নওগাঁ প্রতিনিধি: আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইনস ডে। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে এই দিনটিকে খুব ঘটা করে আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। এই দিনে পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো ভালোবাসার মানুষে পরিপূর্ণ থাকে। প্রিয়জনকে ভালোবেসে প্রায় সবাই ফুল ও বিভিন্ন সামগ্রী উপহার দিয়ে থাকেন। তবে আজকের এ ভালোবাসা শুধুই প্রেমিক আর প্রেমিকার জন্য নয়। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, প্রিয় সন্তান এমনকি বন্ধুর জন্যও ভালোবাসার জয়গানে আপ্লুত হতে পারে সবাই।
ভালোবাসার সেই পবিত্রতা বোঝাতেই এদিন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে নওগাঁর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যাল-২ ও শিশু আদালত-২ এর বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মো. মেহেদী হাসান তালুকদার। ভ্যালেন্টাইনস ডে তে এই আদালতে ৩৬টি মামলার শুনানীর জন্য পূর্ব থেকেই ধার্য রাখা হয়। এসব মামলার প্রত্যেকটিতেই রয়েছে অসময়ের প্রেমে জড়ানো রোমাঞ্চকর যুগলদের গল্প।
এদিন আদালত সূত্রে এসব গল্পের বেশ কিছু তথ্য জানা যায়, পত্নীতলা উপজেলার ১৭ বছর বয়সী জান্নাত (ছদ্মনাম)। তিন বছর আগে আত্রাই নদীতে গোসল করতে গিয়ে নদীর অপর পারে গোসল করা ২১ বছর বয়সী যুবক চম্পক কুমারের (ছদ্মনাম) সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।
ওই সময় জান্নাতের বয়স কেবল ১৪ বছর। ৯ম শ্রেণীতে পড়াশোনা করতেন স্থানীয় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। তাঁদের এই প্রেম কাহিনী অল্প সময়েই জেনে যায় জান্নাতের পরিবার। এরপর হতাশায় সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রেমিকের সাথে পালিয়ে একযোগে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় জান্নাত।
২০২১ সালের ২০ জুন প্রেমিকাকে পালিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি মন্দিরে শাখা সিঁদুর পড়িয়ে দেয় চম্পক। এরপর দুটো ওড়না গাছে বেঁধে আবারো আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় এ যুগল। আত্মহত্যায় ব্যর্থ হয়ে দুজন জড়িয়ে পড়েন শারিরীক সম্পর্কে।
এ ঘটনায় জান্নাতের বাবার দায়ের করা অপহরন মামলায় পরের দিন প্রেমিকাসহ পুলিশের হাতে আটক হন প্রেমিক। আটকের পর দুজনকে আলাদা করে প্রেমিককে কারাগারে এবং প্রেমিকাকে তাঁর পরিবারের জিম্মায় দেয় আদালত।
অন্যদিকে সাপাহার উপজেলার ১৬ বছর বয়সী কিশোরী আঁখি (ছদ্মনাম)। ৫ বছরের প্রেমের সুবাদে গত বছর স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় গত বছর ৯ জানুয়ারিতে প্রেমিক পরশ (ছদ্মনাম) এর কর্মস্থল ময়মনসিংহে পালিয়ে যান আঁখি। এরপর কোর্ট ম্যারেজ করে ময়মনসিংহে রাজমিস্ত্রী প্রেমিকের সঙ্গে একটি ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। সেখানে তাঁদের মাঝে শারিরীক সম্পর্কও হয়।
এরপর ২২ জানুয়ারিতে আবারো বাড়িতে ফিরে আসেন আঁখি। ততদিনে তাঁর বাবা পরশের বিরুদ্ধে অপহরন মামলা দায়ের করে রেখেছে। ওই মামলায় পরশকে আটক করে পুলিশ। এরপর আদালত ওই মামলায় পরশকে কারাগারে পাঠিয়ে আঁখিকে তাঁর পরিবারের জিম্মায় দেয়।
আবার করোনা ভাইরাসে যখন পুরো দেশ বিপর্যস্ত। আড়াই বছর আগে সেই করোনা টিকা নিতে গিয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন পোরশা উপজেলার ১৬ বছর বয়সী রুবাইয়া (ছদ্মনাম) প্রেমের পাঁচ মাসের মাথায় ২০২২ সালের ৯ জুলাই প্রেমিক জাহিদ (ছদ্মনাম) এর সঙ্গে ঘুরতে বের হন রুবাইয়া। সেই ঘুরতে যাওয়াটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় অসময়ের প্রেমে জড়ানো রুবাইয়ার। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি তাঁকে ঘুরিয়ে একটি মাদ্রাসায় নিয়ে যান জাহিদ।
পরবর্তীতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রেমিকাকে ধর্ষণ করেন। পরের দিন ভোরে পাশ্ববর্তী একটি বাসের যাত্রী ছাউনিতে প্রেমিকাকে রেখে পালিয়ে যান জাহিদ। পরে এ ঘটনায় রুবাইয়ার বাবা বাদী হয়ে জাহিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। পরে এ মামলায় পুলিশ প্রেমিক জাহিদকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়।
এদিকে ৩ বছরের প্রেমের সম্পর্কের সুবাদে সাপাহার উপজেলার ১৭ বছর বয়সী শ্রাবনী (ছদ্মনাম) তাঁর প্রেমিক রবিন্দ্রনাথ সরেন (ছদ্মনাম) হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। ২০২০ সালের ২২ জুলাই তাঁদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার মূল কারন ছিলো শ্রাবনী হিন্দু ধর্মের অনুসারী। বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ ছিলো আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর।
এছাড়াও শ্রাবনীর অন্যত্র বিয়ে ঠিক করেছিলো তাঁর পরিবার। প্রেমিকাকে নিয়ে টানা ৬দিন লাপাত্তা থাকার পর সাপাহারে শাখা কিনতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটক হন এই যুগল। এরপর শ্রাবণীর বাবার দায়ের করা অপহরন মামলায় রবীন্দ্রনাথ সরেনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
আবার ঢাকায় গার্মেন্টসে নারী শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ধামইরহাট উপজেলার মেহজাবিন (ছদ্মনাম)। সাড়ে ৩ বছর আগে ১৭ বছর বয়সী মেহজাবিন (ছদ্মনাম) এর সাথে পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হয় জয়পুরহাট জেলার জোভান (ছদ্মনাম) এর। বিয়ের দিন কালেমা পড়ানোর পর লোক খাওয়ানো নিয়ে পাত্র পক্ষ ও পাত্রীপক্ষের মাঝে শুরু হয় তুমুল ঝগড়া।
গন্ডগোলে বিয়ে ভাঙার এক সপ্তাহ পর ২০২০ সালের ২৮ ফ্রেব্রুয়ারি জোভানের বাড়িতে পালিয়ে যান মেহজাবিন। সেখানে দুইজন স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করতে শুরু করেন। এদিকে ওই ঘটনার জেরে জোভানের বিরুদ্ধে অপহরন মামলা দায়ের করেন মেহজাবিনের বাবা। সেই মামলায় ১১ দিন পর জোভানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
এমন অসংখ্য যুগলের মামলার শুনানি হয় বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে। এদিন আদালতে আসা যুগলের লাভ ক্যান্ডি দিয়ে শুভেচ্ছা জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবি (পিপি) মকবুল হোসেন। বিচারক মেহেদী হাসান তালুকদার ওইদিন বেলা ১১টায় এজলাসে বসে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেন।
সেখানে উপস্থিত উপস্থিত হওয়া যুগলদের অসময়ের প্রেমে না জড়িয়ে নিজেদের ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা, পিতামাতার আদেশ মেনে চলা, পড়াশোনা অব্যাহত রাখা, আত্মনির্ভরশীল হওয়া এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিয়োজিত থাকতে উদ্বুদ্ধ করেন বিচারক।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবি (পিপি) মকবুল হোসেন বলেন, আজ ভিন্নমাত্রায় আদালত বসেছে। ট্রাইব্যুনালের অসম প্রেমে জড়ানো ও তা থেকে অভিভাবকদের অপহরণ এবং বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের মামলাগুলো আজ শুনানির জন্য রাখা হয়। বিচারক মহোদয় সংশ্লিষ্টদেরকে পড়াশুনার পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধে ও গুরুজনদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলার উপদেশ দেন।
নওগাঁ জেলা আইনজীবি সমিতির সভাপতি এডভোকেট রফিকুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, মামলাগুলো ভিন্ন ভিন্ন দিনে শুনানি করলে বিচারক মহোদয় সবাইকে একই উপদেশ দিতে পারতেন না। মামলাগুলো একইদিনে শুনানির উদ্যোগ নিয়ে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।