করজাল বাড়াতে নতুন ২৮টি কর অঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব কর অঞ্চলের জন্য চার হাজার ৬০০টি নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব আগামী সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় উঠছে।
ক্যাডার কর্মকর্তাদের (সহকারী কর কমিশনার থেকে কর কমিশনার) পদোন্নতি দিয়ে নতুন কর অঞ্চলে পদায়ন এবং কর্মচারী পদে নতুন লোকবল নিয়োগ দেওয়া হবে বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, আধুনিক, যুগোপযোগী, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর এবং আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা অনুযায়ী আয়কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগের অংশ হিসাবে নতুন কর অঞ্চল স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
আয়কর বিরোধ ব্যবস্থাপনা ইউনিট, ই-ট্যাক্স ব্যবস্থাপনা ইউনিট, আয়কর গোয়েন্দা, তদন্ত ও এনফোর্সমেন্ট ইউনিট, আন্তর্জাতিক কর ইউনিট, উৎসে কর ব্যবস্থাপনা ইউনিট, ঢাকায় ১৩টি কর অঞ্চল, চট্টগ্রামে তিনটি, খুলনায় তিনটি, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও রংপুরে ১টিসহ মোট ২৩টি নতুন কর অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে। উপজেলা পর্যায়ে করজাল বিস্তৃত করতে নতুন কর অঞ্চলের পাশাপাশি গ্রোথ সেন্টার স্থাপন করা হবে, যা কর আদায় বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
সূত্র আরও জানায়, গত বছর কর প্রশাসন সম্প্রসারণের যৌক্তিকতা তুলে ধরে এনবিআর থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এই চিঠির প্রেক্ষিতে সম্প্রসারণের প্রস্তাব সচিব কমিটিতে উঠবে। সচিব কমিটি অনুমোদন দিলে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে।
প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়া গেলে নতুন কর অঞ্চল স্থাপনে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। প্রাথমিকভাবে তিন ধাপে নতুন কর অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা আছে। একই সঙ্গে পুরোনো কর অঞ্চলের সার্কেল অফিস উপজেলা পর্যায়ে বিস্তৃত করার উদ্যোগও নেওয়া হবে।
চলতি বাজেট বক্তৃতায় রাজস্ব প্রশাসনের সম্প্রসারণের ইঙ্গিত দিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, রাজস্ব প্রশাসনের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নানাবিধ সংস্কার কার্যক্রম চলমান আছে। এনবিআরের অধীনে সব প্রশিক্ষণ একাডেমিকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সেবার মান উন্নয়ন ও করের আওতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজস্ব প্রশাসনের সম্প্রসারণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১১ সালে সর্বশেষ আয়কর প্রশাসনের কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে ৩১টি কর অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময়ের তুলনায় এখন করদাতার সংখ্যা ৬ গুণ বেড়েছে। বর্তমানে প্রতিটি কর অঞ্চলে গড়ে দুই লাখ ছয় হাজার করদাতা রয়েছেন। সার্কেল হিসাবে প্রতিটি সার্কেলে করদাতা রয়েছেন প্রায় ১০ হাজার।
এসব করদাতার সেবা দিতে প্রতিটি সার্কেলে গড়ে ৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। এত কম জনবল দিয়ে করদাতাদের মানসম্মত সেবা দেওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি জনবল সংকটের কারণে সঠিকভাবে কর আদায়, করজাল বৃদ্ধি এবং কর ফাঁকি প্রতিরোধসহ অন্য কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ আয়কর বিভাগ সবচেয়ে কম খরচে সবচেয়ে বেশি আয়কর আদায় করে। ১০০ টাকা আয়কর আদায় করতে ৬৬ পয়সা খরচ হয়, যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিু। বর্তমানে রাজস্ব আদায়ে আয়করের অবদান ৩৩ শতাংশ। আগামী ১০ বছরের মধ্যে এটি ৪৫ শতাংশে এবং ২০৩০-৩১ অর্থবছরের মধ্যে করদাতার সংখ্যা এক কোটি ৬০ লাখে উন্নীত করতে কর প্রশাসন সম্প্রসারণ ও লজিস্টিক খাতে যুক্তিসঙ্গত বরাদ্দ ছাড়া অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো দুঃসাধ্য ব্যাপার।
অন্যদিকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে আইটিভিত্তিক নানা ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটছে। এ ধরনের ব্যবসার আয় থেকে বর্তমান কাঠামো দিয়ে কর আদায় সম্ভব নয়। তাই প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়াতে আয়কর বিভাগের সংস্কার ও সম্প্রসারণের বিকল্প নেই।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, করজাল বাড়াতে কর অঞ্চল সম্প্রসারণ ও লোকবল বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। এর আগে কর কর্মকর্তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে এবং করদাতাদের হয়রানি বন্ধে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক কর বিভাগ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে করদাতারা অনলাইনে কর কর্মকর্তাদের কাছে যাওয়া ছাড়াই সেবা গ্রহণ করতে এবং কর দিতে পারেন। এখন যারা কর দিচ্ছেন, তাদের চাপ দিয়ে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে চেষ্টা করেন মাঠপর্যায়ের কর কর্মকর্তারা, এ চেতনারও পরিবর্তন আনা উচিত।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, কর বিভাগ সম্প্রসারণ বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এক দশকে বেশ অগ্রগতি সাধন করেছে। উপজেলা পর্যায়ে অনেক মানুষ কর দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেও সেখান থেকে আয়কর আদায় করা যাচ্ছে না।
আয়কর অফিস সম্প্রসারণের মাধ্যমে সেটা করা সম্ভব হবে। তবে শুধুমাত্র কর অঞ্চল স্থাপন করলেই হবে না, সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, করদাতাদের হয়রানির মানসিকতা থেকে কর কর্মকর্তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সংস্কারে মনোযোগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি।