ব্যারিস্টার অনীক আর. হক: এই স্যান্ডেল জোড়ার ইতিহাস আছে। না এটা রামের খড়ম নয়, যে ভরত একে দিয়ে দেশ চালাবেন। এটা এক অসহায় বাবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
বছরটা ছিল ২০২২। আমার সুপ্রিয় কলিগ এবং আমার ঢাকা কলেজের ছোট ভাই অ্যাডভোকেট বাকির উদ্দিন হঠাৎ একদিন আমাকে এসে বলল, “ভাইয়া একটা কেস করে দিতে হবে”। আমি ওকে বললাম যে, ভাই তুমি নিজেই তো করতে পারো আমাকে কেন লাগবে? তখন বাকির বলল, ভাই আপনি কেসটা শুনেন তারপরে বলেন।
তারপর শুনলাম কেসটার ঘটনা। এক বাচ্চা ছেলে, তার নাম নাঈম হাসান নাহিদ। একদম নিম্নবিত্ত এক পরিবারের সন্তান। বাবা নিয়ামুল হোসেন সিলেট শহরের জুতো বিক্রি করে। কোভিডের সময়, যখন পুরো দেশ লকডাউনে, তখন কোন উপায় না পেয়ে জুতো বিক্রি বন্ধ করে তার পরিবার নিয়ে থাকেন ভৈরব শহরে এক বিশাল বাড়িতে, একটি ঘর কোনমতে ভাড়া নিয়ে আর সবজি বিক্রি করে। কিন্তু তার কোন নিশ্চয়তা নেই কারণ খদ্দের কোথায়?
এ অবস্থায় সেই বাড়ির মালিক আইয়ুব তাকে বলে, তোমার ছেলেটাকে আমার জাহাজ তৈরির ফ্যাক্টরিতে কাজে দাও, হালকা চা বানাবে, পরিষ্কার করবে। সপ্তাহে কিছু টাকা দেব। অসহায় বাবা আর কোন উপায় না দেখে নিজের এবং পরিবারের বাকিদের অন্নের সংস্থানে রাজি হয়ে যায়। শুরু হল নাঈমের এক নতুন যাত্রা।
প্রথম দুই তিন সপ্তাহ কেটে গেল সপ্তাহে দুশো টাকা করে দেয়। নাঈম পুরো টাকাটাই মাটির একটি ব্যাংকের মধ্যে রাখে। কিন্তু কদিন পরেই মালিক আর অন্য কর্মচারীরা বলে, একে বসিয়ে বসিয়ে কোন কাজ না করে টাকা দিব কেন? যা তুই এখন থেকে ড্রিল মেশিনের কাজ করবি।
ছোট্ট নাইম, তার বয়স তখন ১০, প্রতিবাদ করে বলে, না, আমি এ কাজ করতে পারবো না। কিন্তু আর এক কর্মচারী হাতুড়ি দিয়ে তার পিঠে মারে আর জোর করে হেভি ডিউটি ড্রিল মেশিনে কাজ করতে বাধ্য করে। এর মাঝে এসে আবার যখন তার মাথায় থাপ্পড় মারে শিশু নাঈমের হাতটি ঢুকে যায় ড্রিল মেশিনের মধ্যে আর ডান হাতের কনুই থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শিশু নাইম অজ্ঞান হয়ে যায়।
ওই পাষন্ড মালিক আর তার কর্মচারীরা নাইমের বাবা-মাকে কিছু না জানিয়ে প্রথমেই নিয়ে যায় উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সেখানে ডাক্তারেরা বলেন তারা এর চিকিৎসা দিতে পারবেন না তখন তার বাবা-মাকে না জানিয়ে তারা নিয়ে আসে একটি মাইক্রোবাসে করে নাঈমকে ঢাকায়।
এরপর ঢাকায় শ্যামলীর একটি ক্লিনিকের সামনে তাকে ফেলে চলে যায় সেই মালিক আর তার দলবল আল্লাহকে ধন্যবাদ যে সে ক্লিনিকের যারা ছিলেন তারা অজ্ঞান নাঈমকে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন এবং লাইনের বাবা-মাকে খবর দেন নাইমের বাবা-মা ছুটে আসে ঢাকায় ছেলের এই অবস্থা দেখে তাকে নিয়ে যায় রাজার বাগের একটি হাসপাতালে এবং সেখানে তারা কোন উপায় না দেখে ডান হাতের কনুই থেকে নিচ পর্যন্ত হাত কেটে ফেলে কারণ তা নাহলে আর নাইম কে বাঁচানো যাচ্ছিল না।
অনেকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়, প্রচুর বিল জমে যায়। কিন্তু তার খরচ কেউ দিতে চায় না, উল্টো সেই মালিক আর তার দলবল ভয় দেখায় নাঈমের বাবাকে। এ সময় খবরের কাগজে এই খবরটি ছাপা হয় আর আমার ছোট ভাই বাকির হাইকোর্ট একটি রিট ফাইল করে সেই খবর পড়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে।
মামলাটি তখন মাননীয় বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের আদালতে শুনানির জন্য রয়েছে। এমন সময় আমার সাহায্য চাইলো যেন আমি মামলার শুনানিটি করে দেই।
আমি পুরো ঘটনাটা শুনে এবং কাগজপত্র দেখে এত দুঃখ পাই মানুষের অমানুষিকতা দেখে, বাকিরকে বলি আমি অবশ্যই এই মামলাটা করব।
প্রথম যেদিন শুনানি হয় তখন আমি পুরো ঘটনাটা আমাদের আদালতে তুলে ধরি। মাননীয় আদালত দেখলাম প্রচন্ড সেন্টিমেন্টাল হয়ে গেলেন। তিনি আমার অপরপক্ষের আইনজীবীকে বললেন, এরকম কাজ কি কোন মানুষ করতে পারে?
এর মাঝে একদম প্রথমে যখন রুল দেওয়া হয়েছিল, তখন একটি রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হয় ডিসিকে। ডিসি সাহেব রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন। সেখানে শ্রম অধিদপ্তর থেকে শুরু করে সবার বক্তব্য নিয়ে, সবার কাছ থেকেই আয়ুবের দোষ সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকলেও, ডিসি সাহেব তার মন্তব্যে বললেন, ঠিক বুঝা যাচ্ছে না যে এখানে বাচ্চাটি শ্রমিক হিসেবে ছিল কিনা! যদিও শ্রম অধিদপ্তর তাদের নিজেদের বক্তব্যে এবং রিপোর্টে শিশুশ্রম ছিল সেখানে বলে মন্তব্য করে এবং সে বিষয়ে মামলাও করে। আমার কাছে এখনো ঠিক বোধগম্য নয় ডিসি সাহেব তার এই উপসংহারে কিভাবে পৌঁছেছিলেন!!
আরও পড়ুন: শিশুশ্রমের করুণ পরিণতির শিকার নাঈমের পক্ষে হাইকোর্টের অনবদ্য রায়
যাই হোক বিচারপতি কাদের বললেন, আপনারা দুই পক্ষের উকিলেরা ঠিক করেন কত টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে পারবেন, কত টাকার ক্ষতিপূরণ নিলে আমরা সন্তুষ্ট হবো। তারপরে আমরা একদিন আমরা উকিলেরা বসলাম এবং আমাদের দাবি ছিল দুই কোটি টাকা তারা আমাদের দিতে চাইলেন তিন লক্ষ টাকা। আমরা পরে আবারো কামরুল কাদের সাহেবের কাছে যেয়ে বললাম যে, আমাদের পক্ষে কোন সমঝতায় আসা সম্ভব হচ্ছে না।
কামরুল কাদের সাহেব আমাদের নির্দেশ দিলেন আমরা যেন ওই ওই লোকের আর্থিক সক্ষমতা সম্পর্কে একটা এফিডেভিট দিতে। আমরাও নিজেদের খরচে সেখানকার তার ফ্যাক্টরির ছবি, তার বাড়ির ছবি, তার যা যা স্থাবর আস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে তার বিবরণ জমা দিলাম। তারাও তার গত বছরের ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিল, যা দেখে মনে হল যে পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র ব্যক্তি হচ্ছে সেই লোক, যদিও তার বিশাল জাহাজের ফ্যাক্টরির ছবি আমরা সবাইকে দেখিয়েছি।
যারা আমাদের হাইকোর্ট সম্পর্কে জানেন তারা জানেন যে কাদের সাহেবের আদালতে এত মামলা থাকে যে মামলার শুনানি করা খুব কঠিন এমন করতে করতে কেটে গেল ২০২২।
প্রতি সপ্তাহের বুধবারে মামলাটা লিস্টে আসতো আর নাঈম তার বাবার হাত ধরে আবার রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। ওকে দেখতাম আর নিজের কাছে নিজেকে দায়ী করতাম, কেন কিছু করতে পারছি না? বাকিরের জুনিয়ারেরা, আমার জুনিয়ারেরা কোর্টের যে বসে থাকতো, মামলা কাছাকাছি গেলেই আমাদেরকে জানাত আমরা দৌড় দিয়ে যেতাম কিন্তু কোন এক ভাগ্যচক্রে মামলাটা পর্যন্ত পৌঁছানো যেত না।
এরপর কাদের সাহেবের আদালত পরিবর্তন হয়ে গেল অর্থাৎ তার সাথে যিনি জুনিয়র জাজ বসতেন তার পরিবর্তন হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন কাদের সাহেব বললেন, যে মামলা গুলো এর আগে আংশিক শ্রুত ছিল সেগুলোকে তিনি আউট অফ লিস্ট করে দিচ্ছেন, যে শুনানি হয়নি একথা বলে। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল আমাদের। কারণ এত কষ্টে সবকিছু শেষের পথে এসে যখন এরকম একটি ঘটনা ঘটে তখন মনটা ভেঙে যায়। ইতোমধ্যে জাহাজের মালিক নিয়ে আসলেন সাবেক মন্ত্রী কামরুল সাহেব কে তার আইনজীবী হিসেবে।
তখন পুরো লিস্ট ঘেঁটে বাকির ঠিক করলো এই মামলাটিকে আমরা এখন বিচারপতি নাইমা হায়দার এবং বিচারপতি কাজী জিনাত হকের আদালতে দিবো আমিও। অত্যন্ত খুশি মনে বললাম হ্যাঁ এখানেই দেওয়া যাক আমরা এখানে ন্যায় বিচার পাবই।
এখন কিন্তু সময়টা প্রায় নভেম্বরের শেষ দিকে ২০২৩ সালের সেই দিন আমি দাঁড়ালাম বিচারপতির নাইমা হায়দারের সামনে এবং আবারও পুরো ঘটনাটি বললাম। আমার বলার সময় নিজের গলা ধরে আসছিল কারণ এই নৃশংস ঘটনা নরমাল ভাবে বলাটা অসম্ভব। আমার পরে দাঁড়িয়ে কামরুল স্যার বললেন এরকম কোন ঘটনাই না এই ছেলে ওখানে ছিল না, ডিসির রিপোর্টটা পড়ে দেখুন।
তখন আমি ডিসির রিপোর্টটা পুরোটা পড়ে শোনালাম যেখানে দেখা গেল যে সবাই বলেছে হ্যাঁ এই দুর্ঘটনা ওখানে ঘটেছে কিন্তু ডিসি সাহেব শেষ লাইনে এসে কেমন যেন এক অদ্ভুত উপসংহার টানলেন। আমাদের দেশের যত ক্ষতিপূরণের মামলা আছে, ভারতের অনেকগুলো মামলা রেফারেন্স দিলাম বিচারপতিদের।
বিচারপতি নাইমা হায়দার শিশু নাঈমকে ডেকে নিয়ে এলেন সামনে, তার নিজের জবানিতে সেদিনকার ঘটনা শুনলেন এবং সব শুনে নাঈমকে চকলেট দিলেন। বিচারপতি কাজী জিনাত হক, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যদি একটি যান্ত্রিক হাত বানিয়ে দেওয়া যায় তাহলে কত খরচ হতে পারে? সেদিন পুরো আদালতে কেউ বোধহয় তাদের আবেগকে সামলাতে পারেননি।
তারপরে বিচারপতি নাইমা হায়দার বললেন শুনানি শেষ। এরপরে আমরা একদিন রায় দেব।
এর পরের ঘটনা তো আপনারা জানেন ঐতিহাসিক রায় ৩০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার এবং এইচএসসি পর্যন্ত নাঈমকে প্রতি মাসে ৭০০০ টাকা করে দেওয়ার আদেশ প্রদান করলেন আদালত।
মামলাটি আমিও বাকির দুজনেই সম্পূর্ণ বিনা খরচে অর্থাৎ Pro bono হিসেবে করেছি। কিন্তু শিশু নাইমের বাবা তার নিজের সংগতিতে যা কুলায়, তার নিজের পক্ষে যা সম্ভব, সেই ভাবে আমাদের নিজের হাতে বানিয়ে এই জুতোটি দিয়েছে।
আমি এখন পর্যন্ত এই জুতোটি পায়ে দিইনি। যতদিন না পর্যন্ত সেই পাষণ্ড মালিক তার প্রাপ্য পুরো টাকাটি না দিচ্ছে, ততদিন আমি তুলে রাখবো।
আমার ওকালতি জীবনে অনেক মামলা করেছি অনেক ফি পেয়েছি। কিন্তু আমার সব ফি এর চাইতে এই জুতোটি বোধ হয় সবচাইতে দামি।
রায় প্রকাশের দিন যখন আমাকে ধরে হাউমাউ করে নাঈমের বাবা কাঁদছিল তখন আমার মনে হয়েছিল এর চাইতে দামি কোন মামলা আমি করিনি।
হয়তো এ জীবনে আর করতেও পারবো না।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।