দীপজয় বড়ুয়া: প্রতারণা হচ্ছে অসদুপায় অবলম্বন করে কোন কিছু সমাধানের সক্ষমতার কারণে পুরস্কার গ্রহণ করা। সাধারণত প্রতারণা করা হয় আইন অমান্য করে, যাতে প্রতিযোগিতা মূলক পরিস্থিতিতে অসম সুবিধা পাওয়া যায়।
এর বিশদ সংজ্ঞার পরিধিতে ঘুষ, ক্রোনিজম, নেপোটিজম, স্লিইজ এবং অন্য যেকোনো পরিস্থিতি যেখানে অবৈধভাবে অন্যকে সুযোগ দেয়া হয় ইত্যাদি সবকিছুই যুক্ত। এগুলো স্পষ্টত আইনের লঙ্ঘন হতে পারে অথবা এই সব আচরণবিধি গুলো অলিখিতও হতে পারে যার ভিত্তি নৈতিকতা, নীতিশাস্ত্র অথবা প্রথা, যা এর শনাক্তকরণকে বিষয় ভিত্তিক প্রক্রিয়া করে ফেলেছে। প্রতারণা বিশেষভাবে নির্দেশ করতে পারে বৈবাহিক অবিশ্বাসকে।
যে প্রতারণা করে, অর্থাৎ প্রতারককে ব্রিটিশ ইংরেজিতে “cheat” এবং আমেরিকান ইংরেজিতে “cheater” বলা হয়। একজন প্রতারক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তি সব সময় প্রতারণা করে না, বরং নির্ভর করে অন্যায্য কার্যকলাপ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উপর।
বাংলাদেশের দণ্ডবিধি ৪১৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কেহ কোন লোককে ছলনা করে প্রবঞ্চনামূলকভাবে বা অসাধুভাবে সেই লোককে অপর কাউকেও কোন সম্পত্তি প্রদানে প্ররোচিত করে অথবা কোন লোকের কোন সম্পত্তি রেখে দেওয়াতে সম্পত্তি প্রদানে প্ররোচিত করে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনুরূপ প্রতারিত লোককে এমন কোন কার্য করতে বা করা হতে বিরত থাকতে প্ররোচিত করে যে কার্য সেই লোক অনুরূপভাবে প্রতারিত না হলে করত না বা করা হতে বিরত থাকত না এবং যে কার্য করার বা করা হতে বিরত থাকার ফলে তার দেহের, মনের, খ্যাতির বা সম্পত্তির দিক হতে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে, তবে অনুরূপ ছলনাকারী “প্রতারণা” করেছে বলে বিবেচিত হয়। ব্যাখ্যা-অসাধুভাবে তথ্য গোপন করা অত্র ধারার তাৎপর্যাধীনে ছলনা বা প্রতারণা বলে গণ্য হবে।
দন্ডবিধির ৪১৫ ধারায় প্রদত্ত সংজ্ঞার ভাষা হতে অত্র ধারায় দুইটি অংশ পাওয়া যায়– প্রথম অংশে বলা হয়েছে যে, প্রতারিত ব্যক্তি কোন সম্পত্তি অর্পণে অবশ্যই প্রতারণামূলকভাবে বা অসাধুভাবে প্রলুব্ধ হলে এবং দ্বিতীয় অংশে এমন এক ব্যক্তির কথা বলে হয়েছে, যে প্রতারিত লোককে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সম্পত্তি অর্পণে প্রলুব্ধ করবেন। সুতরাং প্রতারণা ঘটিত হতে গেলে অবশ্যই সম্পত্তি অর্পণে প্রবঞ্চণা এবং অসৎভাবে প্রবৃত্ত করণ থাকতে হবে।
উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, রক্তিম সিভিল সার্ভিসে আছে বলিয়া মিথ্যা ভান করিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে সুমিতকে-বঞ্চনা করে এবং তাহাকে ধারে সম্পত্তি দিতে সুমিতকে-অসাধুভাবে প্ররোচিত করে। অথচ এই সম্পত্তির মূল্য প্রদানের ইচ্ছা তাহার নাই। রক্তিম প্রতারণা করিয়াছে।
সুকেশ যেসব দ্রব্য হীরা নহে বলিয়া জানে সেই সব দ্রব্যকে হীরা বলিয়া বর্ণনা দিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে ইরফানকে প্রবঞ্চনা করে এবং এইভাবে অসাধু উপায়ে ইরফানকে টাকা ধার দিতে প্ররোচিত করে। সুকেশ প্রতারণা করিয়াছে।
PLD 1965 (Lah.) 675 মামলা সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“যেই প্রতারণায় ছলনা আছে কিন্তু অন্যায় লাভ করার বা লোকসান ঘটানোর কোন উদ্দেশ্য নাই, তাই সাধারণ প্রতারণা। সাধারণ প্রতারণা ৪১৭ ধারায় শাস্তিযোগ্য”।
46 DLR 180(AD) মামলা সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“প্রতারণার দণ্ডাজ্ঞার সঠিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাথমিক উদ্দেশ্য অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে এবং পারিপার্শিক অবস্থা হতে উদ্দেশ্য সংগ্রহ করতে হবে”।
7 BLD 23 মামলা সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “সম্পত্তি প্রত্যার্পণের অসৎ প্রলুব্ধকরণের সম্পত্তি না হয় তবে প্রতারণার অপরাধ হবে না”।
30 DLR 227 Anowar Ali Vs. The State মামলা সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“সম্পত্তি অর্পণ যদি অসৎ প্রলুব্ধকরণের সম্পত্তি না হয় তবে প্রতারণার অপরাধ হবে না”।
36 DLR 14(AD) মামলা সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“প্রতারণা হতে গেলে অবশ্যই কোন সম্পত্তি অর্পণে প্রলুব্ধকরণ থাকতে হবে। পারিপার্শিক অবস্থা হতে প্রতারণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে”।
46 DLR(1994)(AD) 180 Arifur Rahman@ Bablu Vs. Shantosh Kumar Sadhu মামলা সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“The mitial intention to deceive must be established to justify a conviction for cheating and the intention is to be gathered from the surrounding circumstances”.
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪১৭ ধারাতে প্রতারণার সাজার বিধান করা হয়েছে। এই ধারা মতে, যদি কোন লোক প্রতারণা করে তবে উক্ত লোক এক বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয়বিধ দন্ডে দণ্ডিত হবে। অত্র ধারার অপরাধ আমলযোগ্য নয়, জামিনযোগ্য, আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে মীমাংসাযোগ্য, ১ম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য। কিন্তু সরকারী কর্মচারীর অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য নয়, মীমাংসাযোগ্য নয়, বিশেষ জজ কর্তৃক বিচার্য।
আইনের আশ্রয় কীভাবে নেবেন
যেকোনো কারণে প্রতারণার শিকার হলে কিংবা চাকরির নামে কোনো প্রতারণার শিকার হলে আইনের আশ্রয় খুব সহজেই নিতে পারেন। আপনি দায়ী ব্যক্তি বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করতে পারেন। প্রতারণার পাশাপাশি বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগও আনা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে দেওয়ানি আদালতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। তবে আইনের আশ্রয় নিতে চাইলে যথেষ্ট প্রমাণাদি থাকা লাগবে। যেমন কোনো লিখিত চুক্তি, কোনো রসিদ—এসব বিষয়। তাই এ দলিলগুলো সংরক্ষণ রাখা জরুরি। বিয়ের নাম করে যদি কেউ প্রতারণামূলকভাবে সংসার করে, এ ক্ষেত্রে আইনের আশ্রয় নেওয়া যাবে।
দেশ–বিদেশে চাকরির নাম করে টাকা দেওয়ার সময় টাকা লেনদেন-সংক্রান্ত চুক্তি ভঙ্গ করলেও প্রতারণার অভিযোগ আনা যাবে।
থানায় এজাহার দায়ের করে মামলা করা যায় অথবা আদালতে সরাসরি মামলা দায়ের করা যায়। এ মামলা দায়ের করতে হয় মুখ্য বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বা মহানগর এলাকা হলে মুখ্য মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। তবে ব্যবসা–সংক্রান্ত লেনদেনে প্রতারণার অভিযোগ অনেক সময় না–ও টিকতে পারে। উচ্চ আদালতের কিছু রায়ে তা বলা হয়েছে।
যা জানা দরকার
আমাদের দেশে চাকরি নিয়ে প্রতারণার ঘটনা অনেক বেশি ঘটতে দেখা যায়। তাই কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির সাক্ষাৎকারের সময় বা পরে চাকরিতে যোগদান করার কথা বললে হুট করেই চাকরিতে যোগ দেওয়া ঠিক হবে না। চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে প্রথমেই জেনে নিন ওই প্রতিষ্ঠানটি আইনগতভাবে স্বীকৃত কি না। প্রতিষ্ঠানটির যথাযথ নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স আছে কি না।
বেতন-ভাতা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানুন, চাকরির ধরন সম্পর্কে জেনে নিন। নিয়োগপত্র গ্রহণের সময় তাতে শর্তাবলি কী আছে, ভালোভাবে দেখে নিন। ব্যক্তিগত লেনদেনের ক্ষেত্রে একটা লিখিত চুক্তি করে রাখুন। যতই কাছের আত্মীয় হোক না কেন, লিখিত চুক্তি করে টাকাপয়সার লেনদেন করা উচিত। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রমাণাদি রাখা জরুরি।
সুতরাং বলা যায় যে, প্রতারণা করা হয় আইন অমান্য করে, যাতে প্রতিযোগিতা মুলক পরিস্থিতিতে অসম সুবিধা পাওয়া যায়। এর বিশদ সংজ্ঞার পরিধিতে ঘুষ, ক্রোনিজম, নেপোটিজম, স্লিইজ এবং অন্য যেকোনো পরিস্থিতি যেখানে অবৈধভাবে অন্যকে সুযোগ দেয়া হয় ইত্যাদি সবকিছুই যুক্ত।
লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।
তথ্যকণিকা: আইন শব্দসমূহ-এডভোকেট মোঃ নাসির উদ্দিন, দণ্ডবিধির ভাষ্য- গাজী মোঃ শামসুর রহমান,উকিপিডিয়া, দণ্ডবিধি- এডভোকেট সৈয়দ হাসান জামিল দণ্ডবিধি- বাসুদেব গাংগুলী, 100 years Criminal Reference on The Penal Code- Advocate Md. Abul kalam Azad, The Penal Code- Advocate Md. Abul kalam Azad.