চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম ও তার মা গুলশান আরা বেগমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত। একই সঙ্গে তাদের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
ন্যাশনাল ফাইন্যান্স লিমিটেডের পক্ষে করা এক আবেদনের শুনানি নিয়ে বুধবার চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মুজাহিদুর রহমান এ আদেশ দেন।
আদালতে ন্যাশনাল ফাইন্যান্স লিমিটেডের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মো: তানভীর-উল আলম এবং দুই আসামির পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মো: রফিকউল আলম।
জানা যায়, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স লিমিটেডের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) ২০১৮ সালে ২৬ কোটি ৪৩ হাজার ৫২০ টাকা পাওনা আদায়ের দাবিতে ঢাকার ২য় অর্থঋণ আদালতে একটি অর্থঋণ মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর-৬৫৩/২০১৮।
মামলায় চট্টগ্রামের মাজিরহাট রোডের হামিদা দোজা লিমিটেয়ের চেয়ারম্যান গুলশান আরা বেগম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমসহ কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
এ মামলার বিচার শেষে ২০১৯ সালের ৮ মে আদালত ব্যাংকের অনুকূলে ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট পর্যন্ত হিসাব মোতাবেক ৩০ কোটি ৩৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৮ টাকা পরিশোধের জন্য ডিক্রি প্রদান করেন। রায় প্রদানের ৬০ দিনের মধ্যে ডিক্রিরকৃত সব টাকা ন্যাশনাল ফাইন্যান্স লিমিটেডকে পরিশোধের নির্দেশ দেন।
পরবর্তীতে টাকা পরিশোধ না করায় ব্যংকটির পক্ষ থেকে ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার অর্থঋণ আদালতে ২৯ কোটি ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার ৫৬০ টাকা আদায়ের জন্য একটি জারি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু তফশিলভূক্ত সম্পত্তি অর্থ ঋণ আদালত চট্টগ্রামের অধীনে হওয়ায় ঢাকার আদালত থেকে মামলাটির পরবর্তী কার্যক্রম শেষ করার জন্য নথি চট্টগ্রামের আদালতে প্রেরণ করা হয়।
বুধবার ন্যাশনাল ফাইন্যান্স লিমিটেডের পক্ষে করা আবেদনে বলা হয়, জারি মামলা দায়েরের পর দায়িকগণ কোন টাকা পরিশোধ করেননি। তাদের বন্ধকী সম্পত্তি নিলামের বিক্রির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোন দরপত্র না পড়ায় তা নিলামে বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। দায়িকগণের ঋণ পরিশোধের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধে এগিয়ে আসছে না। ৩ নম্বর দায়িক (মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম) একজন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। এই আদালতে তার বিরুদ্ধে ৩০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ খেলাপির মামলা চলমান রয়েছে। কোন টাকা পরিশোধ না করে তিনি দেশে-বিদেশে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি না করলে তারা ঋণ পরিশোধে এগিয়ে আসবে না।
তবে মোরশেদ ইব্রাহিম ও তার মায়ের আইনজীবী গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির বিরোধীতা করেন।
আদালত তার আদেশে বলেন, ডিক্রি হওয়ার পর ৪ বছর অতিবাহিত হলেও দায়িকগণ কোন টাকা পরিশোধ করেননি। করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সুদ মওকুফের সুবিধা দিয়ে বিআরপিডি সার্কুলার ১৬ জারি করা হলেও দায়িকগণ কোন ডাউন পেমেন্ট জমা দিয়ে সুদ মওকুফের আবেদনও করেননি। অধিকন্তু নিলাম কার্যক্রম স্থগিতের জন্য বিভিন্ন অপকৌশল প্রয়োগ করেছে। আদালত তাদের বিরুদ্ধে ৫ মাসের দেওয়ানী আটকাদেশ দিয়ে তা কার্যকর করার জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। একই সঙ্গে তাদের দেশ ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি বেসিক ব্যাংকের করা ৩০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মামলায় জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য মেহজাবিন মোরশেদ ও তাঁর স্বামী মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমসহ চার জনের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন একই আদালত।
জানা যায়, শুধু বেসিক ব্যাংক নয়, মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম নামে-বেনামে তার পারিবারিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ৯৯০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। মোর্শেদ মুরাদ ইব্রাহিম ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালক থাকাকালে তিনি উদ্যোক্তা পরিচালকের প্রভাব খাটিয়ে নিজ ব্যাংক থেকে ছয় প্রতিষ্ঠানকে ১৭২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে দেন।
এর মধ্যে রয়েছে মো. মনজুরুল ইসলামের মালিকানাধীন রয়েল ডিপ সি ফিশারিজের কাছে ২৪ কোটি ৩৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা, জাহাজ ভাঙা ব্যবসায়ী দিদারুল ইসলামের শীতল এন্টারপ্রাইজে ৭৭ কোটি ৭৫ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, জাহাজ ভাঙা খাতের খেলাপি ব্যবসায়ী সাহেদ মিয়ার মালিকানাধীন সাহেদ শিপব্রেকিং ৪৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা, হারুন উর রশিদের বেঙ্গল ট্রেডিংয়ে ১২ কোটি ৪৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকা এবং মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের চাচা ও পলাতক খেলাপি ব্যবসায়ী জাহিদ হোসেন মিয়ার জাহিদ এন্টারপ্রাইজে আট কোটি ১০ লাখ ২১ হাজার টাকা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরশেন এর সাবেক প্রশাসক সেকান্দর হোসেন মিয়ার পুত্র মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের বাড়ি চট্টগ্রামের মাঝিরঘাট সড়কের পূর্বমাদারবাড়ি। তার স্ত্রী মাহজাবিন মোর্শেদ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান। এই এলিট দম্পতি রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক অঙ্গনে পরিচিত মুখ। মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন। ঋণ খেলাপি হওয়ায় তিনি এ পদ হারিয়েছেন।