সাইফুল ইসলাম পলাশ: বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে সৈয়দ আলীর শরীর। শরীরে ভাজপড়া চামড়ার দাগ স্পষ্ট। জিজ্ঞেস করে জানলাম, বয়স তার বাহাত্তর। কাজ করেন দিনমজুরি। সাথে তার স্ত্রী ষাটোর্ধ রহিমা বিবি। উভয়েই যৌতুকের মামলায় সহযোগী আসামি।
কয়েক দিন আগের ঘটনা বলছি। সেই ঘটনার আগের দিন বিকেলে পুলিশ সৈয়দ আলী ও রহিমা বিবিকে তাদের বাড়ি থেকে ওয়ারেন্টমূলে গ্রেফতার করেছিল। গ্রেফতারের সময় টাকা পয়সা কিছুই নিতে পারেন নি সাথে। তাদের করুণ অবস্থা দেখে কনস্টেবল শফিক দয়াপরবশ হয়ে রাতে থানা হাজতে থাকার সময় নিজের টাকা দিয়ে রুটি ও কলা কিনে দিয়েছেন।
পরের দিন সকালে থানা থেকে আদালতে আসতে আসতে দুপুর ১২ টা বেজে গেছে। আদালতের হাজতখানায় গিয়ে দেখলেন, তাদের মত নানা বয়সের পুরুষ-মহিলা বন্দি কারাগার ও থানা থেকে এসেছে। এদের কেউ বসে আছে, কেউ আইনজীবী বা আইনজীবী সহকারীর সাথে কথা বলছে, কেউবা স্বজনদের সাথে। হৈ চৈ এর মধ্যে সবার এক প্রশ্ন, আজ জামিনটা কী হবে, আর কত দিন চলবে কেসটা?
সৈয়দ আলীর মনে হল, এ যেন এক হাশরের মাঠ। সবাই ইয়া নফছি, ইয়া নফছি করছে। শতাধিক মানুষের ভিড়ে কারো সাথে কারো কথা নেই। হাজতখানায় জোহরের ৪ রাকাত ফরজ নামাজ পড়লেন। কিন্তু কত রাকাত পড়লেন মনে করতে পারছেন না। পুনরায় শুদ্ধ করে নামাজ পড়তে ইচ্ছে হলো না। তার মনে হলো, আগে চাই পেটের খাবার, তারপর ধর্মীয় আচার।
দুপুর ৩.০০ বাজে। সকাল থেকে একটি দানাও পেটে পড়েনি। বন্দিদের কোলাহল এবং নিজ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় সেলফে থাকা শরৎ-বঙ্কিমের উপন্যাস কিংবা ধর্মীয় বইগুলোও টানছে না। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি – আজ সুকান্তের কথাটির উৎকৃষ্ট উদাহরণ তিনি। ডাক পড়েছে সৈয়দ দম্পতির। তাদের হাজতখানা থেকে আদালতে আনা হলো জামিন শুনানীর জন্য। প্রায় বিশ ঘণ্টা আগে থানা হাজতে পাউরুটি-কলা খেয়েছে অন্যের দয়ায়।
২.
সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগর আদালতে এমন সমস্যা নিয়ে একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সৈয়দ দম্পতির মত অনেকে আছেন যারা গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে কারাগারে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নিজস্ব ব্যবস্থাপনা না থাকলে সরকারিভাবে কোনো খাবার পান না। তবে এরূপ সমস্যা শুধু চট্টগ্রামে নয়, সারা বাংলাদেশে। অথচ, আদালতগামী বন্দিদের খাবারের জন্য সরকারী পৃথক বরাদ্দ রয়েছে।
সাধারণতঃ আদালতে দুই শ্রেণির বন্দি আসেন-
১. সদ্য গ্রেফতারকৃত আসামী: এই শ্রেণির বন্দিদের গ্রেফতারের পর থানায় রাখা হয়। আমাদের পবিত্র সংবিধান-এর ৩৩ (২) অনুচ্ছেদ ও ফৌজদারী কার্যবিধির ৬১ ধারানুসারে এই শ্রেণির বন্দিদের ২৪ ঘন্টার মধ্যে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই ২৪ ঘন্টা থানা হাজতে থাকাকালীন খাবারের জন্য সরকারিভাবেই বন্দির খোরাকি ভাতা রয়েছে।
২. হাজতি বন্দি: এই শ্রেণির বন্দিরা পূর্বেই গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আটক আছে এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এই শ্রেণির বন্দিদের মামলার নির্দিষ্ট তারিখে আদালতে উপস্থাপন করতে হয়। তাদের জন্যও উক্ত নির্দিষ্ট তারিখে দুপুরে খাবারের জন্য পৃথক বরাদ্দ রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই বন্দিদের যখন আদালতে আনা হয় তখন তারা সরকারী বরাদ্দের খাবার পাচ্ছে কি না বা পেলেও তা যথাসময়ে পাচ্ছে কি না?
প্রথমেই হাজতি বন্দিদের কথা বলি। যুগের পর যুগ এই বন্দিদের আদালতে হাজিরা দিনে দুপুরে খাবার জন্য চিড়া ও গুড় দেওয়া হত। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এ সংক্রান্তে ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ, কারা শাখা-২ হতে একটি পরিপত্র অনুসারে আদালতগামী বন্দিদের দুপুরের খাবারের পরিবর্তে দৈনিক মাথা পিছু ২৬ টাকা হারে বরাদ্দ প্রদান করা হয়। তৎপ্রেক্ষিতে কারা অধিদপ্তর গত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে একটি সম্পূরক নির্দেশনা দেন যে, বিজ্ঞ আদালতগামী বন্দিদেরকে দৈনিক মাথা পিছু ২৬ টাকা হারে বরাদ্দ বাবদ ১০০ গ্রাম পাউরুটি, ১টি কলা ও ১টি সিদ্ধ ডিম দিতে হবে। তবে বর্তমান এই দুর্মূল্যের বাজারে ২৬ টাকায় এসব পাওয়াও দুরুহ বটে।
রাজশাহীসহ একাধিক জেলায় এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম, আদালতগামী বন্দিদেরকে সকালে প্রিজন ভ্যানে উঠার সময়ে দুপুরের শুকনো খাবারটি প্রদান করা হয়। কিন্তু উক্ত বন্দিরা আদালতে আসার পূর্বেই সকালে সেই খাবারটি খেয়ে ফেলেন। আদালতে তাদের দুপুরের খাবার দেওয়া হয় না। কোর্টের কাজ শেষে ফিরতে ফিরতে তাদের সন্ধ্যা বা রাতও হয়ে যায়। ফলে যেসব বন্দির আত্মীয় স্বজনরা দেখা করতে আসেন না, তাদের সারাদিন ব্যাপি অভূক্তই থাকতে হয়। তাহলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছিল তা পূরণ হচ্ছে না।
৩.
সকালে নাস্তা খাওয়ার পরেও কেন কারাগার থেকে আদালতগামী বন্দিরা দুপুরের খাবার সকালেই খেয়ে নিচ্ছে তা একটি গবেষণার বিষয়। প্রাথমিকভাবে আমি এর তিনটি কারণ পেয়েছি –
১. প্রিজন ভ্যানে খাবার দেওয়ার সময় বন্দিদের যথাযথভাবে ব্রিফ না করা;
২. হাজতখানার ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে সমন্বয় না করা;
৩. আরেকটি অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বন্দিদের সোশ্যাল বিহেভিয়ার। কোনো একজন হাই তুললে যেমন সবাই হাই তোলে, ঠিক তেমনি প্রিজন ভ্যানের বন্দিদের কেউ একজন প্যাকেট খুললে সবাই প্যাকেট খুলে ফেলে। আমাদের মস্তিষ্কের মিরর নিউরন আমাদের শেখায় কী করে অন্যদের অনুকরণ করা যায়।
অন্যদিকে, থানা থেকে প্রেরিত ধৃত আসামীদের অবস্থা আরো শোচনীয়। কোনো আসামী গ্রেফতার হলে থানা হাজতে অবস্থানকালীন ইতিপূর্বে খোরাকি ভাতা বাবদ ৭৫ টাকা করে বরাদ্দ ছিল। পরবর্তীতে গত ২৩ নভেম্বর ২০২১ তারিখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, পুলিশ শাখা-৪ হতে প্রকাশিত পরিপত্র অনুসারে, উক্ত খোরাকি ভাতা অর্থ বিভাগের সম্মতিক্রমে ৭৫ টাকা হতে বৃদ্ধি করে ১৫০ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণে দেখা যায়, থানা হাজতে এক বেলা অবস্থানের জন্য বরাদ্দ ৭৫ টাকা এবং দুই বেলার জন্য ১৫০ টাকা। কারাগারের ২৬ টাকা যেভাবে ব্রেক ডাউন দেওয়া আছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই পরিপত্রে থানা হাজতে অবস্থান কালীন বন্দিদের বরাদ্দ সেভাবে দেওয়া নেই। থানা থেকে প্রেরিত আদালতগামী বন্দিরা উক্ত বরাদ্দ থেকে দুপুরের খাবার পাবে কি না তাও সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। কেননা, আদালতেই উক্ত বন্দিদের ৭/৮ ঘন্টা থাকতে হয়।
প্রকাশিত পত্রিকার খবর অনুসারে চট্টগ্রাম মহানগর হাজতখানায় বর্তমানে ডিম-খিচুরি দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সেখানে সাদা ভাত, মাছ কিংবা মাংস পরিবেশনের পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু একই দেশে একই হাজতখানায় থেকে কেউ (কারাগার থেকে প্রেরিত হাজতি) রুটি, কলা খাবে এবং আবার কেউ (থানা থেকে প্রেরিত ধৃত আসামী) মাংস-ভাত খাবে তা একটি বৈষম্যমূলক আচরণ। উভয় ক্ষেত্রেই বাজেট সমান হওয়া এবং তার বাস্তবায়ন হওয়া আবশ্যক। সব থেকে ভালো হয়, যদি এ বিষয়ে আদালতের একটি পৃথক বরাদ্দ থাকে।
৪.
উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থানা হাজতে অবস্থানকালীন একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলেই খাবার দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থানা হাজতে থাকাকালীন ২৪ ঘন্টার মধ্যে দু’টি হালকা খাবার, একটি প্রধান খাবার এবং চাহিদা মতো পানি সরবারাহ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রেফতার হওয়ার চার ঘন্টা অতিবাহিত হলে খাবারের সময় গ্রেফতারকৃত বন্দিকে খাবারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। যেমন, স্কটল্যান্ডে ধৃত আসামীকে এ ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং তার কোনো খাবারে সমস্যা থাকলে তা পুলিশকে জানানোর সুযোগ দেওয়া হয়।
আমাদের দেশেও সদাশয় সরকারের তরফে বন্দিদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই এই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্দিদের নসিবে তা জোটে না। আমি শতাধিক বন্দির সাথে কথা বলে জেনেছি, তারা অধিকাংশ সময়ই থানায় সরকারী বরাদ্দের সেই খাবার পান নি।
দ্য ইউনাইটেড নেশনস স্ট্যান্ডার্ড মিনিমাম রুলস ফর দি ট্রিটমেন্ট অব প্রিজনার্স অর্থাৎ ম্যান্ডেলার রুলসে দেশের বন্দিদেরকে ভালো পুষ্টিমানের খাবার এবং প্রয়োজন অনুসারে পানি সরবরাহ করার কথা বলা আছে। একইভাবে পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল (পিআরবি)-এর ৪৮৭ বিধিতে যখনই প্রয়োজন পড়বে তখনই বন্দিদের পানি সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে।
উক্ত বিধিতে আরো বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া কোনো খাদ্য সরবরাহ করা যাবে না এবং বন্দিদের নিকট সকল প্রকার খাদ্যদ্রব্য পরিবেশনের পূর্বে অত্যন্ত সর্তকতার সাথে তা পরীক্ষা করতে হবে। বাস্তবে কোনো খাবারই হাজতখানার ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে সমন্বয় করে দেওয়া হচ্ছে না বিধায় কারাগার থেকে আদালতগামী বন্দিরা খাবার পেয়েও সারাদিন অভূক্ত থাকছে। একইভাবে থানা থেকে প্রেরিত আদালতগামী ধৃত হাজতিরা খাবার পাচ্ছে না। তাই উভয় বন্দিদের খাবার হাজতখানার ম্যাজিস্ট্রেটের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পুলিশ, কারাগার ও আদালতের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি ফুড কমিটির মাধ্যমে যথাসময়ে হাজতখানায় পরিবেশন করতে হবে।
৫.
খাদ্যের অধিকার একজন মানুষের সার্বজনীন অধিকার। কোনো ব্যক্তি আটক হলে চলাফেরা ও বাক স্বাধীনতার মত কিছু বিষয় স্থগিত করা হলেও খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ইত্যাদি অধিকারসমূহ বহাল থাকে।
কেউ কোনো অপরাধ করলে বা অপরাধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করলে তাকে আটক করা যেমন রাষ্ট্রের কাজ, তেমনি সেসব আটককৃত বন্দিদের প্রতি মানবিক পরিবেশ নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে ন্যায্য হিস্যা অনুসারে বন্দিদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকটভাবে অনুভূত হচ্ছে। ক্ষুধার জ্বালা একমাত্র ক্ষুধার্ত মানুষই বোঝে।
পুনশ্চ, সৈয়দ দম্পতির জামিন শুনানিকালে নিযুক্ত আইনজীবী জানালেন, তাদের ছেলে ছয় মাস আগেই গার্মেন্টসে কাজ করতে গিয়ে বিয়ে করেছে। ছেলের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। এই বুড়ো-বুড়ির এমনই অবস্থা যে তাদের মামলার ফি তো দূরের কথা, যাতায়াত ভাড়াও নেই। শুনানি শেষে সেদিন সৈয়দ দম্পতির জামিন হয়েছিল। নিশ্চয়ই আদালত থেকে বাড়ী পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সারাদিন অনাহারী থাকা এই দম্পতির বঞ্চনার দায় কে নেবে!
বি:দ্র: সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। চরিত্রগুলোর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।
লেখক: মো: সাইফুল ইসলাম পলাশ, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।