দীপজয় বড়ুয়া: সাধারণ অর্থে যখন কোন ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে বা খুন হলে কিংবা কোন দুর্ঘটনায় মারা গেলে পুলিশ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক যে রিপোর্ট লিপিবদ্ধ করা হয় তাকে Inquest report বা সুরতহাল রিপোর্ট বলা হয়। ব্যাপক অর্থে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭৪ ধারা ও PRB (Police Regulations Bengal) RULE 299 অনুযায়ী (১) কোন থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার বা তদুদ্দেশ্যে সরকার দ্বারা বিশেষভাবে ক্ষমতাবান অন্য কোন পুলিশ অফিসার যদি খবর পান যে, কোন লোক-
(ক) আত্মহত্যা করেছেন অথবা
(খ) অন্য লোকের দ্বারা বা কোন প্রাণী দ্বারা বা কোন যন্ত্রে বা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে অথবা
(গ) এরূপ অবস্থায় মারা গেছে যার ফলে যুক্তিসংগতভাবে সন্দেহ হতে পারে যে, অন্য কোন ব্যক্তি কোন অপরাধ করেছে,
উক্ত পুলিশ অফিসার তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সুরতহাল তদন্তের জন্য ক্ষমতাবান নিকটতম নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে উহা জানাবেন এবং সরকারের নির্ধারিত কোন নিয়ম অথবা কোন সাধারণ বা বিশেষ আদেশ কর্তৃক অন্যরূপ নির্দেশিত না হয়ে থাকলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যেখানে উক্তরূপে মৃত লোকের লাশ রয়েছে, সেই স্থানে গমন করবেন এবং সেখানে স্থানীয় দুই বা ততোধিক সম্ভ্রান্ত লোকের উপস্থিতিতে তদন্ত চালাবেন এবং মৃত লোকের দেহে প্রাপ্ত জখম, অস্থিভঙ্গ, থেঁতলিয়ে যাওয়া এবং অন্য জখমের চিহ্ন সম্পর্কে বর্ণনা করে এবং যে উপায়ে বা যে অস্ত্র বা যন্ত্র (যদি থাকে) দ্বারা উক্ত চিহ্নের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়, তার উল্লেখ করে মৃত্যুর দৃশ্যমান কারণ সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করবেন।” {২০০৭ সনের ২নং অধ্যাদেশ দ্বারা সংশোধিত}। তবে শর্ত থাকে যে,
(১) সরকার অন্যভাবে নির্দেশ না দিলে যেক্ষেত্রে শত্রুর কার্যের দ্বারা কোন লোকের মৃত্যু ঘটে সেক্ষেত্রে এই উপধারা অনুযায়ী কোন তদন্ত করতে বা রিপোর্ট প্রস্তুত করতে বা সুরতহাল তদন্ত করতে ক্ষমতাবান ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করার প্রয়োজন হবে না।
(২) উক্ত পুলিশ অফিসার ও উপস্থিত লোকদের অথবা তাদের মধ্যে যারা রিপোর্টের বর্ণনা সম্পর্কে একমত হন, তারা রিপোর্টে স্বাক্ষর দান করবেন এবং উহা সঙ্গে সঙ্গে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করতে হবে। [২০০৭ সনের ২নং অধ্যাদেশ দ্বারা সংশোধিত)
(৩) মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে অথবা অন্য কোন কারণে পুলিশ কর্মকর্তা উক্তরূপ কার্য করা প্রয়োজনীয় ও সমীচীন বলে বিবেচনা করলে তিনি এই সম্পর্কে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত নিয়ম সাপেক্ষে ময়না তদন্তের জন্য লাশটি নিকটতম সিভিল সার্জন বা সরকার দ্বারা এই উদ্দেশ্যে নিযুক্ত অন্য কোন যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসকের নিকট প্রেরণ করবেন, তবে আবহাওয়ার অবস্থা ও দূরত্বের জন্য লাশটি যদি রাস্তায় পঁচে যাওয়ার আশংকা থাকে যার ফলে ময়না তদন্ত অর্থহীন হয়ে পড়বে, তাহলে উহা প্রেরণ করার প্রয়োজন নাই।
(৪) এই উপধারাটি ১৯৪৯ সালের আইন দ্বারা বাতিল করা হয়েছে।
(৫) নিম্নলিখিত ম্যাজিস্টেটগণ সুরতহাল তদন্ত পরিচালনা করতে ক্ষমতাবান যথা- যে কোন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকার বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক এই বিষয়ে বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্য কোন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। [২০০৭ সালের ২নং অধ্যাদেশ দ্বারা প্রতিস্থাপিত।।
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭৬ ধারা মোতাবেক, (১) কোন লোক পুলিশের হেফাজতে থাকাকালে মারা গেলে সুরতহাল তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসম্পন্ন নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্যই মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে পুলিশ অফিসার দ্বারা তদন্ত ব্যতীতও অথবা এইরূপ তদন্তের অতিরিক্ত তদন্ত করবেন এবং ১৭৪ ধারার
(১) উপধারার (ক), (খ) ও (গ) অনুচ্ছেদে বর্ণিত অন্যান্য ক্ষেত্রে উক্তরূপে ক্ষমতাবান যে কোন ম্যাজিস্ট্রেট মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে পুলিশ অফিসার দ্বারা তদন্ত ব্যতীতও অথবা এইরূপ তদন্তের অতিরিক্ত তদন্ত করতে পারবেন এবং তিনি যদি এইরূপ করেন, তাহলে কোন অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে তার যেরূপ ক্ষমতা থাকবে, এক্ষেত্রেও তার সেরূপ ক্ষমতা থাকবে। এরূপ তদন্ত পরিচালনার সময় ম্যাজিস্ট্রেট অবস্থা অনুযায়ী অতঃপর উল্লেখিত পদ্ধতিসমূহের যে কোন একটি পদ্ধতিতে গৃহীত সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করবেন।
(২) কবর হতে লাশ তুলার ক্ষমতাঃ যে লাশ ইতিমধ্যে কবরস্থ করা হয়েছে, উক্ত ম্যাজিস্ট্রেট যদি মৃত্যুর কারণ আবিষ্কারের জন্য তা পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন, তাহলে তিনি লাশটি কবর হতে তুলার এবং উহা পরীক্ষা করে দেখার ব্যবস্থা করতে পারেন।
যে বিষয় গুলো সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ থাকবে তা নিচে দেয়া হলে
১. প্রথমেই সূত্র উল্লেখ করতে হবে।
২. প্রস্তুতের তারিখ ও সময় উল্লেখ থাকতে হবে।
৩. ঘটনাস্থলের বর্ণনা থাকতে হবে।
৪. মৃত ব্যক্তির, ধর্ম,লিঙ্গ, নাম বয়স ও পূর্ণ ঠিকানা থাকতে হবে।
৫. তিনজন সাক্ষীদের নাম ও পূর্ণ ঠিকানা।
৬. মৃত ব্যক্তি মহিলা হলে,মহিলা দ্বারা পরীক্ষা করতে হবে ও ঐ পরীক্ষাকারীর নাম ও পূর্ণ ঠিকানা।
৭. মৃতের শরিরে পোশাক আছে বা নাই এবং কি ধরনের পোশাক তার বর্ণনা থাকতে হবে।
৮. মৃতের শরীরে থাকা সকল বস্তু ও দ্রব্যাদির বর্ণনা উল্লেখ করতে হবে।
৯. শরীরের প্রাকৃতিক ও বর্তমানের আঘাত ও ক্ষতের বর্ণনা করতে হবে।
১০. মৃত্যুর সম্ভবত কারন সম্পর্কে বর্ণনা করতে হবে।
১১. প্রস্তুতকারী অফিসারের মন্তব্য।
১২. সাক্ষীগণদের স্বাক্ষর নিতে হবে
১৩. প্রস্তুতকারী অফিসারের স্বাক্ষর , নাম,পদবী ,কর্মস্থলের বর্ণনা উল্লেখ করতে হবে।
সুরতহাল রিপোর্টের গুরুত্ব সম্পর্কে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্ত নিম্নে উল্লেখ করা হল
AIR 1978(SC) 1558 Rameshor Dayal Vs The State of U.P মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ঘটনাস্থলে/সংশ্লিষ্ট স্থানে মৃতদেহে তদন্তকারী কর্মকর্তা/পুলিশ কর্মকর্তা যা কিছু প্রকৃতপক্ষে পর্যবেক্ষণ করবেন বা দেখতে পাবেন, তা-ই সুরতহাল প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ করবেন এবং এটাই সাক্ষ্য আইনের ৬০ ধারার বিধান অনুযায়ী প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য। উল্লেখ্য যে, মৃতদেহের অবস্থান, অবস্থা, প্রাপ্ত জখম প্রভৃতিই লিপিবদ্ধযোগ্য। কিন্তু অন্যান্য বক্তব্য যেমন- সাক্ষীর বিবৃতি বা মতামত, মৃত্যুর কারণ, জখম সম্পর্কে মন্তব্য আইনত অগ্রহণযোগ্য ।
AIR 1975(SC)1252 Poddha Narayan Vs The State of Arunachal মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৪ ধারার বিধান অনুসারে পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। কোনো ব্যক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন যা সন্দেহজনক অথবা অস্বাভাবিক। এই অবস্থাটা ব্যক্ত করাই সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতের উদ্দেশ্য। কিন্তু মৃত ব্যক্তিকে কিভাবে আঘাত করা হয়েছে অথবা কে তাকে আঘাত করেছে অথবা কি অবস্থায় তাকে আঘাত করা হয়েছে, তা সুরতহাল প্রতিবেদনে লেখা যাবে না এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৪ ধারার বিধান অনুসারে দুই বা ততোধিক গণ্যমান্য প্রতিবেশী/নিকটবর্তী ব্যক্তির উপস্থিতিতে এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে যাতে জখম, হাড়ভাঙ্গা বা অন্য কোনো জখমের চিহ্ন প্রভৃতি পৃথকভাবে উল্লেখপূর্বক কি ধরনের অস্ত্র দ্বারা কি ধরনের জখম করা হয়েছে তা বর্ণনা করা যাবে”।
14 BLC(AD) 2009(161) Sayed Nurul Aazim Babor VS. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “সুরতহাল প্রতিবেদনে বর্ণিত জখমের অস্তিত্ব এবং মৃত্যুর কারণ সাক্ষ্য নয় এবং এক্ষেত্রে ময়না তদন্তকারী ডাক্তারের সাক্ষ্যই প্রাধান্য পাবে”।
BLD 1990(AD)25 Shah Alam Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “সুরতহাল প্রতিবেদনে প্রসিকিউশনের মামলার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিনা তা দেখাবার জন্য এটাকে ব্যবহার করার অধিকার আসামির রয়েছে। সুতরাং তদন্তকারী কর্মকর্তাকে যথাযথ সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতকরণে যত্নবান হতে হবে”।
3 LNJ(AD)(2014) 110 Siddiqur Rahman & others Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “যদিও আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত উক্তি হচ্ছে, সুরতহাল প্রতিবেদনের বক্তব্যকে সাক্ষ্য হিসেবে অভিহিত করা যাবে না, অন্য কথায় সুরতহাল প্রতিবেদনকে বস্তুনিষ্ঠ সাক্ষ্য গণ্য করা যাবে না, তথাপি তা সাক্ষীদের সত্যপরায়ণতা ও আসামির দোষ-স্বীকারোক্তির সত্যতা যাচাই করার জন্য দেখা যাবে”।
অতএব বলা যায় যে, যদি কোন ব্যক্তি আত্মহত্যায়,খুন,দূর্ঘটনায় বা অস্বাভাবিকভাবে প্রাকৃতিক নিয়মের বাহিরে মৃত্যুবরণ করেন, তবে তার মৃতদেহের সমস্ত বর্ণনা উল্লেখ করে পুলিশ অফিসার বা ম্যাজিস্ট্রেট যে রিপোর্ট প্রস্তুত করেন তাকেই সুরতহাল রিপোর্ট বলে।
লেখক: অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।
তথ্যসূত্র
ফৌজদারী কার্যবিধি-জহিরুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধি- মুহাম্মদ সাইফুল আলম, ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য-গাজী শামসুর রহমান, শতাধিক বছরের ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্স-এডভোকেট কামালউদ্দিন, ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্স- জীবরুল হাসান, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং ম্যাজিষ্ট্রেটের করণীয়- বিচারপতি মোঃ আজিজুল হক, Section Wise 100 years Reference on Crpc, Section Wise 100 years Reference on Penal Code- Md. Abul Kalam Azad।