একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনে গণমাধ্যম কতটা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। এসময় তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে মহান মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট বলেও অবিহিত করেন।
আজ রোববার (২৪ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক আয়োজিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলী শব্দসৈনিকদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মিলনায়তনে এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুল হাসান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ দিনের পর দিন রাতের পর রাত জীবন বিপন্ন করে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন আর তাঁদের সেই বীরত্বগাথার খবর দেশে ও বর্হিবিশ্বে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের। এই বেতার কেন্দ্র হতে প্রচারিত সংবাদ, সঙ্গীত, কবিতা, নাটক, কথিকা, ভাষণ একদিকে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছে, তেমনি বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই চরম সংকটময় মুহূর্তে স্বাধীন বাংলা বেতারের সরব উপস্থিতি ছিলো নব উদ্যমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার এবং মনোবল না হারানোর দৃপ্ত অনুপ্রেরণার উৎস।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আন্তর্জাতিক আইনে একটি ভূখণ্ডের Right of self-determination এর আইনগত ভিত্তি নিরূপণে সংগ্রামরত ঐ জাতিরাষ্ট্রের নিজস্ব সরকার গঠন, সরকার পরিচালনা, ঐ সরকারের বৈদেশিক নীতিসহ বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে উক্ত সরকারের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এক্ষেত্রে গৌরবময় ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে, পাকিস্তানী সামরিক জান্তার নির্লজ্জ মিথ্যাচারের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের বিভিন্ন বক্তব্য, বিবৃতি, আহ্বান প্রচারসহ বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নজিরবিহীন বর্বরতার প্রকৃত চিত্র সারা বিশ্বে তুলে ধরে আন্তর্জাতিক আইনের চোখে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশ্বজনমত তৈরিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাই আইনের একজন ছাত্র হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রমসমূহ আমার কাছে ভিন্ন রকমের তাৎপর্য বহন করে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাঁদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে- আপনারা আপনাদের গবেষণায় এই বিষয়টি তুলে ধরবেন।
তিনি বলেন, এ কথা অনস্বীকার্য যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সৃষ্টি হওয়াতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনেক সংগঠিত ও গতিশীল হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ সেদিন জেনেছিলো স্বাধীনতা ব্যতীত বাঙালির মুক্তির বিকল্প পথ নেই। মুক্তিযুদ্ধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মুক্তিকামী বাঙালি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিকদের গানে, কবিতায় ও বক্তৃতায়। মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ে তাঁরা জীবন বাজি রেখে তাঁদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে সামিল হতে অনুপ্রাণিত করেছেন। পাকিস্তানের শক্তিশালী প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে এক অসম প্রচারযুদ্ধে নিয়োজিত হয়ে সীমিত সুযোগ সুবিধা নিয়ে কেবল অদম্য মনোবলকে সঙ্গী করে নতুন একটি যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদেরকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন আমাদের এই নির্ভীক শব্দসৈনিকগণ। তাইতো আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিলো মহান মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট।
প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে অবাধ তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে আমরা একটি সাংস্কৃতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সুস্থ ধারার বাঙালি সংস্কৃতি তাই আজ হুমকির সম্মুখীন। তাই তরুণ প্রজন্মের শিল্পদের প্রতিয়ামার আহ্বান থাকবে – মহান মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিকগণ শিল্পের মাধ্যমে দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিজেদেরকে নিয়োজিত করার যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সকল প্রকার আগ্রাসন, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসকে প্রতিহত করে অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস হতে দেশকে মুক্ত রাখতে প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান হতে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করুন। আমার প্রত্যাশা থাকবে মহান মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিকদের দেখানো পথ ধরে আমাদের তরুণ প্রজন্ম আগামী দিনগুলোতে সুস্থ বাঙালি সংস্কৃতির মর্যাদা বৃদ্ধি করবে। তবেই আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলী শব্দসৈনিকদের আত্মত্যাগ সফল হবে।