দীপজয় বড়ুয়া: বাংলাদেশে বিভিন্ন ঘটনায় গ্রেপ্তার করার পরে নারী ও পুরুষদের প্রায়শই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। সেখানে জব্দ করা জিনিসপত্র সাজিয়ে গণমাধ্যমের সামনে এমনভাবে তাদের উপস্থাপন করা হয় ও বর্ণনা তুলে ধরা হয়, যাতে বিচারের আগেই তারা জনমনে দোষী বলে চিহ্নিত হয়ে যান। অনেকের ক্ষেত্রে নানারকম আপত্তিকর বিশেষণও ব্যবহার হয়।
এরকম কর্মকাণ্ড বন্ধ করার বিষয়ে ২০১২ সাথে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশের হাইকোর্ট। তারপরেও সেটি বন্ধ হয়নি। মামলা হওয়ার আগেই মাদক দ্রব্যসহ তাদের গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করা হয়। তাদের ক্ষেত্রে কিছু আপত্তিকর বিশেষণও ব্যবহার করা হয়।
বেশকিছু ঘটনায় দেখা গেছে, যেখানে সন্দেহভাজনদের দোষী প্রমাণিত হওয়া বা মামলা দায়েরের আগেই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে অপরাধের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে তাদের পক্ষে কোন বক্তব্য তুলে ধরার থাকে না। যে ক্ষতি হয়, সেটা আর পূরণ হয় না।
বাংলাদেশে আলোচিত সব ঘটনাতেই সন্দেহভাজনদের আটকের পর সরাসরি গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন বা তাদের ছবি, পরিচয় প্রচার করা অনেকটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে পুলিশের নিজস্ব বক্তব্য থাকলেও সেই আটককৃতদের কোন বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দেয়া হয় না। এসব ঘটনা ওই ব্যক্তিদের জন্য শুধুমাত্র মানহানিকর নয়, মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন। পুলিশের নিজস্ব বক্তব্য থাকলেও সেই আটককৃতদের কোন বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দেয়া হয় না।
যাকে এভাবে হাজির করা হয়, তিনি তো সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেনই। বিশেষ করে নারীদের জন্য এক ধরনের অসম্মানজনক ভাষা ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ তাদের টার্গেট করে দোষী প্রমাণের আগেই দোষী বানিয়ে ফেলা হয়। মানবিকতা বা আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গির কথাই বলি না কেন, কোনভাবেই এটা ঠিক নয়।
প্রায় সময় মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ করতে দেখা যায় যে, এভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে অভিযোগের তদন্ত বা বিচারের আগেই তাদের অপরাধী হিসাবে ধারণা দেয়া হচ্ছে। মিডিয়ার সামনে তাদের ছবি দিয়ে, পরিচয় তুলে ধরে এক ধরনের ট্রায়াল করে ফেলা হচ্ছে। পরবর্তীতে তিনি যদি দোষী প্রমাণিত না হন, তাহলে তার প্রতি বর্তমানে যে অন্যায়টা করে ফেলা হচ্ছে, সেটার বিচার কি হবে?
যাদের এরকম পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়, তাদের পারিবারিক, সামাজিক বা ব্যক্তিগত সম্মান হুমকির মুখে পড়ে। ফলে পরবর্তীতে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও ওই ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সবাইকে নানারকম অসম্মান, অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। নারীদের জন্য সেই মাত্রা হয় আরও অনেক বেশি।আইনের পরিষ্কার লঙ্ঘন
২০১২ সালে একজন বিচারক ফেনসিডিল সহ আটকের পর উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছিলো যে গ্রেফতার বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর কোন ব্যক্তিকে যেন গণমাধ্যমের সামনে হাজির না করা হয়। কিন্তু এরপরেও সেই পরিস্থিতির তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।
বরং সারা দেশেই গ্রেপ্তারের পর সন্দেহভাজনদের গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা বা তাদের ছবি-পরিচয় সহ তথ্য সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। এমনকি নারীদের ক্ষেত্রে অজ্ঞাত গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে নানারকম মানহানিকর বর্ণনাও প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
গণমাধ্যমে বাহিনীগুলোর বক্তব্য থাকলেও বেশিরভাগ সময় অভিযুক্তদের পক্ষের বক্তব্য থাকে না। হাইকোর্ট ডিভিশন বা অ্যাপিলেট ডিভিশন যখন কোন অর্ডার দেন, সেটা আমাদের সংবিধান অনুযায়ী আইনে পরিণত হয়। সুতরাং এটা পরিষ্কারভাবেই আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে। কারণ যেকোনো ট্রায়ালে অভিযুক্তকেও বক্তব্য দেয়ার সুযোগ থাকতে হবে।
কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন তাদের সম্পর্কে একতরফা বক্তব্য তুলে ধরে, তাদের সেখানে কোন বক্তব্য দেয়ার সুযোগ থাকে না। বিচার ব্যাপারটা তো হচ্ছে কোর্টের ব্যাপার। এখন যদি পুলিশ গ্রেপ্তারের পরে মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে বলে যে, তিনি এই অপরাধ করেছেন, তাহলে তো আর বিচারের প্রয়োজন পড়ে না।
এসব ক্ষেত্রে পরবর্তীতে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানহানির বা ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারেন। যেহেতু রাষ্ট্রের একটি বাহিনীর দ্বারা তার সম্মানহানি হয়েছে, অতএব রাষ্ট্রকেই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২-এ বলা হয়েছে যে, আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না। জীবনের অধিকার(right to life) বলতে বুঝায় সম্মানজনক জীবন (life with dignity)। কিন্তু গ্রেফতার পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমে উপস্থাপনের সময় একজন অভিযুক্তকে অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করা হয় যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ বহির্ভূত।
অনুচ্ছেদ ৩৫-এ বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারও সাথে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু গ্রেফতার পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমে উপস্থাপনের সময় একজন অভিযুক্তকে অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করা হয় যা তার মানবিক মর্যাদাকে ভূলুন্ঠিত করে। সুতরাং বলা যায় যে, এরূপ কাজ অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন এবং অনুচ্ছেদ ৩৫(৫) এর লঙ্ঘন।
অনুচ্ছেদ ৩৫(৪)-এ বলা হয়েছে যে, কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। অনেক সময় গ্রেফতার পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে গণমাধ্যমে উপস্থাপন করে কৃত অপরাধের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে বাধ্য করা হয় যা অনুচ্ছেদ ৩৫(৪) এর লঙ্ঘন।
39 BLD 470 (para 13) Ayesha siddhika minni Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতে একজন অভিযুক্ত বিচার প্রক্রিয়া শেষে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে বলা যাবে না যে তিনি প্রকৃত অপরাধী বা তার দ্বারাই অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে। গণমাধ্যমের সামনে গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা সংগত নয় যে, তার মর্যাদা ও সম্মানহানি হয় এবং তদন্ত চলাকালে অর্থাৎ পুলিশ রিপোর্ট দাখিলের পূর্বে গনমাধ্যমে গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তি বা মামলার তদন্ত কার্যক্রম সম্পর্কে এমন কোন বক্তব্য উপস্থাপন সমীচীন নয়, যা তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে”।
Arun Sharma Vs. The State of M.P. and Ors.-2021(1)MPLJ 510 মামলায় পিটিশনারকে গ্রেপ্তারের পর গণমাধ্যমের সামনে একজন অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট এরূপ কাজকে ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ বহির্ভূত বলে ঘোষণা করে।
Accordingly, in exercise of suo motu power under Article 226 of the Constitution of India, clause 6B,8 and 11 of the circular dated 2-1-2014 issued by the Director General of Police, Stat of Madhya Pradesh, so far as it relates to production of victims and suspects before the media, as well as disclosure of personal information of the suspects to the media or display of their photographs in newspapers or on any digital platform are hereby quashed being violative of Article 21 of the Constitution of India. Further, parading of suspects in general public is also held to be violative of Article 21 of the Constitution of India.(para41).
Kavati Sagar Vs. State of Andhara Pradesh and Ors.2018(6) ALT 291-মামলায় পিটিশনারের বাবাকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের সহযোগিতায় তার ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ভারতের হাইকোর্ট অভিমত প্রকাশ করেন যে, এহেন কাজ “নাগরিকের ব্যক্তিগত সম্মান” এবং “গোপনীয়তার অধিকার” এর লংঘন।
‘The learned Counsel for the petitioner has filed two photographs published in the newspaper showing a woman standing behind the Police hanging her head. Our conscience is deeply disturbed on looking at these photographs as we prima facie feel that the Police have no right to violate the personal dignity of any citizen, be it an accused or a convict. The right to privacy having been recognized as a fundamental right, we are of the prima facie opinion that the Police have no authority whatsoever to parade the suspects in public and allow the press to publish their photographs and electronic channels to telecast such an event.(para-2)
ফলে এভাবে সন্দেহভাজনদের তুলে ধরা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন তুলছেন মানবাধিকার কর্মীরা। হাইকোর্টের আদেশ, মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীদের প্রবল সমালোচনার পরেও আটককৃতদের এভাবে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা কখনোই বন্ধ হয়নি।
এটা বাহিনীগুলো করে থাকে তাদের অ্যাচিভমেন্ট দেখানোর জন্য যে, তারা একটি ভালো কাজ করেছে। দেশের মানুষের জন্য বা সমাজের জন্য সেটা ভালো হবে, আরও পাঁচজন অপরাধে জড়ানো থেকে শিক্ষা নেবে, এ ধরনের একটা চিন্তা থেকে তারা এই কাজ করে থাকতে পারে। যারা আইন প্রয়োগ করবেন, তাদেরকে সবসময় মনে রাখতে হবে যে, তাদের কর্মকাণ্ডগুলো আইনানুগভাবে হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সতর্ক হতে হবে গণমাধ্যমকে।
মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীরা বলছেন, আদালতে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই গণমাধ্যমের সামনে দোষী সাজিয়ে উপস্থাপনের ফলে একজন ব্যক্তি সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে যে ক্ষতির মুখোমুখি হন, পরবর্তীতে আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও সেটা পূরণ করা সম্ভব হয় না।
গণমাধ্যমেও বাহিনীগুলোর বক্তব্য থাকলেও বেশিরভাগ সময় অভিযুক্তদের পক্ষের বক্তব্য থাকে না। তাই তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি গণমাধ্যমকে এসব সংবাদ প্রচারে সতর্ক ভূমিকা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিজ্ঞগণ।
তথ্য কণিকা:
বাংলাদেশ সংবিধান, উকিপিডিয়া, অনলাইন ল পোর্টাল, Law lab, 100 years Criminal Reference on The Penal Code- Advocate Md. Abul kalam Azad, The Penal Code- Advocate Md. Abul kalam Azad,ফৌজদারী কার্যবিধি-জহিরুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য-গাজী শামসুর রহমান।
লেখক: দীপজয় বড়ুয়া; আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।