বাংলায় রায় প্রকাশের আগে মাতৃভাষায় আইন শিক্ষার প্রচলন আবশ্যক

বাংলায় রায় প্রকাশের আগে মাতৃভাষায় আইন শিক্ষার প্রচলন আবশ্যক

নোমান আলম: ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত ফেব্রুয়ারী মাস এলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়। সবচেয়ে বেশি কথা হয় আদালতের ভাষা নিয়ে। আদালতের রায় ইংরেজি ভাষায় হওয়ায় অনেকে ক্ষুব্ধ।

আদালত হলো জনমানুষের জন্য। আদালতের ভাষা তাই জনমানুষের জন্য বোধগম্য হওয়া জরুরি বটে। বাংলা ভাষায় উচ্চ আদালতের কিছু রায় দেখা যায়। তবে সংখ্যায় এতোটা নগন্য যে, বাংলা ভাষার প্রয়োগটা এখানে প্রতীকী বলা চলে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগ এর যেকোনো রায় বা সিদ্ধান্ত হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো বিভাগের সিদ্ধান্ত বা রায় অধস্তন সব আদালতের জন্য অবশ্যপালনীয়। অর্থাৎ উচ্চ আদালতের রায় মানেই দেশের মানুষের জন্য সেটি আইন।

আইনের একটা মূলনীতি হচ্ছে “আইন না জানা কোন অজুহাত নয়”। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি কোন অপরাধ সংগঠিত করার পর বা কোন আইনী দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবার পর কেউ কখনো কেউ বলতে পারবে না যে, সে আইন জানে না।

আইন যেহেতু এই জায়গায় এমন সংবেদনশীল, তাই আইন হওয়া উচিৎ সাধারণ জনগনের কাছে সহজবোধ্য।

আদালতে বাংলা ভাষার শতভাগ প্রচলনে ব্যর্থতার সমালোচনার জবাবে আইন সংশ্লিষ্টদের একটা যুক্তি থাকে ,আইন শিক্ষা যেহেতু বাংলায় না, তাই আইনের বিষয়াদি শতভাগ বাংলায় প্রকাশ সম্ভব হয়ে উঠে না।

এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন একটি জ্ঞান যখন মানুষ তার মাতৃভাষা তথা ফার্স্ট ল্যাংগুয়েজে গ্রহণ করে তখন সেটি তার সাথে অনেকটা অবচেতনভাবেই মিশে যায়। যখন সেটি ইংরেজি বা দ্বিতীয় কোন ভাষায় শিখতে বা পড়তে হয় তাকে প্রথমে ভিন্ন ভাষায় পড়তে বা শুনতে হয়, পরবর্তীতে বাংলায় তাকে অনুবাদ করে বুঝে নিতে হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে শেখাটা সহজ না হয়ে জটিল হয়ে উঠে।

সরকারী এবং বেসরকারী সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই আইন পড়ে ইংরেজিতে। এরমধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলায় আইনের বই অপ্রতুল। আইন শিক্ষার্থীরা এমন কিছু বিষয়ের বই পড়ে যেগুলোতে বাংলা ভাষার বই তো দূরের কথা, বাংলাদেশী কোন লেখকের বইও থাকে না।

এতোসব অপ্রতুলতার মধ্যে বাংলায় আইন শিক্ষা তথা বাংলায় রায় প্রচারের উদ্যোগ নিলে সেটি ব্যর্থই হবে।

মানুষ যখন বিদেশী কোন সাহিত্যের প্রেমে পড়ে, তখন ঐ মানুষটি যদি ঐ সাহিত্যের মূল রস আস্বাদন করতে চায়, সে নিজেই সাহিত্যের ভাষাটি শিখে নেয়। কোন টেকনিক্যাল বিষয়ে বিদেশী ভাষায় কোন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হয়, তখন জ্ঞানপিপাসু মানুষ সেই ভাষাটিই শিখে নেয়।

একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, সমৃদ্ধ বই বা জ্ঞানের জন্য সেটি যে ইংরেজি ভাষায় হতে হবে তা নয়, কিন্তু সেটি হতে হবে গবেষণাপূর্ণ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলা ভাষায় আইনের ভালো বই তখনই হবে যখন বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে আইন সংক্রান্ত গবেষণা বাড়বে।

লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী; জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম।