ফাইজুল ইসলাম: বাংলাদেশের বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ির ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই স্বত্ব) পেয়েছে ভারতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। গত বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) ভারতের সরকারের মিনিস্ট্রি অব কালচারের অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজ থেকে এ ঘোষণাটি আসে। এরপর থেকেই আলোচনার ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্যের জিআই স্বত্ব ভারত পাওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদশ।
জি আই স্বীকৃতি কেন গুরুত্বপূর্ণ
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তত্ত্বাবধান ও উদারীকরণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ২৩টি চুক্তির একটি হচ্ছে, বাণিজ্য-সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার চুক্তি বা ট্রিপস (ট্রেড রিলেটেড আসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস)। এই চুক্তির ২৭.৩ (খ) ধারায় পৃথিবীর সব প্রাণ-প্রকৃতি-প্রক্রিয়ার ওপর পেটেন্ট করার বৈধ অধিকার রাখা হয়েছে।
এই চুক্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব প্রাকৃতিক, মানুষের তৈরি এবং কৃষিজাত পণ্য দীর্ঘকাল ধরে উৎপাদিত হয়ে আসছে, তার ওপর সংশ্লিষ্ট দেশের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক আইন করে নিবন্ধন করে রাখার বিধান রয়েছে।
দিন যত যাচ্ছে, বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে তত বাড়ছে পণ্যের স্বত্বের গুরুত্ব। এ কারণেই জিআই নিয়ে এত তোড়জোড়। কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীর কোনো সংস্কৃতি যদি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেই পণ্য ওই অঞ্চলের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও জিআইয়ের স্বীকৃতি একটা বড় সুবিধা। সারা বিশ্বেই জিআইয়ের স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কারণেই বাসমতী চালের স্বত্ব নিয়ে পাকিস্তান, ভারত আর নেপালের আইনি যুদ্ধ চলছে তো চলছেই!
কীভাবে পাওয়া যায় জিআই
যেকোনো ঐতিহ্যবাহী পণ্য জিআই করার আগে দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এই স্বীকৃতি দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। আর যে জেলার পণ্য জিআই হবে, তার জেলা প্রশাসক বা সরকারি কোনো দপ্তরকে আবেদন করতে হয়।
কিন্তু দেখা গেছে, পণ্যের তালিকা করেও দীর্ঘ সময় ধরে এসব জেলা বা সরকারি কর্তৃপক্ষ ওই পণ্যের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত জমা দেয়নি। পণ্য জিআই হতে গেলে পণ্যের অন্তত ৫০ বছরের ঐতিহ্য থাকতে হয়, যে এলাকার পণ্য, তার স্বীকৃতি থাকতে হয়। ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজই শুধু নয়, প্রাচীন সাহিত্য-পুঁথি-ছড়ায় কোনো উল্লেখ থাকলেও প্রমাণ হিসেবে তা তুলে ধরা হয়। এসব খুঁজে বের করা গবেষণার বিষয়।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের জিআই স্বীকৃতি নিয়ে কেন বিড়ম্বনা
বিভিন্ন গবেষণা এবং এই শিল্পের আদি ধারার সাথে সম্পৃক্তদের বয়ানে এই শাড়ির উৎপত্তিস্থল হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে উঠে আসছে পাথরাইল, নলশোধা, ঘারিন্দাসহ টাঙ্গাইলের এমন বাইশ-তেইশটি গ্রামের নাম।
“একসাথে এগুলোকে বাইশগ্রাম বলে চিহ্নিত করা হতো। এসব গ্রামই ঠিকানা ছিল তাঁতিদের। যাদের পদবি ছিল ‘বসাক’।”
বলছিলেন হরিপদ বসাক, যিনি ওই তাঁতিদের বংশধর। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ‘পূর্ব বাংলায়’ হলেও বর্তমানে বসবাস করছেন পশ্চিম বঙ্গের নদীয়ায়।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের ব্রিটিশ ভারতে টাঙ্গাইল ছিল ময়মনসিংহ জেলার এক মহকুমা। মি. হরিপদ বসাক বিবিসি বাংলাকে জানান, “১৮৫০ সাল বা তার কাছাকাছি সময়ে তৎকালীন ধামরাই এবং চৌহট্ট নামে দুটি গ্রামে মসলিনের উত্তরসূরি কিছু তাঁতি বসবাস করতেন।
সন্তোষ, করটিয়া, দেলদুয়ারে জমিদারি পত্তনের সময় অন্যান্য পেশাজীবীদের পাশাপাশি ওই তাঁতিদেরও সেসব জায়গায় নিয়ে বসতি স্থাপন করা হয়।”
এসব গ্রামের মানুষেরা যে শাড়ি বয়ন করতেন তাই ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
ভারতে যেভাবে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ এর উৎপত্তি
২০১৪ সালে টাঙ্গাইল জেলার তাঁতিদের নিয়ে একটি গবেষণা করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক সুব্রত ব্যানার্জি, মো. মনিরুজ্জামান মুজিব ও সুমনা শারমিন।
গবেষণায় দেখা যায়, পাকিস্তান পর্বে তো বটেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও বসাক সম্প্রদায়ের পরিবারের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে।
নলশোধা গ্রামের উদাহরণ টেনে উল্লেখ করা হয়, স্বাধীনতার পর পুরো গ্রামেই বাড়িতে বাড়িতে তাঁত থাকলেও ২০১৪ সালে সরেজমিন তারা দেখতে পান মাত্র ২২টি পরিবার এই পেশায় যুক্ত আছে।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁতশিল্প নিয়ে গবেষণা করেন নিলয় কুমার বসাক। তিনিও ওই তন্তুবায় সম্প্রদায়ের উত্তর প্রজন্ম। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বসাক সম্প্রদায়ের বড় অংশই ভারতে চলে যান। তাদের ভিড়টা বেশি হয় নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রাম এবং পূর্ব বর্ধমানের ধাত্রী গ্রাম ও সমুদ্রগড়ে। তাদের বদৌলতে নদীয়া ও পূর্ব-বর্ধমানে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ পরিচিতি লাভ করে, যোগ করেন তিনি।
বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল বলেন, টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজের দাবি করে ভারতের জিআই স্বীকৃতি নেওয়ার বিষয়টি বিশ্বাসই করা যায় না। এ ঘটনায় আমি আশ্চর্য হচ্ছি। যখন থেকে দেশের টাঙ্গাইল এলাকায় এই বিশেষায়িত শাড়িটি উৎপাদিত হয়ে আসছিল, তখন থেকেই একে টাঙ্গাইলের শাড়ি নামেই বলা হতো। আমাদের সবচেয়ে পুরনো কটেজ ইন্ডান্ট্রি হচ্ছে টাঙ্গাইলের তাঁত। টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির কারিগর তথা তাঁতি সবচেয়ে বেশি আছে বাংলাদেশে। দেশভাগের সময় কিছু তাঁতি ভারতের ফুলিয়া ও নদিয়ায় চলে যায়। এরপর মুক্তিযুদ্ধের সময়ও কিছু তাঁতি ভারতে যান। কিন্তু তাঁতিদের বেশির ভাগই বাংলাদেশে আছেন।
তিনি বলেন, আমি নিজেও ফুলিয়ায় কাজ করেছি। বাংলাদেশ থেকে যেটা যায় তা টাঙ্গাইল শাড়ি বলেই পরিচিত। প্রতিবছর ভারতে ৫০ হাজারের বেশি টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে। এসব থেকে ভাবতে অবাক লাগে ভারত কীভাবে টাঙ্গাইল শাড়ির মালিকানা নিজের বলে দাবি করে। সরকার জিআই আইন করে। এ বিষয়ে আমাদের আরও কাজ করতে হবে।
বিবি রাসেল বলেন, আগে শাড়িটা ৯ থেকে ১০ হাত হলেও এখন তা ১৪ হাত হয়েছে। টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের এত পুরনো একটি ঐতিহ্য তা ভারত কীভাবে নিল তা বোধগম্য নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব নিতে হবে। জামদানি শাড়ি যে বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্য, এর সব ইতিহাস যথাযথভাবে ডকুমেন্ট করতে হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি মনে করেন যে, তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন তা করতে পারেন। আমি মনে করি এখনই আমাদের এ বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এজন্য যথাযথ কাগজপত্র ঠিক করতে হবে। যাতে আমরা এটি আটকাতে পারি।
জি আই এর সাথে স্থানের সম্পর্ক না পণ্যের
জিআই হলো ভৌগলিক নির্দেশক চিহ্ন যা কোনো পণ্যের একটি নির্দিষ্ট উৎপত্তিস্থলের কারণে এর খ্যাতি বা গুণাবলী নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত জিআইতে উৎপত্তিস্থলের নাম (শহর, অঞ্চল বা দেশ) অন্তর্ভুক্ত থাকে। জিআই (GI) এর পূর্ণরুপ হলো (Geographical indication) ভৌগলিক নির্দেশক। WIPO (world intellectual property organization) হলো জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দানকারী প্রতিষ্ঠান।
জি আই পাবার অন্যতম পূর্বশর্ত হল ওই বস্তুটি ওই নামের বিশেষ অঞ্চলে উতপাদিত। যেমন, ওয়াইন অনেক জায়গায় তৈরি হয়। কিন্তু ফ্রান্সের শাম্পাইন গ্রামে উতপাদিত না হলে ওই ওয়াইনকে শ্যাম্পেন বলা যাবে না। আবার ইলিশের মত অনেক মাছ, একই স্বাদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে। কিন্ত ইলিশ মাছে জি আই বাংলাদেশের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অর্পিতা শামস মিজান মনে করেন, টাঙ্গাইলের শাড়ি, মসলিন, জামদানী যখন বোনা শুরু হয়, সবই ভারত ছিল। আজকে ভারত মোটা দাগে ৩ টুকরো হয়ে ৩টি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হয়েছে। প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব ঐতিহ্য আছে যা প্রাক বৃটিশ সময় পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায়। জামদানী তাই বাংলাদেশের, কারণ ঢাকা কোন এক কালে ‘ভারত’ এর অংশ হলেও, ঢাকার যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, তা বৃহত্তর ভারত থেকে না, বরং বঙ্গের এই অংশ থেকে উদ্ভূত।
তিনি আরো বলেন, Property Law এর পুরো কাঠামোটাই ঔপনিবেশিক। ইউরোপের বাহিরে এভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি নিয়ে কারও মাথা ব্যাথা ছিল না। আফ্রিকা বা এশিয়া মহাদেশের আইনে এমন ধারণা পাওা যায় না। প্যারিস কনভেনশনের মাধ্যমে ঐপনিবেশিক শক্তিরা তাদের নিজ নিজ উপনিবেশের রিসোর্সকে শোষণ করার জন্য এসব আইন তৈরি করে। উপনিবেশের স্বার্থ তাদের বিবেচ্য ছিল না।ফলে উপনিবেশে পরবর্তীতে যে ভৌগলিক পরিবর্তন হয়, যার ফলে ঐতিহ্যবাহী আচার ও উপাচারের স্বত্ত্ব নিয়ে আজকের টানাটানি, তার সম্ভাবনা নিয়ে Intellectual Property Law খুব একটা চিন্তিত ছিল না।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র
১. https://www.linkedin.com/pulse/%a?arpeetashamsmizan_source=share&utm_medium=member_android&utm_campaign=share_via
২. ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, বিবিসি
৩. Daily Insider, 3 February, 2024
৪. Daily Star, 5 February, 2024