নবীন আইনজীবীদেরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছেন, সর্বশেষ আইন সম্পর্কে নিজেকে ওয়াকিবহাল রাখতে নিয়মিত ল’ জার্নাল পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। একজন আইনজীবীর পড়ালেখার কোনো নির্দিষ্ট সীমা-পরিসীমা নেই।
২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে সদস্যভুক্ত নবীন আইনজীবীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আজ সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, শেষ শীতের এই হিমেল বিকেলে আমরা সুপ্রীম কোর্ট বারের নতুন সদস্যদের সংবর্ধনা প্রদানের জন্য সবাই একত্রিত হয়েছি। আইন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ শেষে অধস্তন আদালতে নিয়মিত প্রাকটিসের পাশাপাশি একটি তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আপনারা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আলাদতে আইন পেশা পরিচালনার অনুমতি লাভ করেছেন- এটি নিঃসন্দেহে আপনাদের পেশাগত জীবনের একটি বিশেষ অর্জন। এই সাফল্যের জন্য আপনাদের সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
তিনি বলেন, বক্তব্যের শুরুতেই আমি পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি পৃথিবীর বুকে একটি নতুন জাতি, একটি নতুন ভূখন্ড, একটি নতুন পতাকার জন্ম দিয়েছেন। আরও স্মরণ করছি, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে শাহাদত বরণকারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবসহ জাতির পিতার পরিবারের আত্মোৎসর্গকারী সকল সদস্যগণকে। বিনম্র চিত্তে স্মরণ করছি কারা অন্তরালে শহীদ জাতীয় চার নেতাকে, যারা প্রত্যেকেই আইনজীবী ছিলেন। স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ নির্যাতিতা মা-বোন কে, যাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন দেশের আত্মমর্যাদাশীল নাগরিক হিসেবে আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়াতে সক্ষম হয়েছি।
তিনি আরো বলেন, আমরা যদি বাংলাদেশের ইতিহাস গভীরভাবে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো- সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি তথা সর্বক্ষেত্রে প্রগতিশীল যে কোনো কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে আইনজীবীগণ সরাসরি জড়িত ছিলেন অথবা তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এসব কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। তাদের এরূপ অবদানের কারণে সময়ের আবর্তে আমাদের সমাজে আইনজীবী শ্রেণীর প্রতি এক ধরণের শ্রদ্ধা ও সমীহ তৈরি হয়েছে। অখন্ড ভারতবর্ষে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, এ কে এম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এর মত বিখ্যাত ব্যক্তিগণ, এরা সবাই আইনজীবী ছিলেন। এদের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও এ কে এম ফজলুল হক ঢাকা হাইকোর্টে নিয়মিত প্রাকটিস করতেন। তবে আইন পেশার মাধ্যমে অর্থ-বিত্ত-বৈভব অর্জন নয়; বরং তাঁদের মূল্য লক্ষ্য ছিলো আইনি সহায়তার মাধ্যমে মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করা। তাই অসহায় মানুষকে আইনি প্রতিকার প্রদানের মাধ্যমে দেশের মানুষের অধিকার রক্ষায় তাঁরা নিজেদের সম্পূর্ণরূপে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। মনে রাখবেন, আপনারা সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী।
ওবায়দুল হাসান বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিলো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে বিরাজ করবে সাম্য ও সামাজিক ন্যায় বিচার, যা হবে সম্পূর্ণরূপে শোষণমুক্ত এবং যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি হবে আইনের শাসনের ব্যতিক্রমহীন চর্চা। বঙ্গবন্ধুর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের অন্যতম কুশীলব বাংলাদেশের আইনজীবীগণ। আইনজীবীগণ বিচারপ্রার্থী মানুষের অধিকার রক্ষায় কোর্ট অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। তাই আমি আশা করি, সুপ্রীম কোর্ট বারের নবীন সদস্যগণ তাদের সিনিয়রদের দেখানো পথ অনুসরণ করে এদেশের সাধারণ মানুষকে আইনি সেবা প্রদানের মহৎ ব্রত নিয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে আইন পেশায় মনোনিবেশ করবেন।
তিনি বলেন, আমাদের সংবিধান জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের যে দায়-দায়িত্ব স্থির করে দিয়েছে তা যদি কোনভাবে লঙ্ঘিত হয় তবে সেই অধিকার পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব বিচার বিভাগের উপর অর্পিত হয়েছে। বিশেষ করে সংবিধানে বর্ণিত যে কোনো মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী ব্যক্তি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের দারস্থ হন। তাই দেশের নাগরিকগণের মৌলিক অধিকার পুনুরুদ্ধারের অন্যতম অনুঘটক কিন্তু আপনারা, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী সমিতির বিজ্ঞ সদস্যগণ। কেননা যে ব্যক্তির অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে তিনি সবার আগে আপনার কাছেই আসেন তার সমস্যার কথা খুলে বলতে।
তিনি আরো বলেন, মনে রাখবেন, বার ও বেঞ্চ- উভয়ের সমন্বয়েই বিচার বিভাগ। তাই বিচার বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আপনাদের অংশগ্রহণ ব্যতীত দেশে ন্যায় বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কিছুতেই ভুলে গেলে চলবেনা যে, মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণে আপনাদের এই বিশেষ অবদানের কারণে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোতে আপনাদেরকে সমাজের ভ্যানগার্ডরূপে গণ্য করা হয়। তাই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আজ যে সকল নবীন আইনজীবীদেরকে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতি বরণ করে নিচ্ছে, তারা দেশের মানুষের অধিকার রক্ষায় নিজেদেরকে নিরলসভাবে নিয়োজিত রেখে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, একজন বিচারপ্রার্থী মানুষ যখন ন্যায় বিচার প্রাপ্তির আশা নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে আসেন তখন প্রথমেই তিনি একজন আইনজীবীর দারস্থ হন। বিচারপ্রার্থীগণ আইনের জটিল নিয়ম কানুন জানেন না, তাদের পক্ষে জানা সম্ভবও নয়। তারপরেও তারা পরম নির্ভরতায় আপনাদের উপর তার সম্পদ ও স্বাধীনতা রক্ষার গুরুভার অর্পণ করেন। বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের মধ্যকার এই নির্ভরতার সম্পর্ক আপনাদের জন্য একটি পবিত্র আমানত। তাই এই আমানত রক্ষা করার বিষয়ে আপনাদের সবসময় সচেতন থাকতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, আপনারা সবাই আপনাদের পেশাগত জীবনে এই গুরু দায়িত্বটি সর্বোচ্চ সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করবেন।
তিনি বলেন, নবীনদের উদ্দেশ্যে আর একটি কথা বলতে চাই। আপনারা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে আইন পেশা পরিচালনা শুরু করতে যাচ্ছেন। এ কারণে, এই মহান প্রতিষ্ঠানের সম্মান বজায় রাখার দায়িত্ব আপনার-আমার সকলের। তাই আপনারা আপনাদের পেশাগত জীবনে এমন কিছু করবেন না যাতে এই প্রতিষ্ঠানের সম্মানহানি ঘটে। মনে রাখবেন, দল-মত নির্বিশেষে আপনাদের সকলের লক্ষ্য কিন্তু অভিন্ন। আপনারা সকলেই মানুষকে আইনি সেবা প্রদানের জন্য এ পেশায় এসেছেন, এদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী হয়েছেন। আমার অনুরোধ, এই মূল লক্ষ্য হতে আপনারা কিছুতেই কক্ষচ্যুত হবেন না।
তিনি আরো বলেন, আইন পেশা একটি সমৃদ্ধ গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যার উপর ভিত্তি করে আমাদের সমাজ নির্মিত হয়। আপনারা আইনজীবীগণ দেশের নাগরিকগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সমতা ও ন্যায়বিচারের আলোকবর্তিকা হিসেবে বিরাজ করছেন। তাই আপনাদেরকে সব সময় স্মরণ রাখতে হবে, একজন আইনজীবী হিসেবে আপনার integrity কেবল আপনার মক্কেলের প্রতি নয়, আপনার integrity থাকবে ন্যায় বিচারের প্রতি, দেশের সার্বিক কল্যাণের প্রতি।
ওবায়দুল হাসান বলেন, আমি অত্যন্ত গর্বভরে বলতে পারি যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রত্যয়, আপোষহীণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার সংগ্রামের জন্য যুগে যুগে আইনজীবীগণ আমাদের সমাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। অতীতে আমাদের মহান সংবিধানের বিধানকে ভুলুণ্ঠিত করে দেশে যখনই সৈরতন্ত্র কায়েম হয়েছে কিংবা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে- বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবীগণ রাজপথে নেমে এসেছেন। সুপ্রীম কোর্টের নেতৃবৃন্দ সৈরতন্ত্রের সাথে কোনোরূপ আপোষ না করে হাসিমুখে কারাবরণ গ্রহণ করেছেন- এমন দৃষ্টান্ত অনেক রয়েছে। এগুলো খুব বেশী পূর্বের কথা না। আপনারা সকলেই এই ইতিহাস জানেন। রাষ্ট্রকাঠামোতে আইনজীবীগণের এই সচেতন উপস্থিতির কারণেই কিন্তু আইনজীবীদেরকে সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়ে থাকে এবং তারা সমাজের চোখে এত শ্রদ্ধেয় ও বরণীয়। তাই আইনজীবী সমাজের অর্জিত এই সুনামে যেন কোনো প্রকার কালিমা লিপ্ত না হয় সে বিষয়ে সকলকে, বিশেষ করে, নবীন আইনজীবীগণকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। মনে রাখবেন, যে সুমহান ঐতিহ্য ও রীতি-নীতি পালনের জন্য এই সুনাম অর্জিত হয়েছে যে কোনো মূল্যে তা রক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, প্রায় ৪০ লক্ষ মামলার ভারে বিচার বিভাগ আজ ন্যুজ। এছাড়াও, বিচারক স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, বাজেট স্বল্পতাসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা আমাদেরকে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হচ্ছে। অধস্তন আদালতের কার্যকর তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা হ্রাসকল্পে আমার পূর্বসূরী প্রধান বিচারপতি মহোদয় দেশের ০৮ টি বিভাগের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমন্বয়ে ০৮ টি মনিটরিং কমিটি গঠন করেছিলেন। ইতোমধ্যে আমরা মনিটরিং কমিটির সুফল পেতে শুরু করেছি। কিন্তু একজন মাননীয় বিচারপতির পক্ষে বড় একটি বিভাগের সবগুলো জেলার কার্যক্রম তত্ত্বাবধান দূরহ একটি ব্যাপার। তাই মনিটরিং প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করার জন্য আমি দেশের বৃহত্তর বিভাগসমূহের জন্য একাধিক হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিকে দায়িত্ব প্রদান করেছি। বর্তমানে দেশের ০৮ টি বিভাগের জন্য মোট ১৩ জন মাননীয় বিচারপতি সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত আছেন। আমি আশা করি, মাননীয় বিচারপতিগণের সক্রিয় তত্ত্বাবধানে এবং আপনাদের সহযোগিতায় বিচার বিভাগের সার্বিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
তিনি আরও বলেন, প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর আমি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ডিজিটালাইজেশন, বিচার সেবা প্রাপ্তি সহজিকীকরণ তথা বিচার বিভাগের আধুনিকায়নের লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদী বিচার বিভাগীয় পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। তারই অংশ হিসেবে কিছুদিন পূর্বে আমি বাংলাদেশের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলগণ, সুপ্রীম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতিগণ, অ্যাটর্ণি জেনারেল অফিসসহ সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীগণদের সাথে মতবিনিময় করেছি। ভবিষ্যতে বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে আমরা বসবো। সুপ্রীম কোর্ট বারের নবীন সদস্যদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, মামলাজট হ্রাসকরণ, বিচার বিভাগ হতে দুর্নিতী নির্মূলকরণ, বিচার কার্যক্রমে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিচার সেবার মানোন্নয়নসহ বিচার বিভাগের আধুনিকায়নে আপনাদের যদি কোনো পরামর্শ থেকে থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে লিখিত আকারে সুপ্রীম কোর্ট রেজিস্ট্রিতে প্রেরণ করবেন। আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে আমরা বিচার বিভাগের জন্য দীর্ঘমেয়াদি জুডিসিয়াল প্লানটি প্রস্তুত করতে চাই।
প্রধান বিচারপতি বলেন, নিজেকে একজন প্রকৃত আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে কেবলমাত্র আইনের উপর দখল থাকলেই চলবে না, পেশাগত আচরণও সুন্দর হতে হবে। আপনারা আপনাদের সিনিয়রদের সম্মান করবেন, নিজের মামলা না থাকলে আলাদতে সিনিয়র আইনজীবীদের শুনানি শুনবেন। তাদের সমৃদ্ধ শুনানী আপনাদেরকে আরও দক্ষ করবে। আইনজীবীদের পেশাগত আচরণ সংক্রান্ত যে Canons গুলো রয়েছে সে সম্পর্কে আপনারা সকলেই অবহিত আছেন। একজন আইনজীবী তার মক্কেলের সাথে কেমন আচরণ করবে, তার সহকর্মীর সাথে তার আচরণ কি হবে, আদালতের প্রতি একজন আইনজীবী কিভাবে সম্মান প্রদর্শন করবে- এ সব কিছু সেখানে বলা আছে। মনে রাখবেন, এগুলো শুধু পরীক্ষা পাসের জন্য নয়। এই নৈতিক এই মানদন্ডসমূহ আপনারা মনে প্রাণে ধারণ করবেন এবং চর্চা করবেন। তবেই আইনজীবী হিসেবে আপনার পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, আপনাদেরকে মনে রাখতে হবে যে আইন পেশায় সফলতার জন্য কোনো সংক্ষিপ্ত রাস্তা নেই। একজন সফল আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে আপনাদেরকে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আইন পেশায় সাফল্যের শিখরে পৌছতে প্রয়োজন একাগ্র নিষ্ঠা, সততা, সময়ানুবর্তিতা, ধৈর্য্য, পরিশ্রম করার মানসিকতা ও নিরন্তর অধ্যয়ন। মনে রাখবেন, সঠিক সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং আইনি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে আদালতকে সহায়তা করাই একজন প্রকৃত আইনজীবীর কর্তব্য।
তিনি আরও বলেন, একটি বিষয়ে আমি নবীনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। দেশের সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের রায় ও আদেশ দেশের সকল আদালত ও কর্তৃপক্ষের উপর বাধ্যকর। আর সেই আদালতে আপনারা আইন পেশা পরিচালনা করতে যাচ্ছেন। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে সুপ্রীম কোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চ রায় বা আদেশের মাধ্যমে যে judge made law তৈরি করবে বা যে আইনি রীতি প্রতিষ্ঠা করবে তার গতি-প্রকৃতি অনেকটাই নির্ধারিত হবে আপনারা আপনাদের মেধা ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটিয়ে যে সাবমিশন রাখবেন তার উপর ভিত্তি করে। তাই সর্বশেষ আইন সম্পর্কে নিজেকে ওয়াকিবহাল রাখতে নিয়মিত ল’ জার্নাল পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। একজন আইনজীবীর পড়ালেখার কোনো নির্দিষ্ট সীমা-পরিসীমা নেই। প্রতিনিয়ত আইন পরিবর্তিত হচ্ছে, বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চ আদালতে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে। আপনারা নিজেদেরকে আইনের সর্বশেষ বিধান সম্পর্কে আপডেট রাখবেন। আপনার জ্ঞান ও কর্মে দ্বারা যদি আপনি নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করতে পারেন তবেই সবাই আপনাকে খুঁজে নেবে তাদের আইনি সহায়তার জন্য। আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে নবীন আইনজীবী হিসেবে মামলা পরিচালনার সময় আপনাদের অর্জিত জ্ঞান, মেধা ও বিচক্ষণতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করবেন।
ওবায়দুল হাসান বলেন, নোবেল জয়ী মানবাধিকারকর্মী Martin Luther King, Jr. এর একটি বিখ্যাত উক্তি আমি আপনাদের সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। তিনি বলেছিলেন, A man dies when he refuses to stand up for that which is right. A man dies when he refuses to stand up for justice. A man dies when he refuses to take a stand for that which is true.
তিনি বলেন, তাই আমি মনে করি, আজ আমরা যাদের সংবর্ধনা দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছি, সেই নবীন আইনজীবীগণ অন্যান্যদের থেকে ব্যতিক্রম। কারণ তারা পেশা হিসেবে এমন একটি পেশা কে বেছে নিয়েছেন যার মাধ্যমে সরাসরি মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা যায়। আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, আইন পেশা কে নিছক জীবিকা নির্বাহের একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা না করে অধিকার বঞ্চিত মানুষের কল্যাণ নিশ্চিতকরণের একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করুন। কেবলমাত্র তবেই সুপ্রীম কোর্টের একজন আইনজীবী হিসেবে আপনার পেশাগত জীবনের যে যাত্রা শুরু হলো, তা প্রকৃত অর্থে সার্থকতা পাবে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্যবৃন্দসহ যারা এই আয়োজনের জন্য তাদের সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন তাদের প্রতি আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আমি বিশ্বাস করি অনুষ্ঠানটি বারের নতুন সদস্যদেরকে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হতে উৎসাহ যোগাবে এবং বিভিন্ন বক্তাগণ তাদের যে দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন তা তাদের ভবিষ্যত পেশাগত জীবনে চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে।
সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজউদ্দিন ফকিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বারের সম্পাদক আবদুন নূর দুলাল। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন- সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম, নুরুল ইসলাম সুজন, মাহমুদ আলী, আইনজীবী নেতা মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে সদস্যভুক্ত নবীন আইনজীবীরা সহ উপস্থিত ছিলেন বারের নেতৃবৃন্দ ও সদস্যরা।