দেশের অধস্তন আদালতে মামলা নিষ্পত্তি আশানুরূপ বেড়েছে। কোনো কোনো জেলার বিভিন্ন আদালতগুলোতে নিষ্পত্তির হার শতভাগের বেশি। কিন্তু এই আশার মধ্যেও অস্বস্তি হয়ে উঠেছে মামলা বাড়ার প্রবণতা।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে গত আট মাসে নিষ্পত্তি ও মামলা দায়েরে তারতম্যের হিসেবে এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে। এই সময়ে মামলা নিষ্পত্তির চাইতে আদালতে বিচারের জন্য মামলা এসেছে তিন লাখের বেশি।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলেন, গত এক দশকে মামলাজট অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সুপ্রিম কোর্টের নানা উদ্যোগে নিষ্পত্তিও বেড়েছে। কিন্তু আইন আদালতের প্রতি বিচার প্রত্যাশীর প্রত্যাশা থাকলেও এর সুফল মিলছে না।
মামলা বৃদ্ধি প্রবণতার কারণ হিসেবে আদালতে প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক না হওয়া, বিচারক স্বল্পতা, ঘন ঘন শুনানি মুলতবি, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআরের কম প্রয়োগসহ বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন আইনজীবীরা।
সমাধান হিসেবে আদালতের বাইরে সমাধানযোগ্য বিরোধ বা মামলায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বা এডিআরের দিকে ঝুঁকতে হবে বলে মত দেন তারা।
উচ্চ আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত অধস্তন আদালতে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৫৭৭ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তিকৃত মামলার মধ্যে দেওয়ানি মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩৮টি। এই সময়ে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৮৩৯ ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
বিপরীতে একই সময়ে মামলা দায়ের হয়েছে ৮ লাখ ৫৩ হাজার ৭৪৭টি। এসব মামলার মধ্যে ফৌজদারি মামলার সংখ্যাই বেশি যা সংখ্যার হিসেবে ৬ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৩টি। এ ছাড়া এই আট মাসে অধস্তন আদালতে দেওয়ানি মামলা দায়ের হয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৪টি।
পরিসংখ্যানের হিসাব অনুযায়ী, আট মাসে মামলা নিষ্পত্তি ও মামলা দায়েরের মধ্যে ব্যবধান ৩ লাখ ২ হাজার ১৭০ মামলা।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের নানা উদ্যোগে মামলা নিষ্পত্তি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আবার মামলাও কিন্তু বেড়েই চলেছে। এ থেকে নিষ্কৃতি পেতে আমাদেরকে অবশ্যই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির দিকে যেতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আপোষ কিংবা মধ্যস্থতার যোগ্য এমন অন্তত কিছু সংখ্যক মামলা যদি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি করা যায় পক্ষগণকে বোঝানো যায় যে, এটি (এডিআর) একটি ভাল পদ্ধতি তাহলে বিরোধ ও মামলা কমে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অধস্তন আদালতগুলোতে এখনো প্রযুক্তির ব্যবহার কম। বিচারকদের এখনো মামলার শুনানির বিষয় হাতে কলমে লিখতে হয়। এতে আদালতের কয়েক ঘণ্টার কর্ম দিবসের নির্দিষ্ট সময় চলে যায়। সাক্ষীদের জবানবন্দি ও জেরার বিষয়টি যদি কম্পিউটারে লেখা হয় তাহলে বিচারকদের অনেক সময় বেঁচে যাবে।’
২০২২ সালে জানুয়ারির শেষদিকে দেশের ৮টি বিভাগের অধস্তন আদালত তদারকি করতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ৮ জন বিচারপতিকে দায়িত্ব দেন তখনকার প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, এ উদ্যোগের পর থেকে বিচারপতিগণ বিভিন্ন সময়ে অধস্তন আদালত পরিদর্শন ও বিচারকাজ গতিশীল করতে নানা দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। এরপর থেকে মামলা নিষ্পত্তি অতীতের অনেক সময়ের চাইতে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিচারপতিগণ তদারকি শুরুর কয়েক মাস পর থেকে মামলা নিষ্পত্তিতে উল্লেখ করার মত গতি এসেছে। অধস্তন আদালতগুলো নিয়মিতভাবে মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির পরিসংখ্যান সুপ্রিম কোর্টকে অবহিত করছে।
গত বছরের শেষ তিন মাসের (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৯০ দিনে ৩ লাখ ১০ হাজার মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ৯৪ হাজার ৯৪২ এবং ফৌজদারি মামলা ২ লাখ ১৫ হাজার ৯১৯টি।
এই তিন মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫৭১টি মামলা। নিষ্পত্তিকৃত মামলাগুলোর মধ্যে দেওয়ানি ৩০ হাজার ১৮১ এবং ফৌজদারি ১ লাখ ১৫ হাজার ৩৯০টি। অর্থাৎ তিন মাসে অনিষ্পন্ন ছিল ১ লাখ ৬৪ হাজার ৪২৯ মামলা।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালতে অনিষ্পন্ন কিংবা বিচারাধীন দেওয়ানি, ফৌজদারি ও অন্যান্য মামলা ৪২ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে অধস্তন আদালতে ১৫ লাখ ৭৮ হাজার ৭১৪টি দেওয়ানি এবং ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৬৪ ফৌজদারিসহ বিচারাধীন মামলা ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩৭৮। আইন ও বিচার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই গতিতে মামলা বাড়লে নিকট ভবিষ্যতে তা ৫০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও আইন সাময়িকী ডিএলআরের সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘মানুষ বাড়ছে। নানা কারণে মানুষের মধ্যে বিরোধ, অসহিষ্ণুতা ও অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। ভূমির বিরোধ নিয়ে দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তির চাইতে দায়েরের সংখ্যা অনেক বেশি। মূলত এসব কারণেই মামলার জট থেকে নিষ্কৃতি মিলছে না।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে মামলার অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। বিচারক যেমন বাড়াতে হবে তেমনি তাদের অবকাঠামো ও আদালতের অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধাও পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে। বিচারক নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের আরও ভাবতে হবে। না হলে নিষ্পত্তি যতই হোক মামলা কিন্তু বাড়তেই থাকবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন মজুমদার বলেন, ‘আদালতগুলোতে মামলাজট আগেও ছিল। কিন্তু গত এক দশকে এটি বহুগুণে বেড়েছে। মানুষ আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হচ্ছে এটি ভাল দিক। আবার মানুষের মধ্যে মামলার প্রবণতাও বেড়েছে। ফলে আদালতগুলোতে মামলার চাপ বাড়ছে। বিশেষ ভূমির মালিকানা নিয়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি দুই ধরনের মামলা বেড়েছে। একদিকে অধিক মামলার চাপ, অন্যদিকে শুনানি ঘন ঘন মুলতবির কারণে মামলা অনিষ্পন্ন থাকছে।’