আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক পরিবারের শেয়ার ধারণ এবং পরিচালকের সংখ্যা বেঁধে দিয়ে নতুন আইন করার প্রস্তাবে সায় দিয়েছে সরকার। একইসঙ্গে নতুন আইনে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার (২৩ অক্টোবর) তার কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন, ২০২৩’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
এ আইন সংসদে পাস হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একক ব্যক্তি বা এক পরিবার থেকে ১৫ শতাংশের বেশি শেয়ার নেওয়া যাবে না; একই পরিবার থেকে দুইজনের বেশি পরিচালকও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা যাবে না। সেই সাথে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপি নোটিশ পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে ঋণ শোধ না করলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যাবে।
সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম এখন পরিচালিত হচ্ছে ১৯৯৩ সালের ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, দিয়ে।
“কিন্তু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় এসে নানা রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি। ওই আইনের কিছু দুর্বলতার কারণে এই সেক্টরে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। যে কারণে আইনটিকে হালনাগাদ করে নতুন আইন হচ্ছে।”
“বিদ্যমান আইনে একজন ব্যক্তি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কত শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারবেন এটি বেঁধে দেওয়া ছিল না। নতুন আইনে বলা হচ্ছে, একই পরিবার থেকে ১৫ শতাংশের বেশি শেয়ার নেওয়া যাবে না।”
যাদের কাছে ১৫ শতাংশের বেশি শেয়ার রয়েছে, নতুন আইন কার্যকরের পর থেকে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে ১৫ শতাংশ শেয়ার সমন্বয় করতে হবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
তিনি বলেন, ১৫ শতাংশের অতিরিক্ত শেয়ার পরিবারের সদস্য নয় অথবা যাদের কাছে ১৫ শতাংশের কম শেয়ার রয়েছে তাদের কাছে বিক্রি করা যাবে। দুই বছরের মধ্যে বাড়তি শেয়ার হস্তান্তর না করলে সরকার তা বাজেয়াপ্ত করবে।
বর্তমান আইনে পরিচালকদের সংখ্যা নির্দিষ্ট ছিল না জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, দুইজন স্বতন্ত্র পরিচালকসহ মোট ১৫ জন পরিচালক থাকতে পারবেন।
“তবে একটি পরিবার থেকে তাদের শেয়ারের পরিমাণ ৫ শতাংশের কম হলে একজন পরিচালক থাকবেন। ৫ শতাংশের বেশি হলে সর্বোচ্চ দুইজন থাকতে পারবেন। এক পরিবার থেকে দু্ইজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না।”
মাহবুব হোসেন বলেন, বিদ্যমান আইনে পরিচালকের কোনো মেয়াদ বেঁধে দেওয়া ছিল না। এখন পরিচালকের মেয়াদ তিন বছর করা হচ্ছে। পর পর তিন মেয়াদে পরিচালক থাকতে পারবেন।
নতুন আইনে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা সন্নিবেশিত করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, একজন ব্যক্তিকে তিনটি কারণে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে গণ্য করা যাবে। সামর্থ্য থাকার পরও যদি ঋণ সময়মতো পরিশোধ না করেন; যে কারণ দেখিয়ে ঋণ দিয়েছেন, সেই কারণে ব্যবহার না করে যদি ঋণ অন্য কারণে ব্যবহার করেন এবং যেসব কাগজপত্র জমা দিয়ে ঋণ নিয়েছিলেন পরে সেগুলো যদি ভুয়া বলে চিহ্নিত হয়।
“যখন একজন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হবেন, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের একটা তালিকা রাখবে। তালিকা হওয়ার পর যখন তারা নোটিস পাবেন, সেই নোটিস পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ঋণ গ্রহীতার কাছে তার প্রাপ্য অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ফাইন্যান্স কোম্পানি ক্ষেতমতে উহার পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করবে এবং এরূপ মামলা সংশ্লিষ্ট ঋণ বা অগ্রিম বা পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রে অর্থ ঋণ আদালতের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করবে না। মানে তার বিরুদ্ধে সহসা মামলা করা যাবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছ থেকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির তালিকা প্রস্তুত করতে পারবে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশ ভ্রমণ এবং ট্রেড লাইসেন্সে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ছাড়াও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কাছে কোম্পানি নিবন্ধনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে।
“মানে যখন সে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত থাকবেন, পরবর্তী কোনো বিজনেস করার ক্ষেত্রে অথবা বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপি দুই মাসের মধ্যে ঋণ শোধ না করলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যাবে।”
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “ব্যাংক সাবসিডিয়ারি কোম্পানি তৈরি করতে পারে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাবসিডিয়ারি কোম্পানি করতে পারবে না।”
সুদ মওকুফের বিষয়ে বিদ্যমান আইনে কোনো নির্দেশনা ছিল না। নতুন আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া সুদ মওকুফ করা যাবে না। সম্পূর্ণ সুদ কখনও মওকুফ করা যাবে না। কস্ট অব ফান্ড অবশ্যই আদায় করতে হবে।
নতুন আইনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জরিমানা ও শাস্তি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি বলেন, লাইসেন্সের শর্ত না মানার শাস্তি ১০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা করা হচ্ছে। বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ঋণ দিলে বিদ্যমান আইনে প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হয়। এটিকে সংশোধন করে বলা হয়েছে, ১০ লাখ টাকা বা ছাড়কৃত ঋণের বিদ্যমান স্থিতির মধ্যে যেটি বেশি- সেটি প্রত্যেক পরিচালক ও কর্মকর্তাকে জরিমানা হিসেবে দিতে হবে।
বিদেশিরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার নিতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। কী পরিমাণ শেয়ার বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পাবে তা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করবে। পাশাপাশি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় থাকতে পারবে না।