মীর হালিম: এ যেন রাজকীয় আয়োজন, জমজমাট উৎসব মুখর পরিবেশ! আইনঙ্গনে আইনজীবী ও বিচারকদের মিলন মেলা! বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বাৎসরিক প্রীতিভোজ সভা! এ সভা শিশু সাহিত্যিক আখতার হোসেনের ‘ভোজের ভোজবাজি’ কিংবা চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘ভোজবাজির গল্প’কেও হার মানায়। এ যেন লালন সাঁই এর “দেখিলাম এ সংসার ভোজবাজি প্রকার” এর মতই একটা কিছু!
এমন আয়োজনের ঐতিহ্য রয়েছে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই। ইতিহাসে কিংবা বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন রাজ্যসভায়, দেশি-বিদেশি সংগঠনে এরকম ভোজ আয়োজনের রেওয়াজ আছে। মুঘলদের বাদশাহী ভোজের শাহী ফরমানে যোগ দিত হাজার হাজার মানুষ। তাইতো প্রবাদে আছে “পরেছি মুঘলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে।”
তাছাড়া দেশে দেশে রাষ্ট্রীয় অতিথি আগমনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মহা ভোজ আয়োজনের ইতিহাস ঐতিহ্য রয়েছে। এগুলিকে আধুনিক সমাজ লাঞ্চ পার্টি, ডিনার পার্টি, গালা পার্টি ইত্যাদি নামে অভিহিত করে থাকে।
ইদানিং কালে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে আয়োজিত ‘বিগ লাঞ্চ’ পার্টিতে মাতোয়ারা হয়েছিলেন ব্রিটেনসহ সারা বিশ্বের প্রায় ১ কোটিরও বেশি মানুষ। ব্রিটেন ও বিভিন্ন দেশে আয়োজিত এ ভোজসভাকে ইতিহাসের বৃহত্তম ‘কমিউনিটি গেট-টুগেদার’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রিটেনের ও বিশ্বের লাখ লাখ জনতার এভাবে রাজ্যাভিষেক উদ্যাপন করায় তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানিয়েছেন রাজা তৃতীয় চার্লস এবং রানি ক্যামিলা।
মনুষ্য সমাজের ব্যতিক্রমও রয়েছে। ‘বানরের জন্য রাজকীয় ভোজ’ ‘অ্যানুয়াল মাংকি বুফে’ অথবা ‘বানরের জন্য ফাইভ স্টার ব্যাংকুয়েট’ এরকম মনকাড়া শিরোনাম ২০১৬ সালে বিশ্বের জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যমে ঝড় উঠেছিল। জানা গেছে ১৯৮০ সাল থেকে থাইল্যান্ডের লোপবুরির একটি প্রাচীন বৌদ্ধমন্দির বানরের জন্য আয়োজন করে থাকে বার্ষিক এ মহাভোজের! আর এতে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে শত শত বানর যোগ দেয়। আহা বানরের ভোজন সভা!
তবে আইনজীবী ভোজনের বিষয়টা আলাদাই বটে! বিজ্ঞজনদের ভোজন! এ যেন শাহী আয়োজন আর এলাহি কাণ্ড! একজন আইনজীবী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন যে ২০২৪ সালের “বার্ষিক ভোজ অনুষ্ঠানের জন্য ৩৫০টি খাসি, ১১০০ কেজি গলদা চিংড়ি, ৩০০০ পিস মুরগি সহ অন্যান্য খাবার প্রস্তুতির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে ৪৫০ জন বয়-বাবুর্চি-মেসিয়ার” এতেই বোঝা যায় কত বড় আয়োজনের প্রস্তুতি। আইনঙ্গনের রাজা প্রজা উজির সেনা কোতোয়াল ও স্তাবকদের জন্য এ বিশাল আয়োজন।
আকর্ষণীয় এ ভোজ উপভোগ করেছেন সরকার সমর্থিত আওয়ামী আইনজীবী প্যানেল ও সমমনা আইনজীবীরা। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, হাইকোর্ট বিভাগের কিছু বিচারকসহ ঢাকা দক্ষিণের মেয়রকেও যোগ দিতে দেখা যায়। অপেক্ষাকৃত নতুন সদস্যরাই বেশি যোগ দিয়েছে। বার্ষিক ভোজসভায় খাবারের আয়োজন ও খাওয়া-দাওয়ার ছবি দিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি পোস্ট করেছেন এবং ট্রলেরও শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ও সমমনা আইনজীবীদের সংগঠনসমূহ এ ভোজসভা বর্জন করেছেন। ইউনাইটেড লইয়ার্স ফ্রন্টও বার্ষিক ভোজ বর্জনের বিষয়ে সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে, যেখানে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা ছাড়াও জামায়াত, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলনসহ অন্যান্য সমমনা আইনজীবীরা রয়েছে।
তাদের যুক্তি হলো প্রহসনের নির্বাচনে অনির্বাচিত আইনজীবী সমিতি কর্তৃক এই আয়োজন বৈধ নয়। “দখলদার, দুর্নীতিবাজ ও অনির্বাচিত কমিটির আয়োজনে অনুষ্ঠিত ভোজসভা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান ও বর্জনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সবাইকে উক্ত ভোজসভা এবং তথাকথিত গিলাকলিজা পার্টি বর্জনের আহ্বান জানানো হলো।”
এরকম মেসেজে প্রচারিত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের এডহক কমিটিও এ ভোজ সভা বর্জন করেছে। এই বার্ষিক ভোজ বর্জনের ডাক দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে তারা চিঠিও দিয়েছিল।
গরম–গরম ধোঁয়া ওঠা খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি, মুরগির রোস্ট, চিংড়ি ফ্রাই, বোরহানি, দই, কোমল পানীয় ইত্যাদি মোগল রাজকীয় খাবার বর্জন করে বিএনপিপন্থী ও সমমনা আইনজীবীরা প্রতিবাদ স্বরূপ নিজেদের উদ্যোগে দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট বারের ক্যান্টিনে লাউ, ডাল, ভাত খেয়েছেন।
একজন আইনজীবী মন্তব্য করেন যে, গণতন্ত্রকামি বিপ্লবীদের জন্য ভোজবাজির ভোজ সভা নয়! এখনো বহু মানুষ বাড়িতে ঘুমাতে পারে না, মলিন বস্ত্র, খালি পকেট, ক্ষুধার্ত পেট আর মামলার দুশ্চিন্তা নিয়ে চলাফেরা করে। চাকরি নেই, ইনকাম নেই, ব্যবসা নেই, নেই ঘর সংসার।
এসব প্রিয় ভাইদেরকে এত অনিশ্চয়তায় রেখে ভোজের অনুষ্ঠান এই সময়ে জাতীয়তাবাদীদের অন্তত মানায় না! এইজন্য জাতীয়তাবাদী ও সমমনা আইনজীবীরা ক্যান্টিনে সাধারণমানের খাবার খেয়ে তার প্রতিবাদ করেছেন। শোনা যায় কেউ কেউ রোজা রেখে, না খেয়ে তার প্রতিবাদ করেছেন। অভিনব প্রতিবাদের ধরণ।
কেউ কেউ খাবার খেতে গিয়ে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে বিড়ম্বনার শিকার হওয়ার কারণে দুই দিন যাবত আয়োজন করার কথা বলেছেন, প্রথম দিন খাবে জোড় সংখ্যার সদস্যরা দ্বিতীয় দিন খাবে বিজোড় সংখ্যার সদস্যরা!
উক্ত বর্জন আর গর্জনের মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি কর্তৃক আয়োজিত এ বছরের বার্ষিক ভোজের আয়োজন।
বর্তমানে সমিতির নিয়মিত সদস্য সংখ্যা প্রায় ১২,০০০ জন। প্রতিটি সদস্য বার্ষিক ভোজ বাবদ ৬০০ টাকা করে বাধ্যতামূলকভাবে প্রদান করে থাকেন। এই হিসেবে বাৎসরিক ভোজের চাঁদা সংগ্রহ হয় ৭২,০০,০০০ (৭.২ মিলিয়ন অথবা ৭২ লক্ষ ) টাকা। ২০২৩ সালে ভোটার ছিল ৮৬০০ জন, তালিকায় অনিয়মিত সহ মোট সদস্য সংখ্যা ১৩,৬৬৭ জন। এর মধ্যে নারী সদস্য সংখ্যা প্রায় ১২০০ জনের মতো এবং হিন্দু সদস্য সংখ্যা ৯০০ জনের মত।
২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত ভোজসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট ছিল ৮৬ লক্ষ টাকা। সাধারণত খাবার আয়োজন করা হয় ১০ হাজার জন সদস্যের জন্য। ৫০০০ থেকে ৬০০০ জন সদস্য খাবার খেয়ে থাকেন বলে মনে করা হয়। কত লোকের আয়োজন হয় আর কত লোক খায় এর সঠিক হিসাব নিয়ে প্রতিবারই সংশয় থেকেই যায়।
একজন নারী আইনজীবী অভিযোগের সুরে বলেন, বার্ষিক ভোজসভায় নারীদের উপযোগী খাবারের তেমন আয়োজন থাকে না। এই খাবারের মেনু সিলেকশনে ১২০০ জন নারী বা তাদের প্রতিনিধিদের কোন ভূমিকা নেই।
একজন নারী আইনজীবী নেত্রী বলেন, ভবিষ্যতে নারীবান্ধব খাবারের জন্য কথা বলে যাবেন।
হিন্দু কমিউনিটির জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই। যদিও অনেক হিন্দু আইনজীবী খাঁটি ভেজিটেরিয়ান রয়েছেন। একজন হিন্দু পুরোহিত আইনজীবী বলেন, বার্ষিক ভোজনসভায় খাবারের মধ্যে হিন্দু ও অন্যান্য কমিউনিটির সদস্যদের রুচি ও খাদ্যাভ্যাসের কথা বিবেচনা করে ভ্যারাইটি আনতে পারলে আমরা আনন্দিত হতাম।
এ ধরনের রাষ্ট্রীয় ও আইনজীবী ভোজনসভা বর্জনের ইতিহাসও রয়েছে।
২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বার্ষিক ভোজসভা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন সরকার সমর্থক আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা যাদের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়াত অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম।
তাদের যুক্তি ছিল, আইনজীবী সমিতির সভাপতি প্রয়াত অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহার করে তার এজলাসের সামনে করা কর্মসূচির জন্য ক্ষমা না চাইলে তারা এ ভোজসভায় যোগদান করবে না।
তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি (২০০২-০৭) এ.পি.জে আব্দুল কালাম আজাদ উনার সময়কালে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে ইফতার আয়োজন না করে অত্র খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ এতিমখানায় দান করেছিলেন।
এ নিয়ে কিছুটা সমালোচনা হলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, এভাবে যে রাজসভায় ভোগের চেয়ে ক্ষুধার্ত এতিমদের ইফতার খাওয়া বেশি জরুরি ও কল্যাণময় হবে বলে বিশ্বাস করে আমি এই টাকা এতিমখানায় খাদ্য, পোশাক ও কম্বল কিনার জন্য দান করেছি। উনার এই উদার গণতান্ত্রিক কার্যক্রম অনেক মহলে প্রশংসিত হয়েছে।
২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের সময় তার সম্মানে আয়োজিত রাজকীয় ভোজ অনুষ্ঠান বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভারতীয় কংগ্রেস দলনেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী।
তাদের যুক্তি ছিল মোদি সরকার মূল বিরোধী দলকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করার বিষয়ে অনুমতি দেয়নি যা বহু পুরনো রীতি ও প্রথা! তাছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকার কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধিকেও ওই ভোজে আমন্ত্রণ জানায়নি, যা যথেষ্টই অপমানজনক। তাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্মানে আয়োজিত ভোজে আমরা অংশ নেব না। এটাই আমাদের প্রতিবাদের একটি উপায়।
বার্ষিক ভোজ অনুষ্ঠানের এ বছরের বাজেট প্রায় ৮৬ লক্ষ টাকা। একজন তরুণ আইনজীবী আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেন এই টাকা আমার হাতে তুলে দিলে আমি নিম্নোক্ত কাজ গুলি বাস্তবায়ন করতাম।
১. সুপ্রিম কোর্টে বারে নিয়মিত আইন বিষয়ক সেমিনার বা আলোচনা সভা করতাম। ১ বছরে ১২টি আয়োজন করে মোট ২৪ লক্ষ টাকা খরচ করতাম। বক্তাদের জন্য কিছু সম্মানীর ব্যবস্থা রাখতাম পাশাপাশি শ্রোতাদের জন্য হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করতাম।
২. সমসাময়িক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনাঙ্গনের অগ্রগতি বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজন করতাম। সারা দেশের আইনের শিক্ষার্থীরা তাতে অংশগ্রহণ করত। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মনে করি ৫০ জনকে পুরস্কৃত করতাম। অনুষ্ঠান আয়োজন ও পুরস্কার বাবদ আমি ব্যয় করতাম ৩ লক্ষ টাকা। আইনমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের অন্যান্য বিচারপতি, আইনের অধ্যাপক, সিনিয়র আইনজীবী, আইন সচিব, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল সহ আইনাঙ্গনের বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছ থেকে ছাত্রছাত্রীরা পুরস্কার গ্রহণ করে ধন্য হতো। আইনের বাস্তবিক বিজ্ঞজনদের সাথে একটি সংযোগ স্থাপিত হত।
৩. আইনজীবীদের মধ্যে একটি কল্পিত মামলার বিষয়ে ড্রাফটিং প্রস্তুত করণ প্রতিযোগিতা আয়োজন করতাম। বেস্ট পাঁচটি মডেল ড্রাফটের জন্য ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করতাম। অন্যান্য খরচ ৫০ হাজার টাকা করতাম । মোট ১ লক্ষ টাকায় এরকম একটি অনুষ্ঠান করা সম্ভব। ক্রেস্ট উপহার দিতাম। আইনজীবীরা ধন্য ধন্য করত।
৪. বিচারপতি ও বিচারকদের মধ্যে একটি কল্পিত মামলার বিষয়ে জাজমেন্ট লিখন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতাম। বেস্ট পাঁচটি মডেল জাজমেন্টের জন্য ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করতাম। ক্রেস্ট উপহার দিতাম। অন্যান্য খরচ ৫০ হাজার টাকা করতাম। মোট ১ লক্ষ টাকায় এরকম একটি অনুষ্ঠান করা সম্ভব। বিচারপতিরা হয়ত অনেক খুশি হতেন। বেশিরভাগ সময় শুনতে পাই ওনাদের কর্মের বিষয়ে কোনো পুরস্কার নাই। এত করে ওনাদের আফসোস কিছুটা লাঘব হত।
৫. নানা রকম দুর্যোগ ও শীতকালে অতি দরিদ্র ও শীতার্ত অসহায় মানুষদের জন্য ৩ লক্ষ টাকার চাদর কম্বল ও অন্যান্য শীতকালীন বস্ত্র বিতরণ করতাম। অসহায় মানুষের উষ্ণতার আনন্দ আইনজীবীরা ভাগাভাগি করতে পারত! পাশাপাশি স্রষ্টার খুশিতো রয়েছেই!
৬. কোন বিজ্ঞ আইনজীবী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে বা যেকোনো দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হসপিটালে ভর্তি হলে ওনাদের খোঁজখবর নিয়ে নগদ একটি ছোট বরাদ্দ দিতাম। কিংবা কর্জে হাসানার ব্যবস্থা করতাম। অনেকে চিকিৎসার ব্যয় তাৎক্ষণিক মেটাতে পারেনা আবার লজ্জায় বলতেও পারে না। এটার জন্য একটি আনুমানিক ৪ লক্ষ টাকার বাজেট রাখতাম।
৭. এখনো আমার হাতে আনেক টাকা ব্যয় করার মত বাকি আছে। মনে করি সেই টাকা হতে কিছু টাকা দিয়ে বস্তিবাসী ছিন্নমূল অসহায় মানুষের জন্য, ভাসমান মানুষের জন্য, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য অথবা পথ শিশুদের শিক্ষার জন্য, বিভিন্ন প্রকার প্রতিবন্ধী মানুষদের কল্যাণে কর্মসূচি গ্রহণ করতাম, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান করতাম। উদাহরণস্বরূপ এখানে আমি ৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করতাম।
৮. সময়োপযোগী আধুনিক ও বিশ্ব মানসম্মত বই ক্রয় করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে দান করতাম যাতে করে আইনের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যুগোপযোগী আইন বিষয়ক নলেজ সম্পর্কে অবগত হতে পারে। আইনাঙ্গনে বিশ্বব্যাপী অগ্রগতির সাথে তারা সম্পৃক্ত হতে পারে। মনে করি এখানে আমার বাজেট ৫ লক্ষ টাকা।
৯. আরো বাকি আছে অনেক টাকা। ২ লক্ষ টাকা আমি গবেষণা ও উন্নয়নের পেছনে ব্যয় করব। কিভাবে আরো সৃজনশীল পদ্ধতিতে এই টাকা মানুষের বা আইনজীবীদের কল্যাণে ব্যবহার করা যায়।
১০. এই পর্যন্ত আমি ৪৮ লক্ষ টাকা শেষ করে ফেলেছি। কিন্তু বিজ্ঞ আইনজীবীবিবৃন্দ এখনো আমার হাতে অনেক অনেক টাকা বাকি আছে। ৮৬ লক্ষ টাকা থেকে ৪৮ লক্ষ টাকা বাদ দিলে থাকে ৩৮ লক্ষ টাকা। এই টাকা আমি আপনার হাতে তুলে দিলাম। আপনি আইনজীবী বা বিচারক বা আইনাঙ্গনে সৃজনশীল কোন কাজে ব্যবহার করতে পারেন।
বিজ্ঞ আইনজীবী বৃন্দ, আপনারা যুক্তিবাদী মানুষ, যুক্তির সাথে তর্ক করতে ভালোবাসেন, নিজে জিতেন, মক্কেলকে জিতান কিংবা জিতান ন্যায় বিচারকে! এখানকার কোন যুক্তিটি আপনার কাছে অযৌক্তিক মনে হয়? স্বামী বিবেকানন্দের বাণীর মত আসুন না তর্ক করি যুক্তির সাথে! রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন, এ কথা কি ভুলে গেলে চলবে?
এই পৃথিবীতে ধনীরা বলে ধনার্জন কঠিন জ্ঞানীরা বলে জ্ঞানার্জন সৈয়দ মুজতবা আলীর পঞ্চতন্ত্রের সমাধানের মতো চিন্তা করা যায় যে ধনীদের উপার্জিত অর্থ যদি জ্ঞানীদের হাতে তুলে দেয়া হতো, তাহলে তাদের পরিকল্পনা ও সুন্দর ব্যবহারে মানুষের জীবন আরও উন্নত হত! জ্ঞানীরা পয়সা পেলে খরচ করতে পারেন ধনীদের চেয়ে অনেক ভালো পথে, ঢের উত্তম পদ্ধতিতে! অতএব জ্ঞানার্জন ধনার্জনের চেয়ে মহত্তর এ কথা তিনি প্রমাণ করিয়াই ছেড়েছিলেন।
আমরা প্রীতিহীন নয় বরং প্রীতিময় আইনজীবী সমাজ চাই। বিতর্কিত এ ধরনের ভোজন সভা বাতিল করলেও খুব বেশি ক্ষতি হবে না। এখানে বরাদ্দকৃত অর্থ আইনজীবী সমাজ তথা সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করার জন্য সৃজনশীল পরিকল্পনা গ্রহণ করলে আইনজীবীদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সমাজের শ্রদ্ধা বাড়বে বৈকি!
যদি নিতান্তই এ ধরনের ভোজ রাখতেই হয় তা হোক মিতব্যয়ী, হোক আরো সাধারণ মানের, সকল কমিউনিটির রুচি ও খাদ্যাভ্যাসের কথা বিবেচনায় রাখা হোক যাতে সুন্দর হয় প্রীতিভোজ, প্রীতিময় হয় আইনজীবী সমাজ, ফুলে ফলে ভরে উঠে উচ্চ আদালতের বাগান, প্রজাপতিরা ডানা মেলে আর গেয়ে ওঠে সাম্যের গান, ন্যায় বিচারের কথা, উচ্ছ্বসিত হয় লেডি জাস্টিসের মাথা ঠিক যেন পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের ‘সবার সুখে’ কবিতার মত।
“আমার বাড়ির ফুল-বাগিচা ফুল সকলের হবে
আমার ঘরে মাটির প্রদীপ আলোক দিবে সবে।”
লেখক: আইনজীবী ও পাবলিক পলিসি বিশ্লেষক।