বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল:
মাতৃভাষা
একটি জাতির মাতৃভাষা তার আত্মপরিচয়। পৃথিবীর একমাত্র জাতি বাঙালি জাতি, যে জাতিকে তার মুখের ভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য তথা আত্মপরিচয়ের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে এবং সংগ্রাম করতে হয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো জাতিকে তার মুখের ভাষা তথা মাতৃভাষার দাবিতে জীবন দিতে হয়নি, সংগ্রাম করতে হয়নি।
১৯৪৭ সাল থেকে বাঙালি জাতি ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভাষার অধিকার আদায়ের নিমিত্তে সংগ্রাম শুরু করে। বাঙালির মনে স্বাধিকার চেতনা ও স্বাধীনতার স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর দূরদর্শী ভাবনা, অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অনন্য সাংগঠনিক দক্ষতা ও অসীম সাহস এই পরাধীন জাতিকে আত্মসচেতনায় দীপ্ত করে এক ঐক্যে, এক অভিপ্রায়ে মিলিত করেছিল।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্থির, অচঞ্চল কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক’ (ভাষাসৈনিক ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট গাজীউল হক লিখিত ‘উচ্চতর আদালতে বাংলা প্রচলন’ নামক বইয়ের ‘আরো কথা’ শিরোনামে লিখিত মুখবন্ধ থেকে উদ্ধৃত, যা বাংলাদেশ আইন সমিতি কর্তৃক ‘উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার, প্রয়োজনীয় ও সীমাবদ্ধতা’ শীর্ষক বইয়ের ১০২ পৃষ্ঠায় পুনঃমুদ্রিত।)
১৯৪৮ সালে তথাকথিত পাকিস্তানে যখন সংবিধান পেশ করা হয় তখন বাংলা ভাষার ওপর আঘাত আসে। অতঃপর ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, অতঃপর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পুলিশ বাহিনীর রাইফেলের নলের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, রফিকুদ্দিন আহমেদ এবং আব্দুস সালাম নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ভাষাশহীদ সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউর রহমানসহ অজস্র শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মাতৃভাষা।
একুশ আমাদের শেখায় যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। একুশ আমাদের শেখায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির শ্লোগান:
‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’
‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু কর।’
‘মাতৃভাষা হবে শিক্ষার বাহন’
‘আইন আদালতের ভাষা হবে বাংলা।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীনের পূর্বেই ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানের উদ্ধোধনী ভাষণে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন,
‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন তারপরে বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন। আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তার সংশোধন করা হবে।’
সংবিধান বিল উত্থাপন প্রসঙ্গে আইন ও সংসদীয় বিষয়াবলি এবং সংবিধান প্রণয়ন মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন তাঁর ভাষণে বলেন,
‘বাংলা ভাষায় খসড়া সংবিধান পেশ করতে পেরেছি, এ কারণেও আজকের দিন আমাদের জন্য অত্যন্ত সুখের দিন। বাংলা ভাষার ইতিহাসেও এটা স্মরণীয় ঘটনা। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন আমাদের জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের যে মহান পর্ব রচনা করেছিল, তার যোগ্য পরিণতি আজ ঘটল। বাংলা ভাষায় সংবিধান-রচনার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটির কাছে যে সাহায্য আমরা পেয়েছি, তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করছি। এই কমিটির সদস্য ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ড. মযহারুল ইসলাম এবং এর কনভেনার ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. আনিসুজ্জামান, যিনি সংবিধান রচনার কাজের শুরু থেকে আমাদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।’
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সূচনা করেছিল। জাতির পিতা জনগণের নিকট দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। তাই তো আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ; যার সংবিধান বাংলায় লেখা হয়েছে এবং যার সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রভাষা একটি এবং তা হলো বাংলা ভাষা। জন্ম হয়েছে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩ নিম্নে অনুলিখন হলো:
‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’
সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩ মোতাবেক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। অর্থাৎ এই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সুপ্রিম কোর্ট এই প্রজাতন্ত্রের একটি বিভাগ। সুতরাং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সংবিধান মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টের ভাষাও অবশ্যই বাংলা। সংবিধানে বাংলা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষার ব্যবহার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য উল্লেখ নেই।
সুতরাং এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়; সংবিধান মোতাবেক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা একমাত্র ‘বাংলা ভাষা’। সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল কর্ম শুধু বাংলা ভাষায় হবে। সংবিধান মোতাবেক প্রজাতন্ত্রের তিনটি বিভাগ। আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। সংবিধান মোতাবেক উপরোক্ত তিনটি বিভাগেরই একমাত্র ভাষা বাংলা ভাষা।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭ মোতাবেক এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। সাংবিধানিক পদাধিকারী সকল ব্যক্তিই এই মর্মে শপথ পাঠ করেন যে, তিনি এই সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করেন। এর অন্যথা অর্থ সংবিধান ভঙ্গ করা। সুতরাং এটা কাচের মতো পরিষ্কার যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা যদি বাংলায় রায় না লেখেন তবে তা হবে সেই বিচারপতির শপথ ভঙ্গ এবং সংবিধান ভঙ্গ।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১১ মোতাবেক প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে। আদালতসহ প্রজাতন্ত্রের সকল কর্ম বাংলায় না হলে জনগণের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে বাধ্য।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৯ মোতাবেক সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে। কিন্তু বাংলায় রায় না দেওয়া অর্থ হলো নাগরিকের সমতার নিশ্চয়তা আর থাকে না।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২৩ মোতাবেক রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির অবদান রাখার ও অংশগ্রহণ করার সুযোগ লাভ করতে পারেন। বাংলায় রায় প্রদান না করলে জাতীয় ভাষার পরিপোষণ ও উন্নয়ন কীভাবে হবে?
সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২৭ মোতাবেক সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বাংলা ভাষায় রায় প্রদান না করে পরভাষা তথা বিজাতীয় ভাষা ইংরেজিতে প্রদান করায়, জনগণ তার সংবিধান প্রদত্ত ওপরে উল্লিখিত অন্যতম মৌলিক অধিকার তথা আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানে অভিভাবক হিসেবে মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হবেন, সেই সুপ্রিম কোর্ট কিনা বাংলায় রায় ও আদেশ প্রদান না করে নিজেরাই জনগণের মৌলিক অধিকার হরণের কারণ হচ্ছেন।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩১ মোতাবকে আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। বাংলাদেশের জনগণ তার সংবিধানসম্মত অধিকার তথা আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভের যে অবিচ্ছেদ্য অধিকার তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ বাংলায় রায় ও আদেশ পাওয়া প্রত্যেক বাঙালির অবিচ্ছেদ্য অধিকার তা থেকে বাঙালিরা বঞ্চিত হচ্ছে তথা বাঙালিরা সংবিধান অনুযায়ী তথা আইনানুযায়ী ব্যবহার পাচ্ছে না।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের কালবিলম্ব না করে বাংলায় রায় লেখার আহ্বান জানান। পরদিন ১৯ ডিসেম্বর সকল জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য ছাপা হয়। নিম্নে কয়েকটি পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে কিয়দংশ তুলে ধরা হলো:
১৯৭২ সালের ১৯ ডিসেম্বর রোজ মঙ্গলবার দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনটি নিম্নরূপ:
বর্তমান সরকার আইনের শাসনে বিশ্বাসী
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, তাহার সরকার আইনের শাসনে বিশ্বাসী। তিনি বলেন যে, আইনের শাসন কায়েমের জন্যই জাতিকে এত তাড়াহুড়া করিয়া একটি সংবিধান প্রদান করা হইয়াছে।
গতকল্য (সোমবার) অপরাহ্ণে বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু এই ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁহার ২০ মিনিট কাল স্থায়ী ভাষণে বলেন, ‘আমরা আইনের শাসন বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করিয়াছি এবং বাংলাদেশের স্বাধীন মাটিতে সুপ্রীম কোর্টে পালিত হওয়ায় আমরা আনন্দিত হয়াছি। তিনি আরও বলেন যে, সুপ্রীম কোর্ট ব্যতীত জাতি চলিতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু আরও বলেন যে, মৌলিক মানবিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও আইনের শাসন ব্যতীত কোন জাতিই পূর্ণতায় পৌঁছিতে পারে না। সংবিধান প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচন ছাড়াই তাহার দল আরও অনেক দিন ক্ষমতায় থাকিতে পারিত। কিন্তু তাহা করা হয় নাই। তিনি বলেন, ‘এইভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকিতে আমরা চাহি নাই, কারণ আইনের শাসনে আমরা বিশ্বাস করি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই আমরা এতদিন সংগ্রাম করিয়া আসিয়াছি।’
বঙ্গবন্ধু বলেন: ‘ক্ষমতা দখলের জন্য আমরা রাজনীতি করি না।’
তবে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন যে, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ অর্থে ইহা প্রশাসনযন্ত্রের সহিত সম্পূর্ণ ‘একঘরে’ উহা বুঝায় না। কারণ এক বিভাগ আরেক বিভাগের পরিপূরক।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, একে অন্যের হস্তক্ষেপ ছাড়াও রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ প্রশাসন, বিচার ও আইন রাষ্ট্রের ৪টি মূলনীতির ভিত্তিতে একে অন্যের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ চালাইয়া যাইতে হইবে।
বঙ্গবন্ধু বলেন যে, রাষ্ট্রের ৪টি মূলনীতি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রহিয়াছে। তিনি বলেন, আমরা বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ করিতে চাহি না, তবে আমরা আশা করিব যে, আপনারা দেশের বর্তমান অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুসারে কাজ করিয়া যাইবেন। পূর্বাহ্নে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জনাব সায়েম প্রধামন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাইয়া ভাষণ দান করেন।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সুপ্রীম কোর্টের নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে, বাংলা ভাষায় কোর্টের কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযোগিতা প্রদান করিবেন। ইহা ছাড়া কোর্টের কাজের জন্য সম্ভাব্য সংখ্যক বাংলা টাইপ রাইটার প্রদানের ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়তা দান করেন।
১৯৭২ সালের ১৯ ডিসেম্বর রোজ মঙ্গলবার দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনটি নিম্নরূপ:
‘বাংলা প্রবর্তন’
আইন সংক্রান্ত শব্দাবলীর বঙ্গানুবাদের সুবিধার্থে একটি কমিশন গঠনের জন্য প্রধান বিচারপতি জনাব এ এম সায়েম যে প্রস্তাব রাখেন তার সাথে দ্বিমত প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, এ পদ্ধতি আদালতের কার্যক্রম বিলম্বিত করবে। তিনি মাননীয় বিচারপতিদের রায় বাংলায় দেয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, আদালতের কাজে বাংলা প্রবর্তনের সকল প্রচেষ্টায় সরকার সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাবে। সুপ্রিম কোর্টের জন্য সরকার শিগগিরই বাংলা টাইপ রাইটার সংগ্রহের ব্যবস্থা করবে। এছাড়াও বাংলা সাঁটলিপি পাঠও প্রবর্তন করা হবে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ এডভোকেটদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন। এই সব মহান দেশপ্রেমিকের উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির জন্য তিনি প্রস্তাব করেন। বার সমিতি ভবনের নির্মাণ কাজ শীগগীরই পুনরারম্ভ হবে বলে তিনি আশ্বাস দান করেন।’
১৯৭২ সালের ২৯ ডিসেম্বর রোজ মঙ্গলবার দৈনিক মর্নিং নিউজ (The Daily Morning News) পত্রিকায় প্রকাশিত সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনটি নিম্নরূপ:
The guiding ideals in every walk of our life. It is against this background, the Bangabandhu added, complete independence, of judiciary did not carry a constructive meaning. The judiciary has also to play it role in such a manner that its actions did not contribute to chaos and disorder in country.
The Prime Minister said we all want Rule of Law’ but it proper working and establishment would depend on how we execute it; The Constitution should be given a fair trial and the judiciary has been empowered to interpret laws, he added.
He said the Supreme Court has an important responsibility in the execution of the pour state principle we do not want to interfere in your functioning but we hope you would he guided by the conditions and salutation in the country.
The Prime Minister retired to in a suggestion made by the Chief Justice of Supreme Court Mr. Justice A.M. Sayem in his address of welcome and said it would virtually amount to wastage of time a commission was appointed to find Bengali worlds for legal English terms.
He said we are all trying to conduct official business in Bengali and the same way the court should also make efforts. The difficulties in the way are not expected in view of the hangover of British legacy, but was should continue to make efforts without delay.
The Prime Minister assured the Supreme Court that the government that the government world extend every possible assistance to help them work in the mother tongue. He also held out the assurance that the courts could be given as many, Bengali typewriters as possible.
The prime Minister said people expect just from the judiciary and the proper functioning of the three organs of the states in interlinked and interdependent. Hence co-operation between them is essential rater that their working in water-tight compartments.
উপরোল্লিখিত পত্রিকায় সংবাদ পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অতি দ্রুত সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বাংলায় রায় ও আদেশ প্রদানের জন্য আহ্বান জানান এবং এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলা হয়।
এতদ্বসত্ত্বেও, স্বাধীনতার তিন বৎসর পর; জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত বিষাদের সঙ্গে লক্ষ করলেন বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা বাংলা থাকা সত্ত্বেও সরকারি অফিস এবং আদালতে অবাধে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষার চর্চা চলছিল। এর প্রেক্ষিতে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে একটি সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন (বাংলা ভাষা প্রচলন সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশ, ১৯৭৫ রাষ্ট্রপতির সচিবালয়, গণভবন, ঢাকা সংখ্যা ৩০.১২.৭৫, সাধারণ-৭২৯/১(৪০০) ১২ই মার্চ, ১৯৭৫)। তাঁর গভীর হতাশা ব্যক্ত করেন এবং এ প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেন, যা নিম্নে অনুলিখন হলো:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।
বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা।
তবুও অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ করেছি যে, স্বাধীনতার তিন বৎসর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজী ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে।
মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই দেশের প্রতি তার ভালবাসা আছে একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
দীর্ঘ তিন বৎসর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালী কর্মচারীরা ইংরেজী ভাষায় নথি লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেয়া যেতে পারে না।
এ আদেশ জারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধা-সরকারী অফিসসমূহে কেবলমাত্র বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে এ বিষয়ে কোন অন্যথা হলে উক্ত বিধি লংঘনকারীকে আইনানুগ শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করা হবে।
বিভিন্ন অফিস-আদালতের কর্তাব্যক্তিগণ সতর্কতার সাথে এ আদেশ কার্যকরী করবেন এবং আদেশ লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করবেন।
তবে কোন বিদেশী সংস্থা বা সরকারের সাথে পত্র যোগাযোগ করার সময় বাংলার সাথে ইংরেজী অথবা সংশ্লিষ্ট ভাষায় একটি প্রতিলিপি পাঠানো প্রয়োজন। তেমনিভাবে বিদেশের কোন সরকার বা সংস্থার সাথে চুক্তি সম্পাদনের সময়ও বাংলার সাথে অনুমোদিত ইংরেজী বা সংশ্লিষ্ট ভাষার প্রতিলিপি ব্যবহার করা চলবে।
বাংলা ভাষা প্রচলনসংক্রান্ত সরকারি নির্দেশ, ১৯৭৫ পাঠে এটা সুস্পষ্ট যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কি প্রচ- ক্ষুব্ধ এবং মর্মাহত হয়েছিলেন, যখন তিনি জানতে পারলেন এদেশের লোকেরাই কীভাবে এদেশের নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করে তথা সংবিধান ভঙ্গ করে বিজাতীয় পরভাষা ইংরেজিতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তিনি তাদের উচ্ছৃঙ্খল বলেছেন। তিনি তাদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন, পরিশেষে তিনি তাদের শাস্তির নির্দেশও প্রদান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আজ একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যদি জাতির জনক বেঁচে থাকতেন তাহলে বহু আগেই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ প্রদান করতেন।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালের ১ মার্চ ঢাকায় বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমাদের পবিত্র সংবিধানে আছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ আর প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সকল আদালতই এই প্রজাতন্ত্রের আদালত।’
কবি আব্দুল হাকিম (১৬২০ খ্রিষ্টাব্দ-১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দ) তার কবিতায় বলেছেন যে,
‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’
ভাষাসৈনিক এবং একুশে আন্দোলনের শীর্ষ নেতা আব্দুল মতিন বলেছেন যে, ‘আইনের সর্বক্ষেত্রে আমরা বাংলাকে প্রয়োগ করতে পারি এবং আমি দু’ একটি লোয়ার কোর্টের রায়ে দেখেছি, বাংলায় যখন রায় হয় তখন বেশ বুঝতে পারা যায় বরং ইংরেজি ভাষায় রায় দেওয়া হলে অনেক সময় বুঝতে পারা যায় না। এত জটিল ভাষা এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, তার নিরিখে করা কঠিন হয়ে পড়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য। তো, এখন আমরা কোথায় যাব? বহু সাধনা, বহু রক্তের বিনিময়ে আমরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা অর্জন করেছি, আমরা যেন একে রক্ষা করতে পারি। যে যত বিরোধিতা করুক, যে যতই কষ্ট করুক এর অবমাননা হতে দেওয়া যায় না।’ (বাংলাদেশ আইন সমিতি কর্তৃক উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার-প্রয়োজনীয়তা ও সীমাবদ্ধতা, পাতা-৩৩)।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় আইনচর্চার পথিকৃৎ গাজী শামছুর রহমান বলেছেন যে, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা, তা সংবিধান বলে দিয়েছে। সংবিধান বলেনি যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে, ভবিষ্যৎব্যঞ্জক কোন উক্তি সংবিধানে নেই। সুতরাং বাংলা ভাষা আইনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে কিনা, সে প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর। সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়েই আছে।
আইনের পরিভাষার মূল সাহিত্য বা রম্য রচনার তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক পারিভাষিক শব্দকে সাধারণভাবে আইনের ক্ষেত্রে একটিমাত্র অর্থ বহন করতে হয়।
আইন বিষয়ে অনেক বই রচনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। চারটি ছাড়া অন্য সবগুলো বই বাংলাতে লেখা। এই কাজ করতে গিয়ে আমার নিশ্চিত প্রতীতি জন্মেছে যে বাংলা ভাষার শক্তি এবং যোগ্যতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ মূর্খতারই নামান্তর। পরাধীনতাজনিত হীনম্মন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারলে এই সংশয় আর থাকে না। তদুপরি একখানি পরিভাষা টেবিলে থাকলে ভাষান্তরকালে সাময়িক অসুবিধা থেকে সহজেই পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
দেশের আইন এখনো ইংরেজি ভাষার নিগড়ে আবদ্ধ। ঐ নিগড় ভেঙে আইনকে মুক্তি দিতে হবে।’ (বাংলাদেশ আইন সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার-প্রয়োজনীয়তা ও সীমাবদ্ধতা পাতা-৯৭)।
ভাষাসৈনিক ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট গাজীউল হক বলেছেন যে, ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিক-এর মা একদিন জানতে চেয়েছিলেন আমি হাইকোর্টে যে আইন ব্যবসা করি তাতে বাংলা ভাষার ব্যবহার করি কি না? ভাষাসৈনিক সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের একজন হয়ে মিথ্যে বলতে পারিনি। বললাম, আমরা এখনো হাইকোর্টে বা সুপ্রিম কোর্টে বাংলা ভাষায় আরজি বা জবাব লিখি না, সওয়াল জবাব করি না। এরপর ভাষা শহীদ রফিকের মা রফিজা খানমের মৃদু কথাটি তিরস্কারের মতো আমার কানে বাজল। ছোট্ট করে কথাটা স্বগতোক্তির মতো বললেন, তাহলে রফিকেরা প্রাণ দিলে কেন? আর কোন কথা না বলে মা ছোট্ট ছোট্ট পায়ে আমার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে শহীদ মিনার থেকে নেমে এসেছিলেন। মায়ের সেই ছোট্ট স্বাগতোক্তি আমাকে ভীষণভাবে লজ্জা দিয়েছিল। বলেছিলাম এরপরে বাংলায় লিখব। তারপর থেকেই বাংলা ভাষায় হাইকোর্টের দেওয়ানি, ফৌজদারি রিট মামলার আমি জবাব লেখা শুরু করলাম। এই ব্যাপারে সাহায্য করলেন আমার প্রিয় সহকর্মী আইনজীবীগণ সর্ব অ্যাডভোকেট ওজায়ের ফারুক, সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, মাহবুব শামসুদ্দীন বাবুল, জাফর, রুহুল আমীন ভূঁইয়া। এরা সকলেই বিচারপতিদের মধ্যেও জনাব আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, জনাব নাঈম উদ্দিন আহম্মদ প্রভৃতি বিচারপতিগণ বাংলায় আদেশ দান এবং রায় লেখা শুরু করলেন। (বাংলাদেশ আইন সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত ‘উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার-প্রয়োজনীয়তা ও সীমাবদ্ধতা’ পাতা-১০২)
বাংলাদেশ আইন সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত ‘উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার-প্রয়োজনীয়তা ও সীমাবদ্ধতা’ বইয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের সাবেক মাননীয় প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছেন যে, “ন্যায়বিচার যদি সদগুণ হয় এবং জনগণের কল্যাণের জন্যই যদি এর কাজ হয়, তবে তা জনগণের ভাষাতেই হওয়া উচিত। আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা মাতৃভাষার মাধ্যমে যত তাড়াতাড়ি বোঝা, শেখা বা শেখানা যায়, তা পরভাষায় সম্ভব নয়। আমাদের ভাষায় পারঙ্গমতা সম্পর্কে আমরা অহেতুক সন্দিহান। দেশের আদালতে যে দ্বৈতশাসন চলছে নিচের আদালতে বাংলা এবং ওপরের আদালতে ইংরেজি তার আশু অবসান হওয়া প্রয়োজন।
যে-ভাষায় বাংলাদেশের সংবিধানের মতো একটি জটিল বিষয় বিবেচনা করা সম্ভব হয়েছে, হেন মানবিক সমস্যা নেই, যার ওপর সেই ভাষায় কোন সহজ সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব নয়। পরভাষার আইনচর্চার ফলে আমরা যেমন আইনশাস্ত্রে স্বাভাবিক সহজতা লাভ করিনি, তেমন কোনো মৌলিক অবদানও রাখতে পারিনি।
আইন ও বিচার তো দেশের লোকের জন্য। বিদেশিদের সুবিধা-অসুবিধা গৌণ ব্যাপার। দেশের রায় বাংলায় লিখতে হবে, যাতে নিরক্ষরও শুনলে কিছু বুঝতে পারে। বিদেশিদের অসুবিধা এখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। সব সন্দেহ নিরসনকল্পে সংসদের দ্ব্যর্থহীন উদ্যোগ নেওয়া উচিত। দেশের সাধারণ মানুষ যাতে আদালতে সহজে প্রবেশাধিকার পায়, সে কথা ভেবে ইংল্যান্ডে লর্ড উলফ তাঁর অ্যাকসেস টু জাস্টিস-এ অবোধ্য ও স্বল্পব্যবহৃত লাতিন শব্দ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেন। ‘আমরা কি যাব না তাদের কাছে, যারা শুধু বাংলায় কথা বলে?’ এই আর্ত প্রশ্ন আমরা অনেকবার করেছি। আমরা উত্তর পাইনি।
অনেকের ধারণা, বাংলায় লেখা হলে আমাদের রায় কেউ পড়বে না। আমাদের রায় পড়ার জন্য যেন সারা বিশ্ব রাত জেগে বসে আছে! যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের স্বার্থ জড়িত এবং বাণিজ্যেক সম্পর্ক, সেসব দেশের বেশ কিছু লাইব্রেরিতে গিয়ে আমি দেখেছি, সেখানে বাংলাদেশের ল জার্নাল বা বই নেই বললেই চলে।
যাঁরা ফিয়ের জন্য হুজ্জুতে অজুহাত দিতে পারদর্শী, তাঁরা বলেন, সংবিধানে কোথাও বলা হয়নি, সব ধরনের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ বাংলায় করতে হবে। ইংরেজি ব্যবহার সংবিধান পরিপন্থী হবে না। সংবিধান ইংরেজিকে বাদ দেয়নি, বরং ইংরেজি টেক্সটের বিধান করে দিয়ে ইংরেজিকে গ্রহণ করেছে, ইংরেজিকে একটি ভাষার মাধ্যম হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছে। তাঁরা এমন কথাও বলেন যে, স্বাধীনতার অব্যাবহিত পরে অন্যন্যোপায় হয়ে শিল্পের জাতীয়করণ করে আমাদের অব্যবস্থা ও দুর্গতি হয়েছিল, রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে আমাদের অনুরূপ দুর্গতি ঘটবে। তাঁদের ধারণা, অশুভবুদ্ধির প্রণোদনায় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে নতুন এক ইস্যু তৈরি করা হচ্ছে।
আইন ও বিচার তো দেশের লোকের জন্য। বিদেশিদের সুবিধা-অসুবিধা গৌণ ব্যাপার। দেশের রায় বাংলায় লিখতে হবে, যাতে নিরক্ষরও শুনলে কিছু বুঝতে পারে। বিদেশিদের অসুবিধা এখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। সব সন্দেহ নিরসনকল্পে সংসদের দ্ব্যর্থহীন উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
আদালত……..সম্মানিত বিচারকগণও বাঙালি, বিজ্ঞ আইনজীবীগণ বাঙালি এবং বিচারপ্রার্থীগণও ব্যতিক্রম সবাই বাঙালি। সকল আদালত কর্তৃক ঘোষিত রায় বাংলা ভাষায় হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। মুষ্টিমেয় লোকের জন্য এই বিচারব্যবস্থা নয়। এই বিচারব্যবস্থা দেশের সব মানুষের সর্বস্তরের আদালতের সম্মানিত বিচারকগণ নিজের মাতৃভাষায় যেন নিপুণভাবে রায় লিখতে পারেন, এই বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এ ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করবে বলে জনগণ আশা করে। প্রধানমন্ত্রীর ভালো করে জানার কথা, জনগণের আশা প্রায়ই পূরণ হয় না। এখন জনগণের প্রতিনিধিরা জাতীয় সংসদে দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্দেশনা না দিলে জনগণের নিজের ভাষায় রায় শোনার সৌভাগ্য হবে না।………
ভাষার দৈন্যমোচন এবং বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর সমকক্ষ করে তোলা আমাদের বড় দায়। সেই দায়মোচনে পরিশ্রমবিমুখ না হয়ে নিজেদের একাগ্রচিত্তে নিবেদন করবে সে হবে আমাদের জন্য মঙ্গলময় ও কল্যাণকর।……
বহুনিন্দিত দ্বিজাতিতত্ত্ব ধ্বংসের বদৌলতে, বাংলা ভাষায় গুণে, সোনার বাংলার সৌভাগ্যে এবং ইতিহাসের দুর্জ্ঞেয় গূঢ় লীলায় বাংলাদেশ আজ এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। যাঁরা বলেন, ভারতের উচ্চ আদালতে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারে কোন অসুবিধা হচ্ছে না, তাঁদের জন্য উচিত, ভারত ইংরেজির পথে যে যাত্রা করেছিল, সে ছিল তার জন্য অগস্ত্যযাত্রা। আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যের একমাত্র যোগসূত্র ইংরেজী, যা ছিন্ন হলে বহুজাতির দেশ ভারত ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে। আমরা সেভাবে দুর্ভাবনাগ্রস্ত নই। আমাদের সৌভাগ্য, আমাদের নিজের দেশের সর্বোচ্চ আদালতে নিজের ভাষায় রাষ্ট্রের অন্যতম সার্বভৌম ক্ষমতা বিচারকার্য সমাধান করার সুযোগ পেয়েছি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন সত্ত্বেও আমরা এ দেশটিকে সুযোগ হারানোর দেশ হিসেবে নষ্ট করার জন্য বদ্ধপরিকর।……..
উচ্চ আদলতে রাষ্ট্রভাষার সীমাবদ্ধতার কথা না ভেবে তার প্রয়োজনীয়তার কথা আমাদের আগে ভাবতে হবে। দেশের আদালতে যে দেশের জনগণের ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে না, সে তো এক লজ্জাকর ব্যাপার। এ দুর্গতি যত তাড়াতাড়ি দূর হয়, তার জন্য সর্বতোভাবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে।”
আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হলো আদালতের ভাষা হবে সহজ, সরল, সাবলীল ও বোধগম্য। অর্থাৎ পৃথিবীর সকল দেশের আদালত সহজ-সরল এবং সাধারণ জনগণের বোধগম্য মাতৃভাষায় রায় প্রদান করবেন, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি। কঠিন মাতৃভাষায় রায় লেখা যেখানে নিরুৎসাহিত করা হয়, সেখানে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় বা পরভাষায় রায় লেখা এক কথায় আইনের বিশ্বজনীন সুপ্রতিষ্ঠিত নীতির পরিপন্থী।
আদালত ও ন্যায়বিচার দুটি সামর্থক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ব্যতীত কোনো জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে নাই। ১২১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুন তারিখে ঘোষিত ম্যাগনা কার্টায় উল্লেখ আছে: To no one shall we sell justice, to no one shall we deny or delay it. (আমরা কারো কাছে বিচার বিক্রয় করব না, বিচার বিলম্বিত করব না বা কাউকে বিচার হতে বঞ্চিত করব না)। ১২১৫ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাগনা কার্টার ঘোষিত আইনের শাশ্বত নীতি আজও বিশ্বব্যাপী সকল আদালতে অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ জনগণের মায়ের ভাষা তথা মাতৃভাষা বাংলা ভাষা। সেখানে বিজাতীয় পরভাষা ইংরেজি ভাষায় রায় প্রদান বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে তাদের বিচার লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার নামান্তর। কেননা বিচারপ্রার্থী যদি আদালতের রায় ও আদেশ তার বোধগম্য মাতৃভাষায় না পায়, না হয়, তবে তা অবশ্যই ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
বাঙালি জনগণের টাকায় পরিচালিত বিচারালয়ের রায় ও আদেশ বাঙালির রক্তে অর্জিত মাতৃভাষা বাংলা না হয়ে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত হচ্ছে। সাধারণ জনগণ সেই রায়ের মর্মার্থ যথাযথভাবে বুঝতে পারে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে আমাদের সাধারণ জনগণকে উক্তরূপ বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত রায় ও আদেশ বোঝার জন্য ইংরেজি জানা লোকের শরণাপন্ন হতে হয়। বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত রায় ও আদেশের জন্য সাধারণ জনগণ প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। জনগণের বিচারালয়, আমাদের সর্বোচ্চ আদালত, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এ সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো বিজাতীয় ইংরেজি ভাষা চেপে বসে আছে। অনতিবিলম্বে এই সিন্দাবাদের দৈত্যকে অপসারণ না করা গেলে জনগণের কোনো মুক্তি নেই। জনগণ তাই এই জগদ্দল পাথর তথা বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রায় ও আদেশ লেখার অবসান চায়।
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা বাংলাদেশের জনগণের জন্য। বাংলাদেশের জনগণের ৯৮ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলে। বিচারপ্রার্থী জনগণের বোধগম্য ভাষায় আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত না হলে, বিচারব্যবস্থা জনগণের কাছে কল্যাণকর ও গ্রহণীয় হবে না। কারণ আদালত শুধু বিচারক এবং আইনজীবীদের জন্য নয়, আদালতের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে জনগণের কল্যাণের জন্য তথা জনগণের প্রয়োজন। সুতরাং সেই জনগণের বোধগম্য ভাষাতেই আদালতকে রায় প্রদান করতে হবে।
সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম প্যারায় বলা হয়েছে, ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ এবং প্রস্তাবনার দ্বিতীয় প্যারায় বলা হয়েছে, ‘যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল’ সুতরাং এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ যেমন সমগ্র সংবিধানের দর্শন তেমনি যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ এবং প্রাণোৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল সেই সকল আদর্শসমূহ এবং জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের ইতিহাস হল ‘প্রস্তাবনার’ দর্শন তথা প্রস্তাবনার অংশ তথা সংবিধানের অংশ। এর থেকে কোনো বিচ্যুতি চলবে না। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা, মাতৃভাষা হবে শিক্ষার বাহন এবং আইন-আদালতের ভাষা হবে বাংলা ইত্যাদি ছিল মহান ভাষা আন্দোলনের স্লোগান, দাবি তথা আমাদের অন্যতম মহান আদর্শ, যা আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিয়োগ এবং প্রাণ উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। রাষ্ট্রভাষা/আন্দোলনই আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সূচনা করেছিল।
রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে দুটি বিভাগ যথা নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগ সংবিধানের নির্দেশনা মোতাবেক বর্তমানে বাংলা ভাষায় তাদের সকল কার্যক্রম সুষ্ঠু এবং সুন্দরভাবে করে আসছে। এমনকি রাষ্ট্রের অপর বিভাগ তথা বিচার বিভাগের আওতাধীন অধস্তন আদালতের বিচারকবৃন্দও বর্তমানে প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ প্রদান করে আসছেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের সর্বোচ্চ আদালত তথা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ এখনো সম্পূর্ণরূপে বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ প্রদান করছে না। এটা আমাদের জন্য নিতান্তই গ্লানির বিষয়। যে বিভাগ তথা বিচার বিভাগ তথা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিকভাবে অন্য দুই বিভাগকে সংবিধান মোতাবেক চলার জন্য সবসময় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন সেই প্রতিষ্ঠান নিজেই সংবিধান মোতাবেক বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ লিখছেন না।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বর্তমানে যে সকল দরখাস্ত দাখিল হয় তার মমার্থ অনুধাবন না করে অধিকাংশ বিচারপ্রার্থী তাতে স্বাক্ষর প্রদান করেন। বিচারপ্রার্থীদের বোধগম্য নয় এমন ভাষায় লিখিত দরখাস্ত বা জবাবে তাদের স্বাক্ষর গ্রহণ অন্যায় ও অন্যায্য।
১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তারিখে লর্ড ম্যাকাউলের ব্রিটিশ সংসদে বক্তব্য উপস্থাপন করে বলেন যে,
‘I have traveled across the length and breadth of India and I have Not seen one person who is a beggar, who is a thief such wealth I have seen in this country, such high moral values, people of such caliber, that I do not think we would ever conquer this country unless we break the very backbone of this nation, which is her spiritual and cultural heritage and therefore, I propose that we replace her old and ancient education system, her culture, for if the Indians think that all that is foreign and English is good and greater that their own, they will lose their self-esteem, their native culture and they will become what we want them, a truly dominated nation.’
(আমি ভারতবর্ষের সমগ্র অঞ্চল ঘুরে দেখেছি কিন্তু একজন মানুষও খুঁজে পাইনি যে কিনা ভিক্ষুক, চোর। এমন সম্পদ আমি এদেশে দেখেছি। এত উচ্চমানসম্পন্ন এবং মেধাবী মানুষদেরকে আমি মনে করি না আমরা কখনও জয় করতে পারব, যতক্ষণ না আমরা এই জাতির মেরুদ- তথা তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ভাঙতে না পারি। সেজন্য আমি প্রস্তাব রাখছি, আমরা তাদের পুরনো শিক্ষা পদ্ধতির, সংস্কৃতির পরিবর্তন এমনভাবে করব যেন ভারতীয়রা মনে করে ইংলিশ হয় ভাল এবং তাদের থেকে উন্নত। তখন তারা তাদের নিজস্বতা হারাবে, হারাবে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং তারপর তারা পরিণত হবে এমন এক জাতিতে যা আমরা চাই, সত্যিকার বশ্যতা স্বীকারকারী জাতি)।
অতঃপর ইংরেজরা আমাদের ভাষা এবং কৃষ্টির ওপর লর্ড ম্যাকাউলের পরামর্শ অনুযায়ী আঘাত করে আমাদের তথা বাংলাসহ সমগ্র ভারতবর্ষকে তাদের তাঁবেদার রাষ্ট্র বা ঔপনিবেশিক কলোনি বানাতে পেরেছিল। তারপর ২০০ বছর যাবৎ ইংরেজরা আমাদের শিখিয়েছে আমাদের প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতি ও আমাদের সংস্কৃতি থেকে ইংরেজি, ইংরেজি শিক্ষা পদ্ধতি এবং সংস্কৃতি ভালো এবং অধিকতর উন্নততর। এভাবে ইংরেজরা বাংলাসহ সমস্ত ভারতবর্ষের সকল প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতি এবং ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ধ্বংস করে বাংলাসহ সমস্ত ভারতবর্ষের মানুষদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। ইংরেজরা বাংলাসহ সমস্ত ভারতবর্ষের মানুষের মেরুদণ্ড এমনভাবে ভেঙে দিয়েছে যে এখনো আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। স্বাধীনতা পেয়েও আমরা এখনো পরোক্ষভাবে ইংরেজদের দাসত্ব করে যাচ্ছি।
২৫০ বছর যাবৎ (১৭৭৮ থেকে ২০১৭) যে বাংলা ভাষায় আইনচর্চা ও আইন বই প্রকাশ করা হচ্ছে, সেই ভাষায় উচ্চ আদালত তথা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রায় ও আদেশ দেবেন না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমি বিশ্বাস করি, এত দিনে বিচার বিভাগের সকল কাজকর্ম বাংলায় সুন্দরভাবে হতো যদি আমরা ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা পরিহার করতে পারতাম।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্থির, অচঞ্চল কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক।’ অতঃপর ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, অতঃপর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পুলিশ বাহিনীর রাইফেলের নলের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, রফিকুদ্দিন আহমেদ এবং আব্দুস সালাম নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির শ্লোগান ছিল ‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু কর’, ‘মাতৃভাষা হবে শিক্ষার বাহন’, ‘আইন আদালতের ভাষা হবে বাংলা’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীনের পূর্বেই ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন তারপরে বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন। আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তার সংশোধন করা হবে।’
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সূচনা করেছিল। জাতির পিতা জনগণের নিকট দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। তাই তো আমাদের সংবিধানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ; যার সংবিধান বাংলায় লেখা হয়েছে এবং যার সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রভাষা একটি এবং তা হলো বাংলা ভাষা। জন্ম হয়েছে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের। সংবিধানে অনুচ্ছেদ-৩-এ বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের কালবিলম্ব না করে বাংলায় রায় লেখার আহ্বান জানান। স্বাধীনতার তিন বছর পরও বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা বাংলা থাকা সত্ত্বেও সরকারি অফিস এবং আদালতে অবাধে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষার চর্চা চলছিল দেখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং বাংলা ভাষা প্রচলন সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশ, ১৯৭৫ রাষ্ট্রপতির সচিবালয়, গণভবন, ঢাকা সংখ্যা ৩০.১২.৭৫, সাধারণ-৭১৯/১(৪০০) ১২ই মার্চ, ১৯৭৫ সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি, বেসরকারি অফিস এবং সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টসহ সকল আদালতে পরভাষা তথা বিজাতীয় ভাষা তথা ইংরেজি ভাষার ব্যবহার করা হবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমনকে অবমাননা, জাতীয় চার নেতার প্রতি অবমাননা, ৩০ (ত্রিশ) লক্ষ শহীদের প্রতি অবমাননা, মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম হারানো দুই লক্ষ মা-বোনের প্রতি অবমাননা, মহান মুক্তিযুদ্ধে যে সকল পরিবার তাদের আপনজন হারিয়েছেন তাদের প্রতি অবমাননা এবং সর্বোপরি ভাষা শহীদ সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার এবং শফিউর রহমানসহ সকল শহীদের প্রতি অবমাননা।
আসাদুজ্জামান বনাম বাংলাদেশ (৮ এএলআর ২০১৬ (২) অনুচ্ছেদ ২৯৫) মোকদ্দমায় সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয় যে, “সংবিধান মোতাবেক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রভাষা একমাত্র ‘বাংলা ভাষা’।”
হাইকোর্ট বিভাগের সিদ্ধান্ত এই যে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ মোতাবেক এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। সাংবিধানিক পদাধিকারী সকল ব্যক্তি এই মর্মে শপথ পাঠ করেন যে, তিনি এই সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন। সুতরাং সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল কর্ম শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় হবে। এর অন্যথা অর্থ সংবিধান ভঙ্গ করা। সংবিধান মোতাবেক প্রজাতন্ত্রের তিনটি বিভাগ। আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। সংবিধান মোতাবেক উপর্যুক্ত তিনটি বিভাগেরই একমাত্র ভাষা ‘বাংলা ভাষা’।
শুধু ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষার প্রতি দায়িত্ব পালন করলে চলবে না। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টসহ সকল আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশের সকল আইনের ছাত্র এবং শিক্ষককেও যেমন বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে তেমনি সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবীগণসহ বাংলাদেশের সকল আইনজীবীকে এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণসহ বাংলাদেশের সকল বিচারককে সকল দ্বিধা সংকোচ কাটিয়ে উঠে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে।
ভাষার জন্য রক্ত দিতে হবে না, জীবন দিতে হবে না। ভাষার জন্য শুধু বাংলায় আইন পড়া এবং পাঠদান করতে হবে। বাংলাদেশের সকল আইনজীবী বাংলায় দরখাস্ত লিখলে এবং বাংলাদেশের সকল বিচারক বাংলায় রায় লিখলেই শহীদদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানানো হবে। আর সেটাই হবে মাতৃভাষার জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক।