এম.এ. সাঈদ শুভ: নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে আমলী আদালত কোনটি এই প্রশ্নটি বেশ কিছুদিন থেকেই বিচারাঙ্গনে আলোচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে এই আইনের কিছু প্রয়োগ দৃশ্যমান হওয়ার ফলে এই প্রশ্নটি আরো জোরালো হয়েছে। একারণে এই সংক্রান্ত আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। আসলে এই প্রশ্নের পরিষ্কার ও সুষ্পষ্ট উত্তর নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর বিধানাবলীর মধ্যেই দেয়া আছে।
এই প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর হলো, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতই উক্ত আইনে আমলী আদালত। এবার চলুন আমার উত্তরের স্বপক্ষে এই আইনের বিধানাবলী দেখে নেয়া যাক।
এই আইনে ৯ ধারায় বলা হয়েছে,
এই আইনে ভিন্নরূপ কিছু না থাকিলে, কোন অপরাধের অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, বিচার ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে Code of Criminal Procedure 1898 (Act V of 1898) এর বিধানসমূহ প্রযোজ্য হইবে।
এই আইনের ১০ (১) ধারায় বলা হয়েছে,
এই আইনের অধীন দণ্ডনীয় সকল অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণীয় (Cognizable), অ-আপোষযোগ্য (non-compoundable) ও জামিন অযোগ্য (non-bailable) হইবে।
এই দুটি ধারাতেই পরিষ্কার যে, এই আইনের আমলী আদালত কোনটি। ৯ ধারায় বলা হলো, এই আইনে ভিন্নরূপ কিছু না থাকিলে, কোন অপরাধের অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, বিচার ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে Code of Criminal Procedure 1898 (Act V of 1898) এর বিধানসমূহ প্রযোজ্য হইবে। তাহলে পরিষ্কার বোঝা গেলো এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধের অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, বিচার ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে CrPC এর বিধানাবলী প্রযোয্য হবে। CrPC অনুযায়ী আমলযোগ্য অপরাধ আমলে নিতে পারেন ম্যাজিস্ট্রেট। সুতরাং আমলী আদালত কোনটি সে বিষয়ে ভিন্ন কোনো আদালতের নাম এই আইন বলেনি।
এখন প্রশ্ন আসবে তাহলে ৪ ধারায় কেনো বলা হলো, (১) ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ (Code of Criminal Procedure 1898, Act V of 1898) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, তাহা সত্ত্বেও এই আইনের এখতিয়ারাধীন কোন আদালতের সামনে কোন ব্যক্তি যদি অভিযোগ করে যে, তাহাকে নির্যাতন করা হইয়াছে, তাহা হইলে উক্ত আদালত ঐ ব্যক্তির বিবৃতি লিপিবদ্ধ করে তার চিকিৎসার নির্দেশ দেবেন, মেডিকেল রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দেবেন এবং চিকিৎসা প্রয়োজন হলে চিকিৎসার নির্দেশ দেবেন।
এই আইনের এটা একটা বিশেষত্ব। CrPC এর বিধান অনুযায়ী অন্যান্য আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে এই বিধান নাই একারণে এই আইনে এই বিশেষ বিধান সংযোজন করা হলো। CrPC এর মামলা দায়েরের বিধানের থেকে এই আইনের মামলা দায়েরের এইটুকু ভিন্ন বিধান পরিষ্কার করে বলে দেয়ার জন্যই এই ৪ ধারার অবতারণা।
এরপর আসলো ৫ ধারা। ৫ ধারায় বলা হলো, ধারা ৪ এর উপ-ধারা (১) (ক) অনুযায়ী বিবৃতি লিপিবদ্ধ করিবার পর আদালত অনতিবিলম্বে বিবৃতির একটি কপি সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারের কাছে বা ক্ষেত্রমত, তদূর্ধ্ব কোন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে প্রেরণ করিবেন এবং একটি মামলা দায়েরের নির্দেশ প্রদান করিবেন। তারপর পুলিশ সুপার উক্ত আদেশ প্রাপ্তির পর পরই ঘটনা তদন্ত করিয়া চার্জ বা চার্জবিহীন রিপোর্ট পেশ করিবেন।
তবে শর্ত থাকে যে, সংশ্লিষ্ট সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি মনে করেন যে পুলিশ দ্বারা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত সম্ভব নয় সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি যদি আদালতে আবেদন করেন এবং আদালতে যদি তাহার আবেদনে এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদন যথার্থ সেক্ষেত্রে আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবেন।
এছাড়াও আদালত সংঘটিত অপরাধের সংগে জড়িত ব্যক্তির পদমর্যাদার নিম্নে নহে এমন পদমর্যাদার কোন পুলিশ অফিসারকে মামলার তদন্ত অনুষ্ঠানের নির্দেশ প্রদান করিবেন।
৫ ধারাও একটি বিশেষ ধারা। সাধারণত CrPC এর ১৫৬(৩) ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট এফআইআর করার নির্দেশ দেন ওসিকে। কিন্তু এই আইনে এসপি বা তদুর্দ্ধ কর্মকর্তাকে মামলা দায়েরের নির্দেশ দিতে বলা হলো। এখানে Legislature’s Intention হলো, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ওসির সংশ্লিষ্টতা থাকার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। একারণে এসপি বা তদুর্ধ্ব কাউকে মামলা দায়েরের নির্দেশ দিতে বলা হলো। আবার তদুর্ধ্বও বলা হলো এসপির জড়িত থাকার সম্ভাবনা থেকে। আইনপ্রনেতাগণ বাংলাদেশের বিদ্যমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়েই এই বিধানের অবতারণা করেছেন।
তারপর ৬ ধারায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির বাইরে তৃতীয় ব্যক্তি কর্তৃক অভিযোগের বিষয়ে বলা হয়েছে। এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। CrPC অনুযায়ী তৃতীয়পক্ষের অভিযোগের সুযোগ বিদ্যমান আছে।
এরপর ৭ ধারায় অভিযোগের অপরাপর ধারার অবতারণা করা হলো, এখানে বলা হলো, “৭(১) ধারা ৫ ও ৬ এ বর্ণিত প্রক্রিয়া ছাড়াও কোন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া সত্ত্বে তৃতীয় কোন ব্যক্তি দায়রা জজ আদালতে অথবা পুলিশ সুপারের নিচে নয় এমন কোন পুলিশ কর্মকর্তার নিকট নির্যাতনের অভিযোগ দাখিল করিতে পারিবে।”
(২) উপ-ধারা (১) এ বর্ণিত এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ সুপার অথবা তাহার চেয়ে ঊধ্বর্তন পদমর্যাদার কোনো অফিসার তাৎক্ষণিক একটি মামলা দায়ের ও অভিযোগকারীর বক্তব্য রেকর্ড করিবেন এবং মামলার নম্বরসহ এই অভিযোগের ব্যাপারে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইতে পারে উহা অভিযোগকারীকে অবহিত করিবেন।
(৩) উপরে বর্ণিত উপ-ধারা (২) মোতাবেক অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকারী পুলিশ সুপার অথবা তাহার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ দায়েরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দায়রা জজ আদালতে একটি রিপোর্ট পেশ করিবেন।
এই ধারার মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বাইরে আরো দুটি ফোরাম যোগ করা হলো, সেটি হলো একটি দায়রা জজ আদালত, আরেকটি পুলিশ সুপার।
অনেকের মতে দায়রা জজ আদালতই এই আইনের আমলী আদালত। তাহলে আমার প্রশ্ন হলো, এই আইনে ৭ ধারাকে অভিযোগের অপরাপর ধরণ হিসেবে কেনো বলা হলো? প্রকৃতপক্ষে দায়রা আদালত এই আইনের আমলী আদালত নয়। দায়রা জজ আদালতে তৃতীয় পক্ষ অভিযোগ করতে পারবেন। অভিযোগ পেয়ে দায়রা জজ আদালত পুলিশ সুপার বা তদুর্ধ্ব কর্মকর্তাকে মামলা দায়েরের নির্দেশ দেবেন। এসপি বা তদুর্ধ্ব কর্মকর্তা দায়রা জজ আদালতকে মামলা দায়েরের বিষয়ে অবগত করবেন। এই ক্ষেত্রে মামলা দায়ের হলে সেই মামলাও ম্যাজিস্ট্রেট আমলে নিয়ে বিচারের জন্য দায়রা জজ আদালতে পাঠাবেন। এটা এই ধারাতেই পরিষ্কার।
তাহলে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এখানে কি প্যারালাল ফোরাম রাখা হয়েছে? এক্ষেত্রে অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে প্যারালাল ফোরাম রাখা হয়েছে। কিন্তু অপরাধ আমলে নেয়ার ফোরাম একটিই এবং সেটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। প্রকৃতপক্ষে আইনপ্রণেতাগণ বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই অভিযোগের এই ফোরাম ক্রিয়েট করেছেন।
আইনপ্রণেতাগণ হয়তো উপলব্ধি করেছেন, এসপি বা তদুর্ধ্ব কোনো কর্মকর্তা এই অপরাধে জড়িত থাকলে যাতে দায়রা জজ আদালতে তৃতীয় পক্ষ অভিযোগ করতে পারেন সেই সুযোগ রাখা হয়েছে। মূলত ম্যাজিস্ট্রেটের অবস্থান, বিদ্যমান প্রেক্ষাপট সবকিছুই বিবেচনায় নেয়া হয়েছে হয়তো।
এখন আরেকটা প্রশ্ন, তৃতীয় পক্ষ কি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগ করতে পারবেন। এই প্রশ্নের উত্তরও হ্যাঁ। এবং এটাই এই আইনের স্পিরিট।
দায়রা জজ আদালতের ক্ষেত্রে এই আইনের বিশেষত্ব হলো, এই আইনের অধীন অপরাধের বিচার কেবলমাত্র দায়র জজ আদালতে অনুষ্ঠিত হবে।
এই আইনের ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, “এই আইনের অধীন কোন অপরাধের বিচার কেবলমাত্র দায়রা জজ আদালতে অনুষ্ঠিত হইবে।”
খেয়াল করে দেখুন, এই আইনে এমন কি কোনো বিধান আছে যেখানে বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন কোন অপরাধের আমলে গ্রহণ করবেন কেবলমাত্র দায়রা জজ। না, এমন কোনো বিধান এই আইনে নাই।
এই আইনের আরেকটি বিশেষ বিধান ১১ ধারায় আছে। ১১ ধারায় নিরাপত্তা বিধানের কথা বলা আছে।
এই আইন অনুযায়ী এই নিরাপত্তা বিধানের আদেশ দেয়ার এখতিয়ার শুধুমাত্র দায়রা জজ আদালতের। চলুন ধারাটা দেখে নেয়া যাক; ” ১১(১) অভিযোগকারী কোনো ব্যক্তি এই আইনে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বিধানকল্পে দায়রা জজ আদালতে পিটিশন দায়ের করিতে পারিবে।
(২) রাষ্ট্র এবং যাহার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা চাওয়া হইয়াছে তাহাদেরকে উক্ত পিটিশনের পক্ষভুক্ত করা যাইবে।
(৩) পিটিশন গ্রহণ করিয়া আদালত বিবাদীকে সাত দিনের নোটিশ জারি করিবে এবং ১৪ দিনের মধ্যেই পিটিশনের ওপর একটি আদেশ প্রদান করিবে।
(৪) উপরে উল্লিখিত উপ-ধারা (১) এ বর্ণিত এ ধরনের কোনো মামলা নিষ্পত্তিকালে আদালত প্রয়োজনবোধে ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন সাত দিনের অন্তরীণ আদেশ দিতে পারিবে এবং সময়ে সময়ে উহা বৃদ্ধি করিতে পারিবে।
(৫) আদালত এই আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধের তদন্ত কর্মকর্তাদের আদালতের আদেশ পালন নিশ্চিত করিবার নির্দেশ দিতে পারিবে।
(৬) আদালত নিরাপত্তা প্রার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিতে পারিবে এবং প্রয়োজনবোধে আদালত স্থানান্তর এবং বিবাদীর নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করাসহ নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।
এখানেও আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্য একদম পরিষ্কার। এই ৭, ১১ ও ১৪ ধারা কেবলমাত্র দায়রা জজ আদালতের এখতিয়ার। এই আইনে যদি আমলী আদালত দায়রা জজ হতেন তাহলে অবশ্যই সেটির পরিষ্কার ধারা সংযুক্ত থাকতো।
এই আইনের আরেকটা শক্তিশালী ধারা আছে। সেটি হলো, ১২ ধারা। এই ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীনে কৃত কোন অপরাধ যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধের হুমকি, আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অথবা জরুরি অবস্থায়; অথবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা সরকারি কর্তৃপক্ষের আদেশে করা হইয়াছে এইরূপ অজুহাত অগ্রহণযোগ্য হইবে।
অর্থাৎ কোনো অযুহাতেই কোনো ব্যক্তিকে হেফাজতে নির্যাতন করা যাবেনা। এটাই এই আইনের পরিষ্কার উদ্দেশ্য।
এখন আরেকটি প্রশ্ন, এই আইনের অধীন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক সরাসরি আমলে নিতে মাননীয় আপীল বিভাগ একটি রায়ে উল্লেখ করেছেন (৬৯ ডিএলআর এডি, ৬৩)। তাহলে এই রায়ে কি মূল আইনকে উপেক্ষা করা হয়েছে। উত্তর হলো, না। কারণ এই আইনের ৯ ধারাতেই বলা হয়েছে , “এই আইনে ভিন্নরূপ কিছু না থাকিলে, কোন অপরাধের অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, বিচার ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে Code of Criminal Procedure 1898 (Act V of 1898) এর বিধানসমূহ প্রযোজ্য হইবে।”
কারণ CrPC এর ধারা ১৯০(১)(সি) অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট যেকোনো অপরাধ আমলে নিতে ম্যাজিস্ট্রেট এখতিয়ারবান। সুতরাং আপীল বিভাগ উক্ত রায়ে নতুন কোনো বিষয়ের অবতারণা করেননি। মাননীয় আপীল বিভাগ শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ার ও দায়িত্ব জোড়ালোভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
আশাকরি, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর সবগুলো বিধান খুব সতর্কতার সাথে পাঠ করলে এই আইন অনুযায়ী অপরাধের অভিযোগ দায়ের, আমলে গ্রহণ, বিচার ও অন্যান্য বিশেষ বিধানাবলী সম্পর্কে কোনো অস্পষ্টতা থাকবেনা।
লেখক: এম.এ. সাঈদ শুভ; সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, নাটোর। ই-মেইল: sayeed.judge@gmail.com