প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

এফআইআরে মানুষের বিকৃত নাম লেখাও মানবাধিকার লঙ্ঘন: প্রধান বিচারপতি

ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্টে (FIR) অনেক সময় নাম বিকৃত করে লেখা হয় উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছেন, যার নাম বিকৃত করা লেখা হয়, এটা ওই ব্যক্তির মানবাধিকার লঙ্ঘন।

আজ শনিবার (১৮ নভেম্বর) দুপুরে ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে মানবাধিকার সুরক্ষায় প্যানেল আইনজীবীদের ভূমিকা শীর্ষক কর্মশালায় তিনি এমন মন্তব্য করেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকার নিয়ে ভুল ধারণা থাকতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মৌলিক অধিকার বিভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মানবাধিকার পৃথিবীর সব দেশেই অভিন্ন। আমাদের দেশে সভা-সমাবেশ করা যেমন মৌলিক অধিকার, পৃথিবীর বহু দেশেই সভা-সমাবেশ করতে দেয় না, যেমন চায়নাতে হয় না। কিন্তু মানবাধিকার প্রশ্নে পৃথিবীর সব দেশেই চিন্তাটা একই থাকা উচিত এবং একই আছে বলে আমি মনে করি।

উপস্থিত আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, কোনো মানুষকে যখন গ্রেফতার করা হয়, তখন তাঁকে থানা হাজতে রাখা হয়। আপনারা কি জানেন এই সময় ওই মানুষটা কি খায়? কোথা থেকে খায়, এর বাজেট কত? তাঁকে যখন আটক করা হল তখন তাঁকে কোথা থেকে খাবার এনে দেওয়া হবে? একজন মানুষ যখন আটক হয় তখন তাঁর খাবারের দায়িত্ব সরকারের। কারণ যেহেতু তিনি সরকারি কাস্টডিতে আছেন। কিন্তু এর জন্য বাজেট আছে কিনা, কত টাকা এর বাজেট?

এ ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, যেহেতু আপনারা জেলা শহরের আইনজীবী, একবার কাছের থানায় গিয়ে খবর নিবেন ওসি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করবেন আজকের যাদের এরেস্ট করলেন এদের খাবারের ব্যবস্থা কিভাবে করলেন? উত্তর হবে বাড়ি থেকে এসেছে। বাড়ি থেকে আসতে পারে কিন্তু কেন আসবে? এ ক্ষেত্রে সরকারের বাজেট কত এটার একটু খোঁজ নেবেন আপনারা।

মানবাধিকার মানে সকল মানুষের অধিকার উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, একটি মানুষকে কোনো অপরাধে গ্রেফতার করা হলে, তাঁকে কোর্টে হাজির করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী বিচার এবং সাজা হবে। কিন্তু কোন মানুষ যদি দীর্ঘ দিন বিনা বিচারে কারাগারে আটক থাকে? যত বড় অপরাধীই হোক কোনো মানুষ যদি ১৪, ১৫ বছর বিনা বিচারে কারাবন্দী থাকে তাহলে কি তাঁর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে না?

মানবাধিকার কর্মী ও কমিশনের দায়িত্ব কিন্তু প্রসিকিউশনের মতো না মন্তব্য করে তিনি বলেন, সকলের অধিকার নিয়ে চিন্তা করা, মানবের অধিকার নিয়ে চিন্তা করা আপনাদের দায়িত্ব। যে মানুষ একিউসড যিনি এখনো আদালত কর্তৃক অপরাধী ঘোষিত হয়নি, দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় কারা অন্তরালে আটক আছে তাঁর ব্যাপারে চিন্তা করা আপনাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

মানবাধিকার কমিশনের সাথে লিগ্যাল এইডের সম্পর্ক আছে এবং থাকা উচিত উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, লিগ্যাল এইড দেশের বিভিন্ন জেলায় এবং সুপ্রিম কোর্টে কাজ করছে। দীর্ঘ দিন যাবত কারাবন্দীদের জেল আপিল করার মতো যাদের আইনজীবী নেই, ২০ বছর, ২২ বছর পর যখন কোর্টে আসে আর জেল আপিল মঞ্জুর হয় তখন অবস্থা কি দাঁড়ায়? ফিরিয়ে দাও আমার ২০ বছর, ২২ বছর! কোথায় গেলো তাঁর জীবনের সেই সময়? এগুলো দেখার দায়িত্ব কিন্তু মানবাধিকার কমিশনেরও। বিষয়গুলো লিগ্যাল এইডের নজরে আসলে তাঁরা সেটা কোর্টে উপস্থাপন করে।

বিনা বিচারে কারাগারে আটককৃতদের সম্পর্কে কমিশনকে তিনি বলেন, আমি মানবাধিকার কমিশনকেও অনুরোধ করব জেলখানা পরিদর্শন করে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে। প্রয়োজনে বিনা বিচারে আটক মানুষের তালিকা করে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে আইনজীবী নিয়োগের ব্যবস্থা করবেন। এটা আপনাদের দায়িত্বের মধ্যে কিছুটা হলেও পড়ে।

বেআইনিভাবে কেউ বর্ডার ক্রস করলে আইনে সাজার বিধান আছে ৬ মাসের কারাদন্ড অথচ তিন বছরেও এসবের বিচার শেষ হয় না, একুশে পদকপ্রাপ্ত মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকনের বর্ডার ডিস্পিউট সম্পর্কিত বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের বেশ কিছু তরুণ আইন শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তাঁদের একটি উদ্যোগ ছিলো এই ধরণের সমস্যা নিরসনে বর্ডার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। অর্থাৎ বর্ডারে যে ক্রাইমগুলো হয় সেগুলোর বিচারের জন্য বর্ডার ট্রাইব্যুনাল নামে একটা ট্রাইব্যুনাল করা যায় কিনা, সে ব্যাপারে সরকার ভাবতে পারে। কারণ এই ধরণের ট্রাইব্যুনাল থাকলে বর্ডারে যে ক্রাইমগুলো হয় সেগুলোর বিচার দ্রুত সময়ে সম্পন্ন হবে বলে আমার মনে হয়।

আইনজীবীদের রাজনৈতিক মতভেদের ঊর্ধ্বে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি বলেন, আপনারা যারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। তারা যদি একে অপরকে শ্রদ্ধা করতে না পারেন। তারা যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন কোনটা অলঙ্ঘন কোনটা বুঝতে না পারেন, তাহলে এ দেশের মানুষের আরও অনেক কষ্ট হবে। আমি আশা করবো সবাই এ বিষয়টি অনুধাবন করবেন। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল যদি না হোন তাহলে বাংলাদেশ কোনোদিনই একটা সুন্দর সমাজ পাবে না।

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি কিছু ঘটনায় চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। রাজনৈতিক নেতার যেমন মানবাধিকার আছে। রাজনৈতিক কর্মীরও মানবাধিকার আছে। রাস্তায় যারা আন্দোলন করে তাদেরও মানবাধিকার আছে। যে রাস্তায় রাজনৈতিক আন্দোলন করবে তারও মানবাধিকার আছে। যে পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে তারও মানবাধিকার আছে। সেও তো মানুষ। এই বিষয়টি আমরা গুলিয়ে ফেলি।

প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, একজন মানুষের যেমন রাস্তায় আন্দোলন করার অধিকার আছে। তিনি যদি অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেন পুলিশের ওপর, আর পুলিশও যদি অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে দুটোই কিন্তু অপরাধ। দুটোই মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে। সম্প্রতি কিছু ঘটনা ঘটেছে। যেখানে মানবধিকারের চরম লঙ্ঘন হয়েছে।

আসামিদের পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরানোর বিষয়ে ওবায়দুল হাসান বলেছেন, অনেক সময় আসামিকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে কোর্টে হাজির করা হয়। আমি যখন হাইকোর্টের বিচারক ছিলাম তখন আমার একটি রায় ছিলো আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরানো যাবে না। কারণ তিনি যেন কোর্টে একজন ফ্রি মানুষ হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। শুধুমাত্র ভয়ংকর আসামিদের আদালতের অনুমতি নিয়ে ডান্ডাবেড়ি পরানোর কথা আমরা একটা রায়ে বলে দিয়েছি। ডান্ডাবেড়ি পরানো না থাকার কারণে কিছুদিন আগে আদালত থেকে আসামিদের পালিয়ে যেতে দেখেছেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, একটা মানুষের নাম ফজলুর রহমান বা ফজলু। কিন্তু এফআইআর এ লেখে কি? ফজলু ওরফে ফজইল্যা! অমুক নারী ডাইল সুন্দরী। এমন অনেক আজেবাজে নাম দিয়ে এফআইআর এ অভিযোগ লেখা হয়। এটা আমার নজরে এলে আমি হাইকোর্টে থাকাকালীন একটা অর্ডার দিয়েছিলাম যে, এই রকম এফআইআর আপনারা রিসিভ করবেন না। কারণ একজন মানুষের যে নাম সেটি পিতা-মাতা প্রদত্ত।

তিনি বলেন, আদালতে এই নামটিকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা তাহলে কিন্তু এই মানুষটিকে সমাজে সেভাবেই চিত্রায়িত করা হচ্ছে! এইটা ওই ব্যক্তির মানবাধিকার লঙ্ঘন। কারণ তাঁর জন্মগত ক্যারেক্টার এইটা ছিলো না, বরং তাঁকে একটি জায়গা থেকে ক্যারেক্টারাইজ করা হয়েছে এভাবে। এই বিষয়ে অর্ডার দিলাম নাম বিকৃত করা যাবে না। পাশাপাশি যিনি এফআইআর লিখেছিলেন সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে কোর্টে তলব করলাম। তিনি এলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম এই নামে এফআইআর লিখলেন কেন? আপনাকে যদি কেউ বিকৃত নামে ডাকে?

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজা। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বিশেষ অতিথি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন ও কমিশনের নিয়োগপ্রাপ্ত ৪ প্যানেল আইনজীবী।

সাধারণ মানুষের বিচারপ্রাপ্তি সহজ ও সুগম করতে মানবাধিকার কমিশন ৬৪ জেলায় ২৫০ জন আইনজীবীর সমন্বয়ে একটি প্যানেল গঠন করা হয়েছে বলে জানান জাতীয় মানবধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এই আইনজীবীরা কমিশনের পক্ষে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার অসহায় ও দরিদ্র ভুক্তভোগীদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদান করছে।

এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন— সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রব্বানী, হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মুন্সী মো. মশিয়ার রহমান, আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ সাইফুর রহমান প্রমুখ।