লাইলাতুল ফেরদৌস: পূর্বের বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশের সঙ্গে নতুন আইনের বড় কোন মৌলিক পরিবর্তন না করেই বাংলাদেশ সরকার আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ বাতিল করে একটি নতুন আয়কর আইন, ২০২৩ প্রণয়ন করেছে। জাতীয় সংসদ নতুন আইনটি পাস করেছে যা ২২ জুন, ২০২৩ তারিখে গেজেট আকারে প্রকাশ পায়। বাংলা ভাষায় প্রণীত এই আইন ১ জুলাই, ২০২৩ থেকে কার্যকর হয়েছে।
একটি পূর্ণাঙ্গ আয়কর আইনের অনুপস্থিতি অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ উপলব্ধি করতে পেরেছে। কেননা, ১৯২২ সালের ভারতীয় ইনকাম ট্যাক্স অনুযায়ী বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে আয়কর আরোপ, আদায়, সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা করা হতো। সেটিকেই পরে ১৯৮৪ সালে সংস্কারের মাধ্যমে ইনকাম ট্যাক্স অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করা হয়, যা এতদিন পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় চালু ছিল। কেননা তখন সামরিক আইন জারি ছিল, পার্লামেন্ট ছিল না। সেই থেকে একটি সময়োপযোগী ও বাংলা ভাষায় সহজবোধ্য আইন প্রণয়ন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
নতুন আইনের সূচনা
সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ (২০১১ সনের ১৪ নং আইন) দ্বারা ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ হইতে ১৯৮৬ সনের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সামরিক ফরমান দ্বারা জারীকৃত অধ্যাদেশসমূহের অনুমোদন ও সমর্থন সংক্রান্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৯ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত হয় এবং সিভিল আপিল নং ৪৮/২০১১ তে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত রায়ে সামরিক আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়।
ফলস্বরূপ, এটিকে বৈধতা প্রদানকারী সংবিধান (সপ্তম সংশোধন) আইন, ১৯৮৬ (১৯৮৬ সনের ১ নং আইন) বাতিল ঘোষিত হয় এবং উক্ত অধ্যাদেশসমূহের কার্যকারিতা লোপ পায়। এছাড়াও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এরও নির্দেশনা ছিল নতুন আয়কর আইন প্রণয়নের।
নতুন আয়কর আইন, ২০২৩ বিদ্যমান কাঠামোতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংশোধন এবং উন্নতি এনেছে। এটি ট্যাক্স পদ্ধতি সহজীকরণ, করদাতাদের সম্মতি বৃদ্ধি এবং একটি ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত কর ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের আয়কর ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ এবং সচল রাখা, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা।
নতুন আয়কর আইনের কিছু বৈশিষ্ট্য
সহজ কর কাঠামো: আইনটিতে ব্যক্তি এবং ব্যবসা উভয়ের চাহিদা পূরণ করে সংশোধিত করের হার এবং স্ল্যাব সহ একটি সহজ কর কাঠামো প্রবর্তন করা হয়েছে।রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে যে সমস্ত কাগজপত্র দরকার হবে, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে সেগুলো সহজতর করা হয়েছে। খসড়া উপস্থাপনের আগে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেয়া হয়েছে। যেন পুরো কাজটাকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
ডিজিটাল রূপান্তর: ডিজিটাল যুগকে আলিঙ্গন করে, আইনটি ট্যাক্স প্রশাসনের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর জোর দেয়, ডিজিটাল বিচারিক প্রক্রিয়া সহ ট্যাক্স রিটার্নের আরও অ্যাক্সেসযোগ্য ফাইলিং এবং দ্রুত প্রক্রিয়াকরণ সক্ষম করে। এই আইনের মাধ্যমে অনলাইনে আয়কর দেওয়া আরও সহজ করা হবে। অনলাইনে আমরা এখন যেভাবে দেই, যেভাবে প্রশ্নগুলো আসে, সেগুলো অনেক সহজ করা হয়েছে। ইনকাম ট্যাক্স পদ্ধতিতে আমরা এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই আইসিটি নির্ভর হতে যাচ্ছি।
কর ফাঁকির সুযোগ নেই: আইনটিতে কর ফাঁকি রোধ করতে এবং সমস্ত করদাতাদের জন্য সমান ভূমিকা নিশ্চিত করতে শক্তিশালী অ্যান্টি-অ্যাভয়েডেন্স বিধানগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আয়কর অধ্যাদেশে ৩৮টি সরকারি-বেসরকারি সেবা নিতে হলে রিটার্ন জমার প্রমাণ দাখিল করতে হতো। নতুন আয়কর আইনে ৩৮টি সেবার সঙ্গে আরো পাঁচটি নতুন খাত যোগ করা হয়েছে।
উন্নত কর প্রশাসন: নতুন আইনটি কর প্রশাসনকে আরও দক্ষ ও স্বচ্ছ করে তুলেছে। কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাক্ষমতা কমিয়ে ব্যবসা ও বিনিয়োগ সহজ করার লক্ষ্যে বাংলা ভাষায় যুগপোযোগী ও আধুনিক করে আয়কর আইন-২০২৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। নতুন আইনের ফলে কর কর্মকর্তা নিজের ইচ্ছামাফিক আয়কর নির্ধারণ করতে পারবেন না। আইনে নির্ধারণ করে দেওয়া ফর্মুলা অনুযায়ী আয়কর নির্ধারণ হবে।এখন যেই গাণিতিক ফর্মুলা দেওয়া হয়েছে ঐ ফর্মুলায় যে রেজাল্ট আসবে, সেটাই হবে তার জন্য নির্ধারিত ট্যাক্স।
আমাদের ট্যাক্স কর্মকর্তাদের যে অবাধ ‘ডিসক্রিয়েশনি পাওয়ার’ ছিল, তা সীমিত করা হয়েছে। অফিসার নিজে ইচ্ছা করলেই বাড়াতে বা কমাতে পারবেন না। পূর্বে একজনের ওপর কত ট্র্যাক্স ধার্য হবে, তা আয়কর কর্মকর্তা কিছুটা ডিসাইড করতেন। আয়কর কর্মকর্তার যেটা যৌক্তিক বলে মনে হতো, সেটা তিনি করতে পারতেন। এতে আপিলের সংখ্যা বেড়ে যেতো। এখন যেটা করা হয়েছে ওই কর্মকর্তার সাবজেক্টিভ জাজমেন্টের ওপর নয় বরং একটা ফর্মুলা করা হয়েছে, সেখানে অবজেক্টিভ ইনফরমেশনগুলো দেবেন, ফর্মুলা আপানাকে ক্যালকুলেট করে দেবে। এতে হয়রানির সুযোগ কমে যাবে।
সহজবোধ্য ও সাবলীল: আমাদের বিদ্যমান যে আইনটি ইংরেজিতে ছিল ওটাকে বাংলায় করা হয়েছে যাতে এটি সর্বসাধারণের জন্যে সহজবোধ্য হয়। তাই ভাষা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। বিশেষ করে যেখানে জটিলতা বেশি ও অস্পষ্টতা ছিল, সেগুলো বাতিল করা হয়েছে।
আয়-বৈষম্য হ্রাসকরণের প্রচেষ্টা: বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো নতুন আয়কর আইন ২০২৩ ট্যাক্স সম্মতি এবং রাজস্ব সংহতি উন্নত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে টিআইএন ধারক আছে প্রায় ৮৬ লাখ তবে এরমধ্যে ৩৫ লাখের বেশি মানুষ রিটার্ন জমা দেয় না। যদি টিআইএন ধারকদের ৯০ শতাংশ রিটার্ন জমা দিলেও রাজস্ব আয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। ট্যাক্সের বেজ যাতে সম্প্রসারণ হয়, সেই সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।
৩৪৫টি ধারা সম্বলিত আয়কর আইনটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশংসা অর্জন করেছে। যেমন : কোনো করদাতা দেশের বাইরে সম্পদ ক্রয় করলে তার সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়া, কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাক্ষমতা কমানোর বিধান নিশ্চিত করার মতন বিষয়গুলি উঠে এসেছে নতুন আয়কর আইনে। নতুন আয়কর আইন অনেকটা মানবিক হয়েছে। কেননা নতুন আয়কর আইনে টিআইএন বাতিলের সুযোগ রাখা হয়েছে নানা কারণে। কোনো করদাতা যদি মারা যায় বা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ ত্যাগ করে বা পরপর তিন বছর করযোগ্য আয় না থাকলে টিআইএন বাতিল করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ বিষয়গুলো অনেকটা ইতিবাচক।
আমাদের করণীয়
আমাদের অবশ্যই নতুন বিধানগুলির সাথে নিজেদের পরিচিত করতে হবে এবং কার্যাবলী বুঝতে হবে। এটি আমাদের সংশোধিত কর ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে চলতে সুবিধা হবে। প্রত্যেককে আয়কর আইন, ২০২৩-এর সাথে পরিচিত এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারা জারি করা যেকোনো নির্দেশিকা বা বিজ্ঞপ্তির সাথে আপডেট থাকার জন্য উৎসাহিত করছি। কর সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের সকলকে জ্ঞান এবং দক্ষতা বাড়ানোর ও দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার আহ্বান জানাই।
লেখক: লিগ্যাল কনসালটেন্ট এবং শিক্ষানবিশ আইনজীবী, জজ কোর্ট, ঢাকা।