প্রচলিত আইনগুলোকে বাংলায় ভাষান্তরিত করার দাবি দীর্ঘদিনের। সময়ে সময়ে এই দাবি সামনে এলেও এর বাস্তবায়ন দেখা গেছে খুবই কম। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং বিচারপ্রার্থীদের কাছে বিচার প্রক্রিয়াকে সহজ করে তুলে ধরার জন্য আইন বাংলা করার কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অবশেষে দেড়শো বছরের পুরনো ‘সাক্ষ্য আইন’ বাংলায় ভাষান্তর করে খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এর অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ অংশগুলোও চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ আইন কমিশন। খসড়াটির বাস্তবায়ন করা গেলে তা বিচারপ্রার্থীদের জন্য অনেক সহায়ক হবে বলেও মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
আইন কমিশন সূত্রে জানা যায়, এই অঞ্চলে ‘সাক্ষ্য আইন’ প্রথম কার্যকর হয় ১৮৭২ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এই আইনটি পরবর্তী সময়ে ‘ভারতীয় সাক্ষ্য আইন’ নামে পরিচিত হয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ‘ভারতীয়’ শব্দটি বিলুপ্ত করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনটি দেশের বিচার ব্যবস্থায় অন্যতম ‘পদ্ধতিগত আইন’ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিভিন্ন বিচার আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচারকার্য পরিচালিত হয়ে আসছে এই আইনের ওপর ভিত্তি করে।
তবে আইন কমিশন মনে করছে, যুগ ও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ ও সামাজিক বিরোধের ধরন ও প্রকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে। যার কারণে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের বিরোধ ও অপরাথের ধন পাল্টেছে, বিস্তৃতি লাভ করেছে। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনসহ অন্যান্য আইন আরও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। এটা দরকার এই কারণে যাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
খসড়া প্রস্তুত
আইন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সাক্ষ্য আইনের খসড়া তৈরিতে রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা, উচ্চ আদালতের সাবেক বিচারপতিরা, জেলা জজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবীসহ ৩৫০ অংশীজনের মতামত আহ্বান করা হয়। এদের অনেকেই মতামত দেন। সেই মতামত পর্যালোচনা করে কমিশন খসড়া প্রণয়ন করেছে। ইতোমধ্যে খসড়ার একটি কপি আইন মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হয়েছে।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিশন এই খসড়া প্রস্তুত করেছেন। কমিশনের অপর দুই সদস্য হলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর।
খসড়ার গুরুত্বপূর্ণ দিক
দেশের প্রচলিত আইনগুলোর মধ্যে সাক্ষ্য আইনটিও গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেসব গুরুত্ব বিবেচনায় প্রস্তাবিত সাক্ষ্য আইনের খসড়ায় দোষ স্বীকারোক্তির সুস্পষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া দলিল (ডকুমেন্টস) বলতে অডিও, ভিডিও, ডিজিটাল নথি, যে কোনও ধরনের ডিজিটাল উপাত্ত, কম্পিউটার কার্যক্রম, শব্দ বা চিত্র ধারণকারী যে কোনও ধরনের ডিস্ক বা টেপ ও অপর যে কোনও রকম উপাত্ত, ডিজিটাল স্বাক্ষর, সার্টিফিকেট ও ডিজিটাল মাধ্যমে করা যোগাযোগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হুমায়ন কবির পল্লব বলেন, ‘বাংলাদেশে যত আইন আছে, তার মধ্যে সাক্ষ্য আইন অন্যতম জটিলতম আইন। বাস্তবে একজন আইনজীবী বা আদালতের জন্য সাক্ষ্য আইনকে সঠিকভাবে বোঝা কঠিনতম বিষয়। এর কারণ হচ্ছে, এর ভাষাগত ব্যবহার অনেক শক্ত। এটাকে সহজ করলে বুঝতেও সহজ হয়।
তিনি জানান, ব্রিটিশ আমলে ১৮৭২ সালে জটিল ইংরেজি ভাষায় আইনটি করা হয়েছিল। তবে এটি সংশোধনসহ বাংলায় আইনে রূপান্তরিত করা গেলে এটি আদালত-আইনজীবী এবং সর্বোপরি বিচারপ্রার্থীদের মাঝে সমন্বয় তৈরি হবে। এতে মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশও উপকৃত হবে। আইনটি বাংলা করার উদ্যোগটি খুব ভালো বিষয়। সময়ের প্রয়োজনে এটি খুবই দরকার। একটি আইন যত সহজে বোঝা যাবে, আমরা সেই আইনের সুফল তত বেশি কাজে লাগাতে পারবো।
খসড়ার ওপর প্রস্তাবনা
প্রস্তাবিত খসড়ায় আইনগত পরিবর্তনে কিছু প্রস্তাবনা রেখেছে আইন কমিশন। এতে মৃত্যুকালীন ঘোষণার বিধানটি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘উক্ত ব্যক্তি যদি তার আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কা করে এবং উক্ত আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কা হতেই যদি তিনি বক্তব্যটি দিয়ে থাকেন, তাহলে যে কার্যধারায় তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে তার প্রকৃতি যেমনই হোক না কেন, সে বক্তব্যগুলো প্রাসঙ্গিক।’
কমিশন বলছে, অভিযুক্তের সাংবিধানিক ও প্রচলিত অন্যান্য আইনে স্বীকৃত অধিকার রক্ষা করে আইনানুগভাবে আদালতের সম্মুখে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা প্রয়োজন। এতে বলা হয়েছে, মামলার বিভিন্ন পক্ষের দ্বারা ‘যথেচ্ছা’, ‘অপ্রাসঙ্গিক’ সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন রোধ এবং কেবল প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোর সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সাক্ষ্য আইনের গুরুত্ব অপরিসীম। একই ধরনের মামলায় বিভিন্ন আদালত যাতে বিভিন্ন রকম সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ না করেন, তাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আবার পরিস্থিতি বিবেচনায় কতিপয় সাক্ষ্য গ্রহণ বা বর্জন বিষয়ে আদালতের সু-বিবেচনামূলক ক্ষমতার প্রয়োজন। অপ্রাসঙ্গিক ও পক্ষপাতমূলক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যেন কোনও ব্যক্তি তার আইনি অধিকার বঞ্চিত না হয় বা কোনও নিরপরাধ ব্যক্তির সাজা না হয়, তা নিশ্চিত করে আদালতে সঠিকভাবে সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ ও ব্যবহার সম্পর্কে যুগোপযোগী সাক্ষ্য আইন আবশ্যক।
এ বিষয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেন, ‘আইনের খসড়াটি আমরা যুগোপযোগী করেই তৈরি করেছি। আমার প্রত্যাশা এটি আইনে রূপান্তরিত হবে। ইতোমধ্যে আমরা ভূমি আইনের খসড়া করে দিয়েছি। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন নিয়ে কাজ করছি।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন