দুর্নীতির কারণে মানুষ অস্বস্তিতে, কখনো সংকটাপন্ন: সুলতানা কামাল
জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদের (আনকাক) দ্বিতীয় ও পঞ্চম অধ্যায়ের বাস্তবায়ন পর্যালোচনা সংক্রান্ত প্রতিবেদন নিয়ে সংবাদ সম্মেলন

দুর্নীতির কারণে মানুষ অস্বস্তিতে, কখনো সংকটাপন্ন: সুলতানা কামাল

দুর্নীতির কারণে ব্যক্তিগত থেকে সামাজিক জীবনে মানুষ এখন মোটামুটি একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে আছে বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, ‘অস্বস্তিকর বললে কম বলা হবে, তবে কখনো কখনো সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্যে আছে।’

ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদের (আনকাক) দ্বিতীয় ও পঞ্চম অধ্যায়ের বাস্তবায়ন পর্যালোচনার সময় সুলতানা কামাল এমন মন্তব্য করেন।

আনকাকের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবির অন্যান্য কর্মকর্তা।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশে জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদের অনুচ্ছেদগুলোর আইনত বাস্তবায়ন মোটামুটি হলেও প্রায়োগিক বাস্তবায়ন নিম্ন পর্যায়ের। টিআইবির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সুলতানা কামাল বলেন, ‘জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদের দ্বিতীয় ও পঞ্চম অধ্যায়ে অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে দেশের অগ্রগতি কতখানি হয়েছে, একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ কী আছে, সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণার ওপর নির্ভর করে সুপারিশও দেওয়া আছে।’

সুলতানা কামাল এই তথ্যগুলো জনগণের কাছে তুলে ধরতে গণমাধ্যমকে আহ্বান জানান। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সরকারের বিরাট দায়-দায়িত্ব আছে। সরকার নাগরিক সমাজকে এই প্রক্রিয়ায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আবার টিআইবির নিজস্ব দায়িত্ব হিসেবেও এটা করা হয়।

আইনের অগ্রগতি হলেও বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন আইনের অগ্রগতি হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদের অনুচ্ছেদ ৫—দুর্নীতি দমন নীতিমালা ও কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়ন আইনতভাবে মোটামুটি, তবে প্রায়োগিক বাস্তবায়ন নিম্ন পর্যায়ের।

অনুচ্ছেদ ৬—দুর্নীতি প্রতিরোধক সংস্থাসমূহ আইনত বাস্তবায়ন মোটামুটি, তবে বাস্তবিক মধ্যম পর্যায়ের।

অনুচ্ছেদ ৭.১, ৭.২, ৮.১, ৮.২, ৮.৩ ও ১২—সরকারি খাত, সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণবিধি, স্বার্থের সংঘাত ও সম্পত্তি সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ আইনত বাস্তবায়ন মোটামুটি আর বাস্তবিক নিম্ন পর্যায়ের।

অনুচ্ছেদ ৭.৩—রাজনৈতিক অর্থায়ন আইনত বাস্তবায়ন আংশিক আর বাস্তবিক নিম্ন পর্যায়ের।

অনুচ্ছেদ ৮.৪ ও ১৩.২—রিপোর্টিং প্রক্রিয়া ও তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা মোটামুটি, তবে বাস্তবিক নিম্ন পর্যায়ের।

অনুচ্ছেদ ৯.১ ও ৯.২—সরকারি ক্রয় ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা মোটামুটি এবং প্রয়োগ মধ্যম পর্যায়ের।

অনুচ্ছেদ ১০ ও ১৩.১—তথ্যে অভিগম্যতা ও সমাজের অংশগ্রহণ মোটামুটি আর বাস্তবিকভাবে মধ্যম পর্যায়ের।

অনুচ্ছেদ ১১—বিচার বিভাগ ও প্রসিকিউশন সেবা মোটামুটি, তবে প্রয়োগ মধ্যম পর্যায়ের।

অনুচ্ছেদ ১৪, ৫২ ও ৫৮—অর্থ পাচার প্রতিরোধে গৃহীত ব্যবস্থা মোটামুটি আর প্রয়োগ নিম্ন পর্যায়ের।

অনুচ্ছেদ ৫১, ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৯: পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা মোটামুটি আর প্রয়োগ নিম্ন পর্যায়ের।

অনুচ্ছেদ ৫৭—অপরাধের দ্বারা অর্জিত সম্পদ পুনরুদ্ধার ও নিষ্পত্তিকরণ মোটামুটি আর প্রয়োগ নিম্ন পর্যায়ের।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যকারিতা মধ্যম পর্যায়ের। তবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগসূত্র রয়েছে এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্র নিম্ন পর্যায়ের।

এ ছাড়া সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট বা সিপিটিইউ কার্যকারিতা উত্তম পর্যায়ের। তবে রাজনৈতিক প্রভাব ও হস্তক্ষেপের কারণে সরকারি ক্রয়ে এখনো সমস্যা আছ। তথ্য কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য প্রত্যাশিত পর্যায়ের নয়। ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কার্যকারিতা মধ্যম পর্যায়ের তবে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ বিরল।

টিআইবির ১৬ দফা সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ

দুদকের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং একে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব মুক্ত রাখা;

দুদকের এখতিয়ার ও এর কার্য-পরিধি খর্ব করে আইনের এমন ধারাসমূহ এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ বাতিল করা;

২০১২ সালের সংস্করণে যে সকল অর্থপাচার-সংক্রান্ত অপরাধ দুদকের এখতিয়ার বহির্ভূত করা হয়েছে, সেগুলোকে পুনরায় দুদকের হাতে পুনর্বহাল করা;

সুপ্রীম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগ ও অপসারণের এখতিয়ার স্বাধীন সত্তার (যেমন – সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল) ওপর ন্যস্ত করা;

সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদ-সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ নিশ্চিতকরণে সম্পদের বাৎসরিক বিবরণ জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি ও প্রয়োগ করা;

সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে গণতাস্ত্রিক ও জবাবহিতামুলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা;

জাতীয় পর্যায়ে ও খাতভিত্তিক ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা করা;

সরকারি খাতে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা;

অর্থপাচার রোধে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের পেশাগত দক্ষতা ও কার্যকরতা বৃদ্ধি করা;

পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে মিউচুয়াল লিগাল এসিস্ট্যান্সসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালকের বক্তব্য

টিআইবির প্রতিবেদন তুলে ধরে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘২০০৭ সালে জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশ। আর এই প্রতিবেদনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের উদ্যোগ, সফলতা, চ্যালেঞ্জসমূহ সার্বিক পর্যালোচনা করা। চলতি বছরের ১৩ জুন সরকার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সরকার থেকে প্রণীত প্রতিবেদনের ওপর মতামত দিতে বলে। এখানে শুধু টিআইবি অংশগ্রহণ করে মন্তব্য প্রদান করে।’

ইফতেখারুজ্জামান অভিযোগ করেন, ‘তথ্য সংগ্রহে সরকারি দপ্তরসমূহে প্রবেশাধিকার সীমিত ছিল। অনেক ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। আবার অনেক কর্মকর্তা তথ্য দিতে চাননি।’

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (৩ অক্টোবর) মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বিদায়ী চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. পারভীন হাসানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন।