অর্থ পাচারের এক মামলায় বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মাথায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম।
যুক্তরাষ্ট্রে পালানোর সময় গত বুধবার (২১ জুন) মধ্যরাতে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটক করে বলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির ফাইনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান জানান।
তিনি বলেন, “বৃহস্পতিবার সকালে সিআইডির কাছে আবুল কাশেমকে বুঝিয়ে দিয়েছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। এরপর রিমান্ড চেয়ে তাকে আদালতে পাঠানো হলে শুনানির জন্য ২৫ জুন তারিখ রাখেন বিচারক। সেইসঙ্গে আবুল কাশেমকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।”
অর্থ পাচারের মামলায় বুধবার ই-কমার্স কোম্পানি আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর আলম শিকদারসহ যে চারজনের বিদেশযাত্রায় আদালত নিষেধাজ্ঞা দেয় তাদেরই একজন আবুল কাশেম। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি তিনি।
এ মামলার একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালকের পদ পাওয়ার জন্য এবং শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে হাজারো গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া একশ কোটি টাকা মঞ্জুর আলম ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল কাশেমকে দিয়েছিলেন।
দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া বাকি দুজন হলেন, আলেশা মার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মঞ্জুর আলমের স্ত্রী সাদিয়া চৌধুরী এবং আলেশা মার্টকে মোটরসাইকেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এস কে ট্রেডার্সের মালিক মো. আল মামুন। আবুল কাশেম গ্রেপ্তার হলেও অন্যরা পলাতক রয়েছেন।
তদন্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানের এক আবেদনে বুধবার ওই চারজনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারির পাশাপাশি তাদের সম্পত্তি অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দেয় আদালত। কয়েক ঘণ্টা পর রাতেই বিমানবন্দরে আটক হন আবুল কাশেম।
পরিদর্শক মনিরুজ্জামান বলেন, মামলার পর ওই চারজন যেন দেশ ত্যাগ করতে না পারে সেজন্য বিমানবন্দরসহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় তথ্য পাঠানো হয়। আর এ তথ্যের ভিত্তিতেই শাহজালাল আন্তজাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বুধবার মধ্যরাতে আমেরিকা যাওয়ার সময়ে আবুল কাশেমকে ইমিগ্রেশন পুলিশ আটক করে।
প্রতারণার শিকার প্রায় ৩ হাজার গ্রাহকের আবেদনের ভিত্তিতে তদন্তে প্রমাণ মেলায় গত ৩১ মে এই চারজনসহ অজ্ঞাত ১৫-২০ জনের বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা করেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আল মামুন।
তিনি বলেন, এই চারজন ছাড়াও প্রতিষ্ঠান হিসাবে আলেশা মার্ট লিমিটেড, আলেশা হোল্ডিং লিমিটেড, আলেশা কার্ড লিমিটেড, আলেশা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সার্ভিস লিমিটিড, আলেশা টেক লিমিটেড, অলেশা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, আলেশা রাইড লিমিটেড, আলেশা এক্সপোর্ট ইমপোর্ট লিমিটেড, আলেশা ফার্মেসি লিমিটেড, আলেশা অ্যাগ্রো লিমিটেডের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে।
“তারা বিভিন্ন অফার দিয়ে বহু গ্রাহকের কাছ থেকে মোটরসাইকেল ও ইলেক্ট্রনিক বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের জন্য অগ্রিম অর্থ নিয়ে পণ্য বা টাকা ফেরত না দিয়ে ই-কমার্স ব্যবসার আড়ালে প্রতারণার মাধ্যমে মানিলন্ডারিং অপরাধ করছে।”
মামলার অন্য তিন আসামির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, “তাদের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এবং তাদের ঠিকানায় অবস্থান না করায় তাদের পাওয়া যাচ্ছে না।”
এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুজ্জামান বলেন, “তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তারা এরই মধ্যে দেশের বাইরে চলে গেছেন কিনা, এমন কোন তথ্য নেই।”
মামলায় যা বলা হয়েছে
সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আল মামুনের দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে, ‘আলেশা মার্ট লিমিটেড’ ২০২০ সালের ২৬ জুলাই রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিস অ্যান্ড ফার্মস-আরজেএসসি হতে নিবন্ধন লাভ করে। এরপর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন হতে ট্রেড লাইসেন্স পায়। পরের বছর ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হিসাবে আলেশা মার্ট তাদের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে।
ওই কোম্পানি শুরু থেকেই আকর্ষণীয় ডিসকাউন্টে বিভিন্ন অফার দিয়ে মোটরসাইকেল ও ইলেক্ট্রনিক বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের কথা বলে বহু গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য দেয়নি। চলতি বছরের ১ মে পর্যন্ত জাতীয় ভোতা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ২ হাজার ৮৭ জন এবং সিআইডিতে ৩৫ জন গ্রাহক সেই টাকা পেতে আবেদন করেন। ওই অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং অপরাধ সংঘটনের প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়।
মামলায় আরও বলা হয়, আলেশা মার্টের নামে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড, দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড এবং স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক লিমিটেড থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ৪২১ কোটি ৯১ লাখ টাকা ট্রান্সফার ও উত্তোলন করার মাধ্যমে মানিলন্ডারিং অপরাধ করা হয়েছে। মঞ্জুর আলম শিকদার তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৫ অগাস্ট পর্যন্ত ৩১ কোটি ৮০ লাখ ৫৮ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদের মালিক হন। এসব স্থাবর সম্পত্তি ই-কমার্স কোম্পানি হিসেবে আলেশা মার্ট যাত্রা শুরু পর বিভিন্ন সময়ে কেনা হয়েছে।
মঞ্জুর আলম শিকদারের দাখিল করা ২০২০-২০২১ সালের আয়কর নথি পর্যালোচনার কথাও বলা হয়েছে মামলায়। এসব নথির বিষয়ে বলা হয়, “ওই করবর্ষে বেতন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক উৎস হতে তার মোট আয় ছিল ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। মাত্র সাত মাসের (২০২১ সালের ৩১ জানুয়রি-২৫ অগাস্ট) ব্যবধানে ৩১ কোটি ৮০ লাখ ৫৮ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ অর্জন অস্বাভাবিক বলে প্রতীয়মান হয়। মঞ্জুর আলম শিকদার আলেশা মার্টের হাজার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে পাওয়া অর্থ দিয়ে এ সকল স্থাবর সম্পত্তি অর্জন করেছেন মর্মে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়।”
এছাড়া প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালকের পদ পাওয়ার জন্য এবং শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে মঞ্জুর আলম গ্রাহকের কাছে থেকে প্রতারণার মাধ্যমে নেওয়া একশ কোটি টাকা প্রস্তাবিত ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল কাশেমকে দিয়েছেন।
অপর আসামি আল-মামুন সম্পর্কে মামলায় বলা হয়েছে, “আলেশা মার্ট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধকারী মোটরসাইকেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এস কে ট্রেডার্স মালিক আল-মামুন সাধারণ গ্রাহকদের আলেশা মার্টে বিনিয়োগ করতে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় সরব থেকে উৎসাহিত করেন। এছাড়া সাধারণ গ্রাহকদের আস্থা তৈরির জন্য আল মামুন নিজের প্রতিষ্ঠানের চেক প্রদান করে আলেশা মার্টকে মানিলন্ডারিং অপরাধ সংঘটনে সাহায্য করেছেন।”
অভিযোগ পাওয়ার পর সিআইডি বিভিন্ন পর্যায়ে অনুসন্ধান চালানোর কথা মামলায় বলা হয়েছে। তাদের সেই সূত্র ধরে মামলায় বলা হয়েছে, “অনুসন্ধানকালে সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্য, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ থেকে ব্যাংকিং তথ্য, বিভিন্ন সেলার ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জবানবন্দি, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণ নেওয়া হয়।”