মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী: আদালতে মিথ্যা মামলা দায়ের করে অহেতুক নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করায় মিথ্যা মামলার বাদীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন।
কক্সবাজারের আদালত নম্বর ২ এর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ এহসানুল ইসলাম গত ২২ আগস্ট রামু থানার এসআই মোঃ শরীফুল ইসলাম’কে এ নির্দেশ দেন।
কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক ইলাহী শাহজাহান নুরী ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে এ তথ্য জানান।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের পূর্ব তিতার পাড়ার শাহ আলম এর স্ত্রী হোসনে আরা বেগম (৪০) ২০২২ সালের ২০ জুলাই কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-৪ এর বিচারক আখতার জাবেদ এর আদালতে একটি নালিশী দরখাস্ত দায়ের করেন।
নালিশী দরখাস্তে একই এলাকার ৬ জনকে আসামী হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তারা হলেন-আলী আহমেদর পুত্র আবদুল মান্নান (৩৭), মৃত বকতার আহমদের পুত্র ফরিদ আলম (৩৪), নুর আহম্মদের পুত্র মোহাম্মদ মেহেদী (২০), আহম্মদের ২ পুত্র মোস্তাক আহমদ (৩২) ও নুর কবির (২৫) এবং মৃত ফজল করিমের পুত্র মোঃ নবী (৪৭)। আসামীদের সকলের বাড়ি রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের পূর্ব তিতার পাড়ায়।
আসামীরা বাদী হোসনে আরা বেগমের প্রতিবেশী হলেও তাদের সাথে হোসনে আরা বেগমের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিলো। নালিশী দরখাস্ত মতে, আসামীরা ২০২২ সালের ৭ জুলাই রাত আড়াইটার দিকে হোসনে আরা বেগম এর বসতবাড়ীর দুইটি দরজার বাহির থেকে পেরেক দিয়ে কাঠের বাটাম লাগিয়ে দরজা ২টি বন্ধ করে দেয়।
পরে হোসনে আরা বেগম বসতবাড়ীর ভিতরে অবরুদ্ধ থাকাবস্থায় তাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে বাড়ীর চতুর্দিকের বাঁশের বেড়ায় কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আসামীরা আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুন জ্বলা অবস্থায় হোসনে আরা বেগমের শোর চিৎকার শুনে তাকে জ্বলন্ত বাড়ির ভেতর থেকে উদ্ধার করলেও বাড়ির আসবাবপত্র, হাস, মুরগী, মূল্যবান জিনিস পত্র, ভস্মীভূত হয়ে তার ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়।
বিচারক নালিশী দরখাস্তটি আমলে নিয়ে সেটিকে জিআর মামলা হিসাবে গন্য করে থানায় রেকর্ড করার জন্য রামু থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কে নির্দেশ দেন। ২০২২ সালের ২৪ জুলাই রামু থানার তৎকালীন ওসি মুহাম্মদ আনোয়ারুল হোসাইন বাদী হোসনে আরা বেগমের নালিশী দরখাস্তটি মামলা হিসাবে দন্ড বিধির ১৪৩/৩৪১/৩২৩/৩২৫/৩২৬/৩০৭/৩৭৯/৫০৬ (২য় অংশ) ধারায় রেকর্ড করে এসআই মোঃ শরীফুল ইসলামকে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) নিয়োগ দেন। যার রামু থানা মামলা নম্বর : ৪০, তারিখ : ২৪/০৭/২০২২ ইংরেজি এবং যার জিআর মামলা নম্বর : ৪০৭/২০২২ (রামু) ইংরেজি।
মামলাটির আইও মোঃ শরীফুল ইসলাম সরেজমিনে গিয়ে মামলাটি তদন্ত করেন। তদন্তে দেখা যায়-নালিশী দরখাস্তে উল্লেখিত স্থানে কোনো ঘরবাড়ি পোড়ানো হয়নি। পোড়ানোর কোন চিহ্নও নাই। স্থানীয় লোকজনের সাক্ষ্য নিলে তারাও কোন ঘরবাড়ি কথিত ঘটনাস্থলে পোড়ানোর কথা জানেননা এবং দেখেননি বলে আইও-কে সাক্ষ্য দেন।
আইও সরেজমিনে গিয়ে এরকম ৯ জন স্থানীয় লোকের লিখিত সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। সাক্ষীদের ধারণা, বাদীর সাথে আসামীদের পূর্ব শত্রুতার জের ধরে বাদী নিজের ঝুপড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে এ ব্যাপারে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে।
কথিত ঘটনায় বাদী হোসনে আরা বেগমও কোন আহত হননি, সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলো। কথিত ঘটনাস্থলের চতুর্দিকে কোন বসতবাড়িও নেই। বরং ঘটনাস্থলে বাদীর স্বামী শাহ আলম তার বিরোধপূর্ণ জমির দখল সত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বাঁশের কঞ্চির খুঁটি দিয়ে পলিথিন ঘেরা একটি ঝুপড়ি তৈরি করে রেখেছেন।
যেখানে দরজা জানালাতো দূরের কথা, সেটি মানুষ বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য। এ ঝুপড়ি থেকে বাদী হোসনে আরা বেগমকে উদ্ধার এবং পলিথিন ঘেরা ঝুপড়ির দরজা পেরেক ঠুকে বাঠাম মেরে দেওয়ার ঘটনা একেবারে অবিশ্বাস্য ও বানোয়াট।
আইও মোঃ শরীফুল ইসলাম জানতে পারেন, পূর্বের ভিন্ন একটা ঘটনায় আসামী মোহাম্মদ মেহেদীর বোন সখিনা বেগম বাদী হয়ে অত্র মামলার বাদী হোসনে আরা বেগম ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে রামু থানায় ২০২২ সালের ১২ মে পৃথক একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। যার রামু থানা মামলা নম্বর : ১৮।
এ মামলাটি তুলে নেওয়ার জন্য বাদী হোসনে আরা বেগম তার প্রতিপক্ষকে বিভিন্নভাবে চাপ দেয়। এতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার কুমানসে পাল্টা মামলা হিসাবে জিআর : ৪০৭/২০২২ (রামু) নম্বর সাজানো মিথ্যা মামলাটি হোসনে আরা বেগম দায়ের করেন বলে সরেজমিনে তদন্তে আইও জানতে পারেন।
নালিশী দরখাস্তটির অভিযোগের বিষয়ে সরেজমিনে করা বিস্তারিত তদন্তে আইও কোন ধরনের সত্যতা পাননি। অভিযোগ সমূহ সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও সাজানো বলে আইও এর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এজন্য নালিশী দরখাস্তে থাকা আসামীদের অভিযোগের দায় হতে অব্যাহতি দিয়ে, মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগে বাদী হোসনে আরা বেগমের বিরুদ্ধে ফৌজদারী কার্যবিধির ২১১ ধারা মতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইও আদালতে প্রার্থনা জানান।
আইও মোঃ শরীফুল ইসলাম তাঁর উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গত ২৪ জুন নালিশী দরখাস্তটির তদন্ত প্রতিবেদন আকারে রামু থানার চূড়ান্ত রিপোর্ট (মিথ্যা) নম্বর ২৫ আদালতে দাখিল করেন।
অথচ এ মিথ্যা মামলাটি আদালতের নির্দেশে রামু থানায় এন্ট্রি হওয়ার পর ২০২২ সালের ৪ আগস্ট আসামী আবদুল মান্নান ও ফরিদ আলম আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেছিলেন। কিন্তু আদালত নালিশী দরখাস্তের অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় আসামীদ্বয়ের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠান।
পরে প্রায় এক মাস কারাবাসের পর মিথ্যা মামলার আসামী আবদুল মান্নান ও ফরিদ আলম একই সালের ৩০ আগস্ট আদালত থেকে জামিন লাভ করেন।
আদালত আইও এর দাখিলকৃত চুড়ান্ত রিপোর্ট (মিথ্যা) এর সূচীপত্র, ঘটনাস্থলের মানচিত্র, স্থানীয় ৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য, কেইস ডায়রীর বর্ননা, স্থিরচিত্র, সরেজমিনে তদন্তের প্রতিবেদন সহ সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করেন।
পর্যালোচনায় নালিশী দরখাস্তটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট বলে প্রতীয়মান হয়, আইও এর দাখিলীয় চুড়ান্ত প্রতিবেদন যথার্থ ও সঠিক বলে আদালতের কাছে মনে হয়েছে। তাছাড়া, পারিপার্শ্বিক ও সার্বিক বিষয়ে আইও এর প্রদত্ত তদন্ত প্রতিবেদন এর সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে।
অপরদিকে, বাদী হোসনে আরা বেগম আদালতে আইও এর প্রদত্ত চুড়ান্ত রিপোর্ট (মিথ্যা) এর বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেন। নারাজি আবেদনে তিনি আইও এর প্রদত্ত তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ও যৌক্তিক কোন বক্তব্য তুলে ধরেননি। এছাড়া, বাদী হোসনে আরা বেগম আদালতে দেওয়া তার হলফনামায় বসতবাড়ীর বিষয়ে একেক সময়, একেক কথা বলেছেন। কোন আসামী কখন, কিভাবে অগ্নি সংযোগ করেছেন, তা সুস্পষ্টভাবে বলেননি।
এ অবস্থায়, আইও এর প্রদত্ত চুড়ান্ত রিপোর্ট (মিথ্যা) এর বিরুদ্ধে বাদী হোসনে আরা বেগমের নারাজি আবেদন গত ২২ আগস্ট আদালতের বিজ্ঞ বিচারক মোহাম্মদ এহসানুল ইসলাম নামঞ্জুর করেন।
একইসাথে আইও মো: শরীফুল ইসলামের প্রদত্ত চূড়ান্ত রিপোর্ট (মিথ্যা) গ্রহণ করেন এবং আইও এর প্রার্থনা মঞ্জুর করে মিথ্যা মামলা দায়ের করায় বাদী হোসনে আরা বেগমের বিরুদ্ধে পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যে ফৌজদারী কার্যবিধির ২১১ ধারা মতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইও-কে নির্দেশ দেন।
এছাড়া, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ এহসানুল ইসলাম আসামীদের এ মিথ্যা মামলার দায় হতে অব্যাহতি দেন।
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তারেক ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, আদালতে দায়ের করা কোন মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে, মিথ্যা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এতে মানুষ মিথ্যা মামলার হয়রানি থেকে রেহায় পাবে।
আদালত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংশ্লিষ্ট সরকারি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গুলোর মূল্যবান সময় অপচয় হবেনা। আদালতেও মামলার জট কিছুটা কমবে এবং সাধারণ মানুষের কাছে আদালত সম্পর্কে একটা ইতিবাচক ম্যাসেজ যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তারেক।
তাছাড়া, আদালত পাড়ায় টাউট বাটপারের দৌরাত্ম্যও অনেকটা হ্রাস পাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এদিকে, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও), রামু থানার এসআই মোঃ শরীফুল ইসলাম বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদালতের দেওয়া আদেশ হাতে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশনা মতো মিথ্যা মামলার বাদী হোসনে আরা বেগমের বিরুদ্ধে ফৌজদারী কার্যবিধির ২১১ ধারা মতে পরবর্তী ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে তিনি জানান।