মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের রামু’র মরিচ্যা যৌথ চেকপোস্টে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সিসি ক্যামেরা বাসনোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত ৪ ফেব্রুয়ারী একটি মাদক মামলার শুনানীর পর্যবেক্ষণে কক্সবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক (জেলা জজ) মোঃ নুরে আলম এ নির্দেশ দেন।
একই আদালতের জ্যেষ্ঠ বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ শামীম ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি জানান, মাদক উদ্ধারে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, প্রকৃত অপরাধীদের প্রশ্নাতীতভাবে বিচারের আওতায় আনার লক্ষ্যে বিজ্ঞ বিচারক এ নির্দেশ দিয়েছেন। একইসাথে দায়িত্ব পালনরত কর্মকর্তা কর্তৃক মাদক উদ্ধারের প্রত্যেকটি ঘটনার ভিডিও চিত্র ধারণ করলে দায়েরকৃত মামলা সমুহের সঠিক তদন্ত এবং বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে বিজ্ঞ বিচারক তাঁর পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন।
জ্যেষ্ঠ বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ শামীম মামলার এজাহারের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মরিচ্যাঘোনা মৌলভীবাজার এলাকার ফরিদ আলম ও মাজুমা আক্তারের শিশু পুত্র মোঃ ওমর ফারুক এবং অন্য এলাকার নুরুল হাকিম প্রকাশ বাবুল একত্রে একটি মটর সাইকেল নিয়ে যাওয়ার সময় ১৪০০ পিচ ইয়াবা টেবলেট সহ তাদের আটক করা হয়।
এ ঘটনায় রামু’র ৩০ বিজিবি’র নায়েক (নম্বর-৭৩৭৯৭) মোঃ শহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১) সারণির ১০(ক) /৩৮/৪১ ধারায় উল্লেখিত ২ জনকে আসামী করে রামু থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার রামু থানা মামলা নম্বর-০১, তারিখ : ০১/০১/২০২৪ ইংরেজি। জিআর মামলা নম্বর : ০১/২০২৪ ইংরেজি (রামু)। মামলাটি তদন্তের জন্য রামু থানার এসআই মুহাম্মদ ইয়াছিন’কে আইও (তদন্তকারী কর্মকর্তা) নিয়োগ দেওয়া হয়।
এ মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু আসামী মোঃ ওমর ফারুকের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনার জন্য মামলা দায়েরের পরদিন তাকে কক্সবাজারের শিশু আদালত-২ এ উপস্থাপন করা হয়। এসময় বিজ্ঞ বিচারক মামলার এজাহার, এফআইআর, ফরোয়ার্ডিং, জব্দতালিকায় থাকা বক্তব্যের সাথে আদালতে শিশু আসামী মোঃ ওমর ফারুকের দেওয়া বক্তব্যে ভিন্নতা পান।
তখন আদালতের বিজ্ঞ বিচারক মোঃ নুরে আলম মামলার বাদী, বিজিবি’র নায়েক মোঃ শহিদুল ইসলাম, আইও রামু থানার এসআই মুহাম্মদ ইয়াছিন, মামলার অপর আসামী নুরুল হাকিম বাবুল এবং শিশু আসামী মোঃ ওমর ফারুককে একত্রে ৪ ফেব্রুয়ারী আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দেন।
নির্দেশনা মতো আদালতে উপস্থিত হয়ে শিশু আসামী মোঃ ওমর ফারুক আদালতকে জানায়, তাকে জব্দকৃত মাদক সহ সিএনজি গাড়ি থেকে আটক করা হয়েছে। মটর সাইকেল থেকে নয়। অপর আসামী নুরুল হাকিম বাবুল আদালতকে জানায়, শিশু আসামী মোঃ ওমর ফারুক তার পূর্ব পরিচিত নন। নুরুল হাকিম বাবুলকে মোটর সাইকেল সহ আটক করা হলেও শিশু আসামী মোঃ ওমর ফারুক তার মটর সাইকেলের আরোহী ছিলেন না।
আসামী নুরুল হাকিম বাবুল আদালতকে আরো জানায়, তার মানিব্যাগ থেকে ২০ পিচ ইয়াবা টেবলেট উদ্ধার করা হয়েছে। ১৪০০ পিচ ইয়াবা টেবলেট তার কাছ থেকে কখনো উদ্ধার করা হয়নি।
বিজ্ঞ বিচারক মোঃ নুরে আলম আদালতে উপস্থিত মামলার বাদী বিজিবি’র নায়েক মোঃ শহিদুল ইসলাম এবং আইও এসআই মুহাম্মদ ইয়াছিন থেকে মামলার এজাহার, এফআইআর, ফরোয়ার্ডিং, জব্দতালিকায় থাকা বক্তব্যের সাথে আদালতে উপস্থিত আসামীদ্বয়ের বক্তব্যের অসামঞ্জস্যতা নিয়ে জানতে চান। কিন্তু তারা ২ জনই এজাহার, এফআইআর, ফরোয়ার্ডিং, জব্দতালিকার বক্তব্যকে সমর্থন করে আদালতে জবানবন্দী দেন।
এ অবস্থায় বিজ্ঞ বিচারক মোঃ নুরে আলম জব্দকৃত মোটরসাইকেল, উদ্ধারকৃত মাদক সম্পর্কে এজাহার, এফআইআর, ফরোয়ার্ডিং, জব্দতালিকার সাথে আসামীদ্বয়ের দেওয়া বক্তব্যের ভিন্নতা দেখতে পান। মামলাটির তদন্ত এখনো চলমান। এ পর্যায়ে মামলার ঘটনার বিষয়ে সুস্পষ্ট মন্তব্য করা বিজ্ঞ বিচারক সমীচীন মনে করেননি বলে জানান, জ্যেষ্ঠ বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ শামীম। যা আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিজ্ঞ বিচারক মোঃ নুরে আলম তাঁর আদেশে আরো বলেন, মামলাটি সঠিক ও গ্রহনযোগ্য তদন্তের স্বার্থে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) পরিবর্তন করা আবশ্যক। বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে মামলাটি বিস্তারিত তদন্ত পূর্বক যথাযথ পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য পুলিশ পরিদর্শক পদ মর্যাদার একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে আদালত নির্দেশ দেন।
বিজ্ঞ বিচারক মোঃ নুরে আলম মামলাটি আদেশের পর্যবেক্ষণে বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকা হিসাবে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে রামু’র ৩০, বিজিবি ব্যাটালিয়ন কর্তৃক পরিচালিত রামু মরিচ্যা যৌথ চেকপোস্টটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উক্ত চেকপোস্টে নিয়মিতভাবে মাদকসহ বহু আসামী গ্রেপ্তার হয়ে থাকে। এই চেকপোস্টের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং প্রকৃত অপরাধ ও অপরাধীদের প্রশ্নাতীতভাবে বিচারের নিমিত্তে চেকপোস্টটিতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সিসি ক্যামেরা (ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা) স্থাপন করা প্রয়োজন।
একইসাথে দায়িত্বরত কর্মকর্তা কর্তৃক প্রত্যেকটি মাদক উদ্ধারের ঘটনা ভিডিও চিত্র ধারণ করলে এসংক্রান্ত দায়েরকৃত মামলা সমুহের সঠিক তদন্ত এবং বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তাই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য কক্সবাজারের শিশু আদালত-২ এর বিজ্ঞ বিচারক মোঃ নুরে আলম তাঁর আদেশে সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশ দেন।
নির্দেশের কপি অবহিতকরণের জন্য কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, বিজিবি’র মহাপরিচালক, কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার, কক্সবাজারের রামুস্থ ৩০, বিজিবি’র অধিনায়ক এবং রামু থানার ওসি’র কাছে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানান জ্যেষ্ঠ বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ শামীম।
কক্সবাজারের শিশু আদালত-২ এর বিজ্ঞ বিচারক মোঃ নুরে আলম এর এ আদেশে বিষয়ে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, এটি একটি যুগান্তকারী আদেশ। এ আদেশ একদিকে, সঠিক ও ন্যায় বিচার নিশ্চিতে সহায়ক হবে, অন্যদিকে, আইনশৃংখলা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আরো বাড়বে।
একই বিষয়ে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তারেক ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, এটি একটি স্মার্ট যুগের স্মার্ট আদেশ। এ আদেশ কার্যকর হলে তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ায় নতুনত্ব আসবে। বিচার বিভাগ ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস আরো বাড়বে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি বিভিন্ন সময়ে উঠা অভিযোগ হ্রাস পাবে এবং সাধারণ মানুষের অহেতুক বিড়ম্বনা অনেক কমবে বলে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তারেক মন্তব্য করেন।