মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : কক্সবাজার-ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেনের টিকেট পাওয়া নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টির বিষয়ে তদন্ত করে আদালতে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে র্যাব-১৫ কে নির্দেশ দিয়েছেন কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নম্বর-১ এর বিচারক শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গা।
রোববার (১৭ ডিসেম্বর) সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গা স্ব প্রণোদিত হয়ে এ বিষয়ে একটি মামলা দায়ের করে এ আদেশ দেন। যার মিস মামলা নম্বর : ০৩/২০২৩ (সদর)।
সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ শফি ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
গত ৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে এসে কক্সবাজার-দোহাজারী রেললাইন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। গত ১ ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজার-ঢাকা-কক্সবাজার রুটে নিয়মিত ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
প্রতিদিন এ রুটে চলাচলকারী ট্রেনে প্রায় ৯ শত যাত্রীর সীট রয়েছে। কিন্তু অনলাইন কিংবা কাউন্টারে গিয়ে ট্রেনটির কোন টিকেট পাওয়া যায়না। প্রায় ৯৯% ভাগ ট্রেনের টিকেট কালোবাজারীদের কাছে চলে যায়। যাত্রীদের দ্বিগুনেরও বেশি দাম দিয়ে কালোবাজারিদের কাছ থেকে টিকেট কিনতে হয়।
এ রুটের ট্রেনের টিকেট এখন অনেকটা সোনার হরিণের মতো। অনলাইনে ট্রেনের টিকেট ছাড়ার ২/৩ মিনিটের মধ্যে টিকেট শেষ হয়ে যায়। প্রতিদিন কক্সবাজার ট্রেন স্টেশনের কাউন্টারে শত শত মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েও সর্বসাকুল্যে সর্বোচ্চ ৫/৬ টির বেশি টিকেট পাননা।
টিকেটের জন্য দীর্ঘক্ষন লাইনে দাঁড়ানো লোকজন টিকেট নাপেয়ে নিরাশ হয়ে ফেরত আসে। কক্সবাজারে ট্রেন লাইন চালু হওয়ার পর পরই টিকেট নিয়ে এরকম অরাজকতা সৃষ্টি হওয়ায় তা নিয়ে সর্বত্র চলছে সমালোচনা। যা পর্যটন নগরী কক্সবাজারের জন্য সুখকর নয়।
কক্সবাজার-ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেন রুটের টিকেট নিয়ে এরকম অরাজকতা ও ভোগান্তির বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এই রুটের ট্রেনের টিকেট কালোবাজারিদের হাতে চলে যাওয়ায় টিকেট পেতে সাধারণ নাগরিকেরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে আদালতের কাছে প্রতিয়মান হয়।
আদালতের আদেশে উল্লেখ করা হয়, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ১৯০(১)(সি) ধারায় আমলে নেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট বিজ্ঞ বিচারক শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গা’র নজরে আসে।
এ বিষয়ে স্ব প্রণোদিত হয়ে বিচারকের দায়ের করা মামলার আদেশে আরো বলা হয়, গণমাধ্যমে বর্ণিত ঘটনা ১৯৭৪ সালের দি স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্টের ২৫ ধারায় অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে মর্মে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে অপরাধ সমুহ সুনির্দিষ্টভাবে আর কার কার দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে, তাদের বিস্তারিত নাম, ঠিকানা প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট নয়। সাক্ষীদের নাম, ঠিকানাও প্রতিবেদনে নাই।
অপরাধটি কাদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে, তা প্রাথমিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে আসামীদের সনাক্ত করা প্রয়োজন। তাছাড়া, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে নাম আসা টিকেট কালোবাজারিতে অভিযুক্ত “সহজ ডটকম” এর কর্মকর্তা, কর্মচারী এ ব্যাপারে জড়িত আছে কিনা, সে বিষয়েও তদন্তের মাধ্যমে আসামীদের সনাক্ত করা প্রয়োজন।
এ অবস্থায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবেদক সহ অপরাপর সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ ও তদন্তের অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এ বিষয়ে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বিজ্ঞ বিচারক শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গা র্যাব-১৫ এর অধিনায়ককে নির্দেশ দিয়েছেন।
বিজ্ঞ বিচারকের নির্দেশ মতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য আদেশের কপি কক্সবাজারস্থ র্যাব-১৫ এর অধিনায়কের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে বলে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ শফি জানিয়েছেন।
তিনি আরো জানান, বিজ্ঞ বিচারকের আদেশের কপি কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ শাহীন উদ্দিন, কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মামুন এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। র্যাব-১৫ থেকে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তির জন্য আগামী ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি পরবর্তী ধার্যদিন নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে, কক্সবাজার-ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেনের টিকেট পাওয়া নিয়ে জনসাধারণের ভোগান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টির বিষয়ে কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গা’র স্ব প্রণোদিত হয়ে করা মামলাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির চেয়ারম্যান ও কক্সবাজার চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা।
কক্সবাজার রুটের ট্রেনের টিকেট পেতে তিনি নিজেও ভোগান্তির শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, শুধু আইনি পদক্ষেপ নয়, সংশ্লিষ্ট সকলকেও এ বিষয়ে আরো দায়িত্বশীল ও সচেতন হতে হবে।
হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ কক্সবাজার জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট দীপংকর বড়ুয়া পিন্টু আদালতের এ আদেশকে একটি জনহিতকর আদেশ হিসাবে উল্লেখ করে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, বিজ্ঞ বিচারক শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গা’র স্ব প্রণোদিত হয়ে দায়েরকৃত মামলা যথাযথ তদন্ত হলে ট্রেনের টিকেট পেতে কিছুটা হলেও জন ভোগান্তি লাঘব হবে। ট্রেনের টিকেট নিয়ে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট অরাজকতা বন্ধ হবে। টিকেট কালোবাজারিদের কাছে একটা ম্যাসেজ যাবে। পর্যটক ও নাগরিকেরা রাষ্ট্রের বাহন ট্রেনে সহজে যাতায়াতের সুযোগ পাবে।
কক্সবাজারের জনস্বার্থ নিয়ে কাজ করা “আমরা কক্সবাজারবাসী” সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন আদালতের আদেশকে একটি সময়োপযোগী ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট আদেশ হিসাবে উল্লেখ করে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, টিকেট কালোবাজারিরা স্বপ্নের রেল যাত্রা ও পর্যটন শিল্পের বিকাশকে ব্যাহত করছে। পর্যটকদের যাতায়াতে বাঁধা সৃষ্টি করছে। অথচ সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে এ রেল লাইন নির্মাণ করেছে। কতিপয় কালোবাজারির কারণে জনসাধারণ এর সুফল ভোগ করতে পারছেন না। যা খুবই দুর্ভাগযজনক। তারমতে, ট্রেনের টিকেট সবার জন্য সহজলভ্য করতে রেল কর্তৃপক্ষকেই আরো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে।
কক্সবাজার ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন (টুয়াক) এর নেতা ও বিশিষ্ট পর্যটন উদ্যোক্তা হোসাইনুল ইসলাম বাহাদুর আদালতের আদেশকে সাধুবাদ জানিয়ে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫২ বছর পর কক্সবাজার যাতায়াতে ট্রেন লাইন চালু হওয়ায় পর্যটক, কক্সবাজারবাসী ও পর্যটন শিল্পে জড়িতরা নতুন স্বপ্ন দেখছিলো। কিন্তু ট্রেনের টিকেট কালোবাজারির কারণে কক্সবাজার পর্যটনশিল্পে কিছুটা বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। টিকেট পেতে আগ্রহীদের ভোগান্তির সীমা নেই। যা কারো জন্য সুখকর নয়।
তিনি বলেন, পর্যটন শিল্পের বিকাশে রেললাইন ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। তাই আইন আদালতের কার্যক্রমের পাশাপাশি দেশের ও কক্সবাজারের বৃহত্তর স্বার্থে রেল কর্তৃপক্ষ সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে দেশপ্রেম নিয়ে আরো দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য তরুণ পর্যটন ব্যবসায়ী হোসাইনুল ইসলাম বাহাদুর আহবান জানিয়েছেন।