মোঃ রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী: দেশের চলমান পরিস্থিতিতে বাড়তি নিরাপত্তার জন্য সারাদেশে তৎপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সন্দেহভাজনকে যেকোনো মুহূর্তেই তারা আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারে। তখন গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির করণীয় কী? গ্রেফতার ও আটক অবস্থায় এ সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী নাগরিক অধিকার ও পুলিশের কর্তব্য নির্ধারিত হয়। কোনো ব্যক্তি গ্রেফতার হলে তার কিছু আইনগত অধিকারের নিশ্চয়তা বাংলাদেশের সংবিধান ও বিদ্যমান বিভিন্ন আইনে বলা আছে। কোন কোন পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তি গ্রেফতার হতে পারেন বা গ্রেফতারের আগে ও পরে তার আইনগত কী কী অধিকার রয়েছে সে সম্পর্কেও বিস্তারিত বলা আছে। সেসব ভিন্ন আলোচনা। এই লেখায় একজন গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির সতর্কতা ও করণীয় সম্পর্কে কিছু পরামর্শ ব্যক্ত করছি;
এধরনের পরিস্থিতিতে অহেতুক পুলিশি হয়রানি থেকে মুক্ত থাকার জন্য প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নিজের পেশাগত পরিচয়পত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে হবে। পুলিশের কাছে সঠিক নাম, ঠিকানা ও পেশাসহ পরিচয় তুলে ধরতে হবে। নিজের সঠিক নাম-ঠিকানা ছাড়া পুলিশের কাছে অন্য কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে একজন গ্রেপ্তার ব্যক্তি আইনত বাধ্য নয়। বাধ্য না থাকার এ অধিকার একজন গ্রেপ্তার ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত।
যদি গ্রেপ্তার বা আটক করে তাহলে একজন নাগরিক হিসেবে প্রথমেই গ্রেপ্তার ব্যক্তির জানার অধিকার রয়েছে কেন, কী কারণে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বা সুনির্দিষ্ট অভিযোগটি কী? আর তাদের কাছে গ্রেফতার সংক্রান্ত কোনো পরোয়ানা আছে কি না? গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারন জানাতে এবং প্রয়োজনে ওয়ারেন্ট (যদি থাকে) দেখাতে পুলিশ বাধ্য। যদি তারা নাগরিককে পরোয়ানা দেখাতে সক্ষম না হন, তাহলে বুঝতে হবে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় আটক করতে পারে (ধারা ৫৪)। সেই সঙ্গে যে পুলিশ কর্মকর্তা প্রশ্ন করেন, তার পরিচয় জানার অধিকার গ্রেপ্তার ব্যক্তির থাকবে। এই ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তি অবশ্যই আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তাদের পরিচয় জানতে চাইতে এবং তাদের পরিচয়পত্র দেখতে চাইতে পারেন।
আরও পড়ুন: বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ও আটক – এক ভয়ানক গণ আতংক
এছাড়া গ্রেপ্তার ব্যক্তির চেনাজানা দায়িত্বশীল ব্যক্তির নাম, ফোন নম্বর ও ঠিকানা সঙ্গে রাখলে অন্তত আত্মীয় বা বন্ধুকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি দ্রুত জানান। পরিচিত কোন আইনজীবীর ফোন নম্বর সাথে রাখতে পারেন এবং গ্রেপ্তারের পর দ্রুত আইনজীবীকেও বিষয়টি জানাবার চেষ্টা করুন। পুলিশ যদি আপনাকে ধরে নিয়ে যায় আপনি সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অথবা ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলুন। সেখানেও যদি কোনো প্রকার সহযোগিতা না পান তাহলে আদালতে হাজির করার পর বিচারকের কাছে লিখিত ও মৌখিকভাবে অভিযোগ করতে পারেন।
গ্রেপ্তারের পর কাউকে লকআপে রাখার আগে তাঁর বিভিন্ন জিনিসপত্র যেমন, কাগজ, মোবাইল ফোনসেট, টাকা-পয়সা ও ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি থাকলে তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়। তবে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার সেগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে আটককৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর নেন। এই স্বাক্ষর দেওয়ার সময় তালিকাটি অবশ্যই পড়ে নেওয়া উচিত। পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেপ্তার ব্যক্তির বিবৃতি আদায়ের জন্য ভয়ভীতি বা প্রলোভন প্রদর্শন করতে পারেন। এসব বিষয় গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে।
আরও পড়ুন: গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির আইনগত অধিকার
লক্ষণীয় হচ্ছে পুলিশের কাছে কোনো প্রকার বিভ্রান্তমূলক ভুল ও মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা যাবে না, যা তদন্তে বাধা সৃষ্টি করে। আপনি যদি পুলিশ কর্মকর্তার কাছে কোনো জবানবন্দি দেন তাহলে সেটির লিখিতরূপ ভালোভাবে পড়ে স্বাক্ষর করবেন। গ্রেপ্তারের পর আইনজীবী বা পরিবারের কাউকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানাতে না পারলে আদালতে হাজির করার পর ম্যাজিস্ট্রেটকে সরাসরি বিষয়টি জানানো উচিত। এতে আইনি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আটক হওয়ার পর পুলিশ কর্মকর্তার কাছে দেওয়া বিবৃতি বা স্বীকারোক্তি সাধারণত সাক্ষ্য আইন অনুসারে আদালতে প্রমাণ করা যায় না।
তবে উক্ত আইনে বলা আছে, পুলিশের কাছে দেওয়া বিবৃতি বা স্বীকারোক্তি করার পর সেই বিবৃতি বা স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে কোনো আলামত উদ্ধার করা হলে তা আদালতে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। সে জন্য পুলিশের কাছে বিবৃতি বা স্বীকারোক্তি বা কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। গ্রেপ্তারের পর কোনো পর্যায়ে নির্যাতনের শিকার হলে বা অসুস্থ্য হলে আদালতের মাধ্যমে বা নিজ উদ্যোগে মেডিকেল পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারবেন। পরীক্ষা করালে এই প্রতিবেদনটি সংগ্রহে রাখবেন। পরীক্ষক চিকিৎসকের পরিচয় জেনে রাখা উচিত কারণ তা পরে প্রয়োজন হতে পারে।
আরও পড়ুন: তল্লাশী ও আটকে নাগরিক অধিকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর করণীয়
পুরনো কোনো মামলায় গ্রেপ্তার হলে দ্রুত ওই মামলার নম্বরসহ কাগজপত্র নিয়ে আইনজীবির মাধ্যমে আদালতে গিয়ে জামিন শুনানির চেষ্টা করা যেতে পারে। নতুন কোনো মামলায় বা কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার হলে একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে জামিন শুনানির চেষ্টা করতে পারেন। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী পুলিশ গ্রেফতারকৃতকে তার পছন্দমত আইনজীবী বা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে বা দেখা করতে দিবেন।
উল্লেখিত বিষয়গুলোর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় বাংলাদেশের সব নাগরিকের জেনে রাখা উচিত, তা হচ্ছে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার বা আটক করতে এলে এবং পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের পরিচয় নিয়ে কোনো সন্দেহের উদ্রেক হলে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ ফোন করে সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া। পুলিশ কর্মকর্তার প্রতি সন্দেহ দূর করার জন্য গ্রেপ্তারকারী কর্মকর্তা যদি নির্দিষ্ট করে কোনো থানা বা জোনের নাম উল্লেখ করেন, তাহলে সেখানেও ফোন করে বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যেতে পারে। আইন অনুযায়ী, একজন পুলিশ অফিসার অন্যায়ভাবে একজন ব্যক্তিকে যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি এবং প্রকৃত বিশ্বাসযোগ্য কারন ছাড়া গ্রেপ্তার করতে পারেন না এবং করলে অপরাধ সংঘটিত করে, যা শাস্তিযোগ্য। মনে রাখতে হবে, জনসচেতনতাই আইনবান্ধব সমাজ নির্মাণের মূল ভিত্তি।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।