সুশাসন এবং আইনের শাসন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে বলে মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বোরহান উদ্দিন বলেছেন, বিচারিক স্বাধীনতা অনেকাংশে নিশ্চিত করে বিচারকের অন্তরের স্বাধীনতা। স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পালনের জন্য বিচারককে মন এবং মননে স্বাধীন হতে হবে এবং এই কারণে বিচারককে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হবে।
আজ মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট বার থেকে দেওয়া বিদায়ী সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন। এদিন দুপুর ১২টায় আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষে তাকে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষে সভাপতি মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির তাকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেন। এর জবাবে তিনি বক্তব্য দেন।
বক্তব্যের শুরুতে বিচারপতি বোরহান উদ্দিন বলেন, আমার শেষ বিচারিক কর্মদিবসে সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। এই প্রাঙ্গণে আইনজীবী হিসেবে, বিচারক হিসেবে জীবনের দীর্ঘসময় অতিবাহিত করেছি। আমার কথায় কিংবা আচরণে কেউ যথি কষ্ট পেয়ে থাকেন, আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
তিনি বলেন, নব্বই দশকের শুরুতে আমি যখন ঢাকা হাইকোর্টে আসি, তখন বিচারপতি শাহাবুদ্দীন পুনরায় প্রধান বিচারপত। আমি যে চেয়ারে বসা সেই চেয়ারে বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমন আসীন। প্রধান বিচারপতির বামপাশে বিচারপতি মোস্তফা কামাল সাথে বিচারপতি এ টি এম আফজাল এবং বিচারপতি লতিফুর রহমান। পরে এই চেয়ারে বিচারপতি মোস্তফা কামাল সাহেব, বিচারপতি এ টি এম আফজাল সাহেব বসেছেন। ঐ সময় এবং এই সময়ের কথা ভাবলে আমি কুণ্ঠিত হই। উনাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং ব্যক্তিত্ব বিচারকের আসনকে দেদীপ্যমান করে রাখত।
একইভাবে তখন আইনজীবী হিসেবে দেখেছি জনাব আসরারুল হোসেন, এম এইচ খন্দকার, এর আর পাল, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, খন্দকার মাহবুব উদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, ড. এম জহিরসহ অনেককে, যারা ছিলেন আইন অঙ্গনের দিকপাল। নিজেদের জ্ঞান, মেধা দিয়ে উনারা দেশের মানুষের ভরসাস্থল হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃবৃন্দ পরামর্শ নিতে উনাদের কাছে আসতেন। এখন ভিন্ন চিত্র।
বিচারপতি বোরহান উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা এবং বিচার বিভাগ একে অপরের পরিপূরক হলেও বিচার বিভাগের দায়িত্ব সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে অনন্য। কারণ আইনসভার প্রণীত কোন আইন সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্য কিনা তা দেখার অধিকার বিচার বিভাগের। পাশপাশি নির্বাহী বিভাগের কোন কার্যকলাপ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক কিনা তা দেখার ক্ষমতা বিচার বিভাগের এবং এই কারনেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। সুশাসন এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। একই সাথে একথাও অত্যন্ত ঠিক যে, বিচারিক স্বাধীনতা অনেকাংশে নিশ্চিত করে বিচারকের অন্তরের স্বাধীনতা। স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পালনের জন্য বিচারককে মন এবং মননে স্বাধীন হতে হবে এবং এই কারণে বিচারককে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হবে।
তিনি বলেন, সাংবিধানিক আদালতকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর হতে হবে। প্রান্তিক মানুষ জানবে অন্যায়ের প্রতিকার করার জন্য আইন আছে। আইন প্রয়োগের জন্য আদালত আছে। যে জীবন কাটিয়েছি, যাঁদের সান্নিধ্যে কাটিয়েছি, তাঁদের কারও প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই, আক্ষেপ নেই। জীবন আমাকে অকৃপণ হস্তে দান করেছে। সহকর্মী ভাইয়েরা সবসময় তাঁদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সুসময়ে আনন্দের সঙ্গী হয়েছেন, কঠিন সময়ে ভাইয়ের সহমর্মিতা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন, ভরসা দিয়েছেন- সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
বিদায় বেলায় তিনি বলেন, আমার এই ছোট দেশটাকে আমি বড় ভালবাসি। এই দেশের খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলো আমারই স্বজন। তাঁদের প্রত্যেকের জীবনে সুখ আসুক, স্বাচ্ছন্দ আসুক। এদেশের প্রতিটি ছেলে-মেয়ে শিক্ষার আলো পাক, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠুক, জ্ঞানে বিজ্ঞানে আলোকিত মানুষ হোক – এ আমার সারা জীবনের চাওয়া।
তিনি আরো বলেন, দেশের সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিলে খেটে খাওয়া মানুষ বাঁচার পথ করে নিতে পারে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, আপিল বিভাগের বিচারপতিগণ, অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি, সিনিয়র আইনজীবীগণসহ তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বোরহান উদ্দিনের বিচারিক জীবনের শেষ কর্মদিবস আজ। অবসরে যাওয়ার আগে আপিল বিভাগে বসে আজ মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) শেষ দিনের মতো বিচারকাজে অংশ নিয়েছেন তিনি।
২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি বিচারপতি বোরহান উদ্দিনকে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৫৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন বোরহান উদ্দিন। তার বাবার নাম আব্দুস সবুর ও মায়ের নাম মমতাজ সবুর। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৮৫ সালের ৩ মার্চ অধস্তন আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। এর তিন বছর পর ১৯৮৮ সালের ১৬ জুন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে তালিকাভুক্ত হন। এরপর ২০০২ সালের ২৭ নভেম্বর আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন তিনি।
২০০৮ সালের ১৬ নভেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। দুই বছর পর ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারক হন বিচারপতি বোরহান উদ্দিন।
নিয়মানুযায়ী ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় অবসরে যাচ্ছেন তিনি।