মশিউর রহমান:
এক.
১৯৪৮ সালে আইন পড়তে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। এ বছরেরই ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের জন্ম হলে বঙ্গবন্ধু এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভোগী কর্মচারীরা অনেক দিন ধরে তাদের দাবি পুরনের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে আসছিল। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ থেকে তারা ধর্মঘট শুরু করে। ছাত্রলীগের সদস্যরা তাদের এ আন্দোলনে সমর্থন ও সহযোগিতা করে। সেদিন সকলে মিলে শোভাযাত্রা বের করলে সেখান থেকে শেখ মুজিব কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে উপাচার্যের সাথে দেখা করে তাকে সব বুঝিয়ে বলেন।
কর্মচারীদের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে! শেখ মুজিবকে ১৫ রুপি জরিমানাসহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে!
পরবর্তী সময়ে কেউ কেউ মুচলেকা দিয়ে ছাত্রজীবন ফিরে পেলেও শেখ মুজিব তাতে রাজি হননি! তার বক্তব্য- ‘আমি কোনো অন্যায় করি নাই, অত্যন্ত ন্যায়সংগত দাবি করেছি। মুচলেকা ও জরিমানা দেওয়ার অর্থ হলো দোষ স্বীকার করে নেওয়া, আমি তা করব না।’
এ ঘটনায় জেরে ৫৪ ধারায় আটক হয়ে তিনি ১৯ এপ্রিল থেকে ২৬ জুন ১৯৪৯ কারাভোগ করেন!
তার আর আইন পড়া হলো না!
দুই.
১৯৫৯ সালে বঙ্গবন্ধু আবার আইন পড়ার ইচ্চা প্রকাশ করেন।
১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের নেতা আতাউর রহমান খান প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে শেখ মুজিবকে বানিজ্য, শ্রম ও শিল্প মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেন।
এরপর ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী টাংগাইলের কাগমারীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে কাউন্সিল সভা ডাকেন। এ সম্মেলনে ভাসানী শেখ মুজিবকে মন্ত্রিত্ব অথবা দলের সাধারণ সম্পাদকের কোনো একটি বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
ভাসানীর পরামর্শে শেখ মুজিব সাথে সাথে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করে দলের দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত তাকে জানিয়ে দেন। এর কিছুদিন পর ৩০ মে তিনি মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। শেখ মুজিবের এ সিদ্ধান্ত পরবর্তী সময়ে জনমনে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়।
১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের ভেতর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্যে এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এতে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী মারাত্মকভাবে মাথায় আঘাত পান এবং তার তিন দিন পর হাসপাতালে মারা যান!
এ প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার আলী মির্জা পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেন। এর মাত্র ২০ দিনের মধ্যেই ইস্কান্দার আলী মির্জাকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক আইয়ুব খান।
আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেই শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির মামলা দায়ের করতে থাকেন। ১৯৫৯ সালের ১২ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করা হয়!
১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আইন পরিষদের ঘটনায় ডেপুটি স্পিকার মারা গেলে তার কারণ বের করার জন্য সরকার একটি ‘অনুসন্ধান কমিটি’ গঠন করেন। কমিটির অফিস ছিল পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের বিল্ডিংয়ে।
আইন পরিষদের ঘটনাস্থলে শেখ মুজিব উপস্থিত থাকার কারনে অনুসন্ধান কমিটি তাকে নোটিশ দেয়, সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য। দুর্নীতির মামলায় আটক অবস্থায় তিনি ৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৯ এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেন।
সাক্ষ্যদান শেষে শেখ মুজিবকে নিয়ে এডভোকেট জহিরুদ্দীন, ইউসুফ আলী চৌধুরী এবং মিয়া আব্দুল হাফিজ এসেম্বলি বিল্ডিংয়ের কেন্টিনে প্রবেশ করেন। সেখানে ইউসুফ আলী চৌধুরী শেখ মুজিবের কাছে জেল জীবনের কথা জানতে চাইলে তিনি মুখ ভার করে তা ‘ভালো নয়’ বলে মন্তব্য করেন।
আলোচনার এসময় তিনি জানান, জেল থেকে ছাড়া পেলে লন্ডনে যেতে চাইবেন বার-এট-ল ডিগ্রির জন্য। তখন জহিরুদ্দীন বলেন, তার লন্ডনে যাওয়া উচিত এবং এ ব্যাপারে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাকে সহযোগিতা করবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন।
এর চারদিন পর, ১০ ফেব্রুয়ারি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও আতাউর রহমান খান শেখ মুজিবকে জেলখানায় দেখতে গেলে তিনি তাদের পুনরায় অনুরোধ করেন, জেল থেকে বের হলে তাকে কোনো চাকরিতে যুক্ত করতে অথবা লন্ডনে পাঠাতে বার-এট-ল ডিগ্রির জন্য। এসময় শেখ মুজিব কিছুটা আবেগপ্রবন হয়ে পড়েন।
বিভিন্ন মামলায় এবং ক্রমাগত বিনা বিচারে আটকের কারনে তার এ আশাও পুরন হয়নি!
বঙ্গবন্ধুর আইন পড়তে চাওয়ার ৭৫ (১৯৪৮ সালের হিসেবে) বছর পরে, এবং তার মৃত্যর ৪৮ বছর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ‘ডক্টর অব ল’ ডিগ্রি প্রদান করেছে! বাবার পক্ষে কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা গ্রহণ করেন।
এ এক অভাবনীয় ঘটনা বটে!
লেখক- মশিউর রহমান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক কার্যকরী সদস্য।
আরও পড়ুন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি পেলেন বঙ্গবন্ধু