মামলার পুলিশ সাক্ষীরা (বাদী) আদালতে অনুপস্থিতি ও এফআইআরের সঙ্গে সাক্ষ্যের অমিল হলে শাস্তির মুখে পড়বেন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশের সদর দপ্তর থেকে।
নির্দেশনায় পুলিশ সদস্য ছাড়া মামলার অন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্য দেওয়ার আগে আদালত পরিদর্শকের অধীন কোনো কর্মকর্তাকে মামলা সম্পর্কে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে বলা হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন সূত্র নির্দেশনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
পুলিশের সদর দপ্তর সূত্র বলছে, সাক্ষীর অনুপস্থিতি মামলার নিষ্পত্তি বিলম্বিত করে। তাই বিচার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পুলিশ সদস্যদের যথাসময়ে সাক্ষ্য দিতে সময়ে সময়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে।
আদালত সূত্র বলেছে, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নাশকতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে করা মামলার বাদী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের এই নির্দেশনার পর এমন মামলাগুলোর ধার্য তারিখে আদালতে পুলিশ সাক্ষীসহ অন্য সাক্ষীদের উপস্থিতি বেড়েছে। বিচার কার্যক্রমে এসেছে গতি। এসব মামলার আসামি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নির্দেশনা মামলা নিষ্পত্তিতে গতি সঞ্চার করলেও সাক্ষ্য নির্দিষ্ট করা একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর পেশাদার আচরণ নয়। এতে মামলা প্রভাবিত হওয়ার অনেক সুযোগ থাকে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, গত আগস্টের শেষ সপ্তাহে সদর দপ্তরে পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মামলার সাক্ষ্যপ্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়।
এতে সিদ্ধান্ত হয়, পুলিশ বাদী হয়ে করা মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ সাক্ষীদের (বাদী) আদালতে দেওয়া জবানবন্দি ও মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে (এফআইআর) থাকা ঘটনার বিবরণে পার্থক্য থাকলে সেসব চিহ্নিত করে ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
এ ছাড়া মামলার সাধারণ সাক্ষীদের আদালত পরিদর্শকের অধীনে কোনো কর্মকর্তাকে মামলা সম্পর্কে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে বলা হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, অবশ্য এর ৯ দিন আগে সদর দপ্তরের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড এনআরবি অ্যাফেয়ার্সের এক চিঠিতে আদালতে চলমান মামলাগুলোতে পুলিশ সাক্ষীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিনা কারণে সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখে আদালতে অনুপস্থিত পুলিশ সাক্ষীদের এবং যথাযথ সাক্ষ্য না দেওয়া পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
পুলিশ সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট ইউনিটকে ছাড়পত্র দিতে বলা হয়। কেউ ধার্য তারিখে আদালতে অনুপস্থিত থাকলে তার কারণ জানাতে বলা হয় এবং ওই কারণ অনুসন্ধান করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সূত্র বলেছে, আইজিপির সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ের আলোচনার সিদ্ধান্ত জানিয়ে ৫ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক জেসমিন বেগমের সই করা একটি চিঠি সব পুলিশ কমিশনার ও রেঞ্জ ডিআইজিদের পাঠানো হয়। ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সব ইউনিটেই এমন চিঠি পাঠানো হয়।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) এনামুল হক সাগর বলেন, মামলার বিচারকাজে সাক্ষ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধার্য তারিখে সাক্ষীর অনুপস্থিতি বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত করে। তাই পুলিশ সদস্যদের যথাসময়ে সাক্ষ্য দিতে সময়ে সময়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। এটি পুলিশের রুটিন ওয়ার্ক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশ যদি এভাবে সাক্ষ্য দেয় এবং অন্যদের সাক্ষ্যের বক্তব্য শিখিয়ে দেয়, তাহলে পুরো বিষয়টা পক্ষপাতপূর্ণ ও অপেশাদার আচরণ হয়ে যায়। এভাবে সাক্ষ্য দিলে আইনের যাচাই-বাছাই থাকল না। বিচারিক প্রক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা অতীতেও দেখেছি জাতীয় নির্বাচনের আগে নানা ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যায়। সেখানে কখনো কখনো কোনো দল বা সরকারকে খুশি করার মতো বিষয় থাকে।’
আদালত ও আইনজীবী সূত্র জানায়, সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে ঢাকার আদালতগুলোতে নাশকতার মামলাগুলোর সাক্ষ্য গ্রহণ গতি পেয়েছে। এর কারণ, মামলার বাদী পুলিশ সদস্য ও সাক্ষীরা উপস্থিত থাকছেন। প্রতিদিনই বিভিন্ন আদালতে কয়েকটি মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। আদালতের দিনের কার্যক্রমের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পরও সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।
গত বুধবার একটি নাশকতার মামলায় পুলিশসহ ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। পুলিশ বাদী হয়ে পল্টন থানায় ওই মামলা করেছিল ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর।
বাদী ওই থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শওকত আলী। আসামি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতা-কর্মী। আদালতে বর্তমানে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে থাকা নাশকতার সব মামলার আসামি এই দুই দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী।
আরেকটি থানায় করা নাশকতার একটি মামলায় সাক্ষ্য দিতে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক সদস্য বলেন, তিনি বেশ কয়েকটি মামলার সাক্ষী। নিজে আদালতে হাজির হতে এবং যথাযথ সাক্ষ্য দিতে নির্দেশনা রয়েছে। অন্যথায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় পল্টন থানায় একটি মামলার সাক্ষী এক পুলিশ সদস্য। পরে তিনি অন্য জেলায় বদলি হন। এখন সাক্ষ্য গ্রহণের ধার্য তারিখে তাঁকে ঢাকার আদালতে আসতে হচ্ছে। তিনি বলেন, তাঁকে অভিযোগপত্র অনুযায়ী সাক্ষ্য দিতে বলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, আদালতে রাজনৈতিক মামলাগুলো দেখভালের জন্য একটি তদারকি ব্যবস্থা চালু করেছে পুলিশ। পুলিশ সাক্ষীরা ঠিকমতো আসছেন কি না, তাঁরা কী জবানবন্দি দিচ্ছেন, সেগুলো নজরদারি করছেন পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য এখন সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের মোবাইল ফোনে ডিজিটাল সমন পাঠানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট জিআরও (সাধারণ নিবন্ধন) শাখা থেকে দফায় দফায় ফোন করে ধার্য তারিখে উপস্থিত থাকতে বলা হচ্ছে। পুলিশ সদস্যরাও আসছেন। সাক্ষী ও পুলিশ সদস্য হিসেবে এটা তাঁদের দায়িত্ব।
বিভিন্ন মামলার আসামি বিএনপির নেতা-কর্মীদের আইনজীবীরা জানান, গত বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই দিনে ৪০-৫০টি মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সাজা দিতে মামলাগুলোর গতি বাড়ানো হয়েছে।
তবে বিষয়টি অস্বীকার করে ঢাকা মহানগর পিপি আব্দুল্লাহ আবু বলেন, এই মামলাগুলো দীর্ঘদিনের। সাক্ষীদের প্রতি সমনও জারি হয়েছে অনেক আগে। সমন পেয়েই সাক্ষীরা আদালতে হাজির হচ্ছেন। মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে।
সূত্র: আজকের পত্রিকা