্রস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি যুদ্ধকালীন সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য সংগঠক হিসেবে তাঁর কার্যক্রম পরিচালনা অব্যাহত রাখেন।
নূরুজ্জামান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ সাব ডিভিশনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং এসব অঞ্চল দখল মুক্ত করেন।
সেমিনার ও কর্মশালা
২০১১ সালে হংকং –এ অনুষ্ঠিত দুর্নীতিবিরোধী আইন সেমিনারে এবং ২০২৩ সালে নেপালে বন ও পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া তিনি সৌদি আরব, ভারত, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড সফর করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবন
তিনি মেহেরুন্নেসা (নাসরিন) –এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ।ব্যক্তিজীবনে তিনি চার জন পুত্র সন্তানের জনক। জ্যেষ্ঠ ছেলে মোহাম্মদ কামরুজ্জামান আল-আশরাফী ও তাঁর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন উভয়ই সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত। মেঝো ছেলে ডা. এ.কিউ.এম মনিরুজ্জামান আশরাফী যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব লাভ করে বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন। সেজো ছেলে মাহবুব জামান আশরাফী অস্ট্রেলিয়ার সিডনি টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে দেশে একটি ব্যাংকে কর্মরত আছেন। আর ছোট ছেলে আশরাফ উজ জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে ব্যাংকে চাকরি করছেন।