এস. এম. আরিফ মন্ডল: বাদী রাষ্ট্রপক্ষে এস এম আরিফুজ্জামান শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ), কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ঢাকা কর্তৃক তৃতীয় শ্রম আদালত ঢাকায় দায়েরকৃত বি এল এ (ফৌজদারি) মামলা নম্বর ২২৮/২০২১ বিচারান্তে গ্রামীন টেলিকমের চেয়ারম্যান ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আরো দুজন পরিচালকসহ মোট চার জনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ শ্রম আইন -২০০৬ এর ধারা ৪(৭) (৮), ১১৭, ২৩৪ ও শ্রমবিধিমালার বিধি ১০৭ লঙ্ঘনের জন্য ৩০৩ (ঙ) ও ৩০৭ ধারার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের কে উক্ত আইনের ৩০৩(ঙ) ধারার অপরাধে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে অনাদায়ে দশ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৩০৭ ধারার অপরাধে পঁচিশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে ও অনাদায়ে অতিরিক্ত পনেরো দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিতের আদেশ হয়।
মামলা অভিযোগে বলা হয়, গ্রামীন টেলিকমে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের আইনের বিধান অনুসারে মজুরিসহ বাৎসরিক ছুটি প্রদান, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীত নগদ অর্থ প্রদান করা হয় নাই, শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয় নাই এবং নীট লভ্যাংশের ৫% উক্ত দুটি তহবিল ও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন ২০০৬ অনুযায়ী গঠিত তহবিলের নির্দিষ্ট হারে (৮০:১০:১০) জমা প্রদান করা হয় নাই।
অতঃপর গ্রামীন টেলিকমের চেয়ারম্যান ড.মুহাম্মদ ইউনুস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ও আরো দুজন পরিচালকসহ সর্বমোট ৪ জনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা-৪(৭)(৮),১১৭,২৩৪ ও বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ এর ১০৭ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে শ্রম আইনের ধারা-৩০৩(ঙ) ও ৩০৭ অধীন মামলা দায়ের করা হয়।উল্লেখ্য গ্রামীন টেলিকমকে আসামী করা হয় নাই।
ড. মুহাম্মদ ইউনুসসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এর পূর্বে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর দুইবার নোটিশ প্রদান করে। উক্ত নোটিশের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটি জবাব দেন। উক্ত জবাব এবং শ্রম আদালতে রাষ্ট্রপক্ষকে জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে গ্রামীন টেলিকমের তথ্যগত এবং শ্রম আইন পরিপালনে অগ্রগতি সমূহ জানা যায়। গ্রামীণ টেলিকম একটি মেধাভিত্তিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যাহা কোম্পানি আইনের ২৮ ধারায় গ্যারান্টি দ্বারা সীমাবদ্ধ। নট ফর প্রফিট কোম্পানি, যার মুনাফা বিতরণ যোগ্য নহে। যাহার শেয়ার হোল্ডারগণ কোন লভ্যাংশ গ্রহণ করতে পারেন না। এর বোর্ড অব ডাইরেক্টর রয়েছেন ১২ জন। কাজের ধরন বিবেচনায় ইহা শিল্প সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।
উল্লেখ্য, দেশের ২৫ টি প্রতিষ্ঠান ও কারখানাকে উদ্দেশ্য পূরণকল্পে শিল্প সম্পর্কিত কাজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই বিবেচনায় গ্রামীণ টেলিকমের কার্যক্রম শিল্পের সংজ্ঞাভুক্ত নয়।গ্রামীণ টেলিকম হচ্ছে গ্রামীণফোন লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডার প্রতিষ্ঠান। গ্রামীন টেলিকমের কোন স্থায়ী কার্যক্রম নেই এবং উহার মূল কাজ হচ্ছে চুক্তির মাধ্যমে পল্লী ফোন কার্যক্রম এবং নোকিয়া মোবাইল হ্যান্ডসেটের বিক্রয়ত্তোর সেবা প্রদান করা। প্রতিষ্ঠানটি পল্লী ফোন কার্যক্রম ও নকিয়া ফোনের সাথে চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করে থাকে এবং প্রতি তিন বছর অন্তরে সেই চুক্তি নবায়ন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি গ্রামীণফোন হতে দশ শতাংশ রেভিনিউ শেয়ার পায়।
অনুরূপভাবে নোকিয়া হ্যান্ডসেটের বিক্রয়ত্তোর সেবা নোকিয়ার সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং নোকিয়ার চুক্তিপত্র অনুযায়ী তিন মাসের নোটিশে উভয়পক্ষ এই কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে। যেহেতু গ্রামীন টেলিকমের স্থায়ী কোন কার্যক্রম নেই এবং বিভিন্ন পক্ষের সাথে চুক্তির ভিত্তিতেই এর ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে তাই যখন যে কাজের জন্য চুক্তি হচ্ছে তখন সেই ব্যবসার ধরন অনুযায়ী প্রয়োজনীয়/বিশেষ দক্ষতা ও যোগ্যতার আলোকে লোকবল নিয়োজিত করতে হয় বিধায় গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের নিয়োগ সমূহ চুক্তিভিত্তিক ভাবে দেওয়া হয়ে থাকে।এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের আওতায় সকল শ্রমিক কর্মচারী স্থায়ী শ্রমিকের ন্যায় সকল সুযোগ সুবিধা যেমন পদোন্নতি, নিয়মিত হওয়া, পে স্কেল, গ্রাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, অর্জিত ছুটি, মেডিকেল ভাতা ইত্যাদি পেয়ে থাকেন।
গ্রামীন টেলিকমের স্থায়ী কার্যক্রম না থাকায় উহার সকল শ্রমিক কর্মচারী ও কর্মকর্তাগন চুক্তিভিত্তিক কার্যক্রমের আওতায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকৃত কর্মচারী কর্মকর্তা হলেও তারা স্থায়ী শ্রমিকের মতো শ্রম আইনের সকল সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। যদি কোন শ্রমিক শিক্ষানবিশ কাল শেষে কনফার্মেশন লেটার না পান তাহলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক স্থায়ী বললে গণ্য হবেন। আর তিনি যদি প্রতিকার না পান তাহলে স্থায়ী শ্রমিকের মর্যাদা লাভের প্রার্থনায় দেওয়ানি প্রতিকারে শ্রম আদালতে মামলা করতে পারেন।
অত্র প্রতিষ্ঠানটি শ্রম আইনের সুবিধার চেয়ে অধিক হারে অর্জিত ছুটি প্রদান করে থাকে। কোন শ্রমিক অর্জিত ছুটির দরখাস্ত করলে প্রতিষ্ঠান যদি কোন কারণে উহা নামন্জুর করেন তাহা হইলে উক্ত নামঞ্জুরকৃত ছুটি সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের হিসাবে অতিরিক্ত পাওনা হিসেবে যুক্ত হয়। তাই কোন শ্রমিককে অর্জিত ছুটি প্রদান না করিলে তার প্রতিকার দেওয়া আছে। অধিকন্তু সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের জন্য দেওয়ানি প্রতিকারের বিধান রয়েছে। পল্লী ফোন ও নোকিয়ার সাথে চুক্তির মেয়াদ বর্ধিতকরণের সাথে সাথে শ্রমিকদের চাকুরীর চুক্তির মেয়াদ বর্ধিত করা হয়। এর কোন শিল্প কারখানা নেই। গ্রামীন টেলিকমের শ্রমিক সংখ্যা ৬৭ জন, যার মধ্যে পাঁচজন ড্রাইভার, চারজন বার্তা বাহক আর বাকিরা কর্মকর্তা। সবাই ২০১৬ সালে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত।
ফলশ্রুতিতে তাদেরকে চাকরিতে স্থায়ী করার করা হয় নাই। তদুপরি স্থায়ী শ্রমিকের ন্যায় সকল সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়। তবে স্থায়ী শ্রমিকের ন্যায় সকল সুযোগ- সুবিধা ভোগ করেন। উক্ত শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা কোন অংশই শ্রম আইনের বর্ণিত বিধানের থেকে কম নহে। অবশ্য এই বাৎসরিক ছুটি প্রদান, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ চেয়ে কোন শ্রমিক শ্রম আদালতে মজুরি পাওনা বা ফৌজদারী মামলা দায়ের করেন নাই।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গ্রামীণ টেলিকমকে সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ করার জন্য পরামর্শ দিয়ে একটি নোটিশ প্রেরণ করে। নোটিশের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটি কিছু বিধান পরিপালন করে জবাবও দেয়। জবাবে বলে যে -প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য নিজস্ব নীতিমালা রয়েছে যাহা অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে মহাপরিদর্শক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে।
সংশ্লিষ্ট কার্যালয় হতে কোন আপত্তি বা সংশোধনীর বিষয়ে অবহিত না করায় পুনরায় উহা অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। তদুপরি প্রতিষ্ঠানটিকে তাদের চাকুরী বিধিটি শ্রম আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান সংক্রান্ত কোন পত্র ইস্যু করা হয়নি। উল্লেখ্য শ্রম আইন অনুযায়ী চাকুরী বিধি অনুমোদনের জন্য মহাপরিদর্শক এর নিকট পেশ করা হলে ৯০ দিনের মধ্যে তাহার বিবেচনায় যথাযথ আদেশ দান করবেন। এমন আদেশে সংক্ষুব্ধ হলে সরকারের নিকট আপিলও দায়ের করতে পারবেন।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নোটিশে আরো উল্লেখ করেছে যে- শ্রমিকদের আইনের বিধান মোতাবেক স্থায়ী করা হয় নাই। এ প্রেক্ষিতে গ্রামীন টেলিকম যথাযথ লিখিত জবাব দাখিল করেন। অধিকন্তু উক্ত নোটিশের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটি কিছু নির্দেশনা বাস্তবায়নও করে। তন্মধ্যে কর্মীদের প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মোতাবেক নিয়োগপত্র এবং ছবিসহ পরিচয় পত্র প্রদান করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিধি মোতাবেক কর্মচারীদের জন্য সার্ভিস বইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্মীদের দৈনিক হাজিরা সফটওয়্যার এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে এবং হাজিরা খাতা ব্যবহার করে সংগ্রহ করা হচ্ছে। ড্রাইভার এবং মেসেঞ্জারদের জন্য ওভারটাইম সিট ব্যবহার করা হচ্ছে।
জবাবে আরো উল্লেখ করা হয় যে- শিক্ষানবিশ কাল সম্পন্ন করে নিয়মিত হওয়ার পর থেকেই কর্মীগণ অর্জিত ছুটি প্রাপ্ত হয়ে থাকেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী স্ব- বেতনে অর্জিত ছুটি ভোগ করে থাকেন। বাকি ছুটি প্রতি তিন বছর অন্তর প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী নগদায়ন করা হয়। ছুটি নগদায়ন সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। প্রতিবছর নৈমিত্তিক ছুটি ২০ দিন প্রদান করা হয়ে থাকে। এছাড়াও শিক্ষানবিশ কাল সম্পন্ন করে নিয়মিত হওয়ার পর থেকেই কর্মীগণ প্রতিবছরের জন্য ৩০ দিন অর্জিত ছুটি লাভ করেন। মাতৃ কালীন ছুটি চার মাস প্রদান করা হয়ে থাকে। ছুটির তথ্য সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। গ্রামীন টেলিকম কোম্পানি আইনের ২৮ ধারায় সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান বিধায় লভ্যাংশ প্রদানের ব্যবস্থা নেই এবং সেজন্য ‘অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল’ গ্রামীন টেলিকম এর জন্য প্রযোজ্য নয়। উল্লেখ্য ‘অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল (WPPF) এর দাবিতে ১০৭ জন শ্রমিক শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করেছেন যা এখনো নিষ্পন্নধীন।
কোম্পানির বিভিন্ন শাখা-বিভাগের কাজের ধরন ও গুরুত্ব অনুযায়ী সাপ্তাহিক ছুটি নির্ধারিত হয় এ নিমিত্তে গ্রাহক সেবার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সার্ভিস বিভাগের সাপ্তাহিক ছুটি একদিন রাখা হয়েছে।উপরিউক্ত জবাবে উল্লেখিত লঙ্ঘনসমূহ বাস্তবায়নের অগ্রগতি অবহিত করার পরেও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সন্তুষ্ট না হওয়ায় নতুন করে আরেকটি নোটিশ ইস্যু করেন। উক্ত নোটিসে আবারো উল্লেখিত লংঘন সমূহ বাস্তবায়নের অগ্রগতি উপস্থাপন করার জন্য অনুরোধ করে।
পরবর্তীতে জবাবে গ্রামীণ টেলিকম উল্লেখিত লংঘন গুলোর বাস্তবায়নে সর্বশেষ তথ্য -উপাত্ত প্রদান করেন। একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বিবেচনার নিরীক্ষে ডকুমেন্টসমূহ সুবিবেচনার জন্য প্রেরণ করেন। দুইটি জবাব এবং গ্রামীণ টেলিকম উল্লেখিত লংঘন গুলোর বাস্তবায়নে অগ্রগতির প্রতি সন্তুষ্ট না হওয়ায় চেকলিস্টে যে চারজনের নাম ছিল তাঁদের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে অত্র মামলা দায়ের করা হয়।
মামলায় গ্রামীন টেলিকম পক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী শ্রম আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন যে- শ্রম আইনের ৩০৭ ধারার অধীন কাউকে শাস্তি দেবার ক্ষেত্রে প্রথমত যে বিধানটি বিবেচনা করা হয় তা হচ্ছে- শ্রম আদালতের কোন আদেশ পরিপালন না করা বা লংঘন বা অমান্য করার কারণে এই ধারার অধীন মামলার উদ্ভব হয়। এই ধরনের মামলাগুলো কনটেম্প অফ কোর্ট প্রসেডিং হিসেবে পরিগণিত। শ্রমিক তার যেকোনো পাওনা আদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দেওয়ানী প্রতিকারে মামলা করতে পারেন এবং শ্রম পরিদর্শক প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে পারেন।
শ্রম আদালতের মামলাটির প্রসিডিংস/কার্যধারা কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট ডিভিশনে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৬১এ ধারার মোতাবেক দরখাস্ত দাখিল করা হয়েছিল। মামলাটির রুল শুনানিতে গ্রামীন টেলিকম পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়েছিল যে -‘কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর যে নোটিশগুলি দিয়েছিল সে প্রেক্ষিতে জবাব গ্রামীণ টেলিকম দিয়েছিল কিন্তু অত্র অভিযোগকারী সেই সম্পর্কিত কোন সিদ্ধান্ত জানায়নি। ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছে শ্রম আইনের ৩ (৪) ধারা অনুযায়ী আপিল দায়ের করতে পারেনি সুতরাং শ্রম আদালতের মামলাটি প্রিম্যাচিউর’।
অপরদিকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন যে-শ্রম পরিদর্শক প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শনের পর দেখতে পান – শ্রম আইনের কিছু বিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে। সেই প্রেক্ষিতে বারংবার শ্রম আইন লংঘন রোধ এবং তা বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে দুটি পত্র প্রেরণ করেন। তিনি আরো বলেন – গ্রামীন টেলিকম শ্রম আইন বাস্তবায়ন হইতে অব্যাহতি পাবেন কি পাবেন না এবং ড. মোহাম্মদ ইউনুস প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে শ্রম আইন ভঙ্গে দায়ী হবেন কি না তা বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণে নির্ধারিত হবে। অতঃপর শুনানীন্তে মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন সংশ্লিষ্ট রুলটি খারিজ করে দেয়। উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে আসামীগণ আপিল বিভাগে দরখাস্ত দাখিল করলে উক্ত বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানীন্তে হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন।
পরবর্তীতে শ্রম আদালত ড. ইউনুস সহ অন্যান্য আসামিগণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ শ্রম আইনের ৩০৩ (ঙ) এবং ৩০৭ ধারায় চার্জ গঠন এবং একই সাথে আসামীদের অব্যাহতির দরখাস্ত নামঞ্জুর করলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারায় ৫৬১এ আবারো মাননীয় হাইকোর্ট ডিভিশনে মামলা হতে দরখাস্ত দায়ের করেন। উক্ত রুল শুনানিতে আসামীগনের আইনজীবী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন যে- শ্রম আইনের অধীন গঠিত শ্রম আদালতগুলোর দেওয়ানী আদালত, ফৌজদারী আদালতের ন্যায় ক্ষমতা আছে এবং মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ও মূলত আর্থিক ক্ষতিপূরণের আদেশ দিয়ে থাকে।
সাধারণত প্রতিষ্ঠানের মালিক অথবা ডাইরেক্টরদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের একেবারেই ব্যতিক্রম এবং যাহা কিনা শেষ অবলম্বন। দেওয়ানী প্রতিকার না চেয়ে ফৌজদারি অভিযোগ শ্রম আইনে গ্রহণযোগ্য নয়। শ্রম আইনের অধ্যায় উনিশে অপরাধ, দন্ড এবং তার কার্যধারা সম্পর্কে বলা আছে কিন্তু এই মামলায় ধারা-৪(৭)(৮), ১১৭ এবং ২৩৪ ধারার বিধান ভঙ্গ করলে ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত হয় নাই। এমনকি বিধানগুলো ভঙ্গ করলে কোন শাস্তির কথাও বলা হয়নি।
অর্জিত ছুটির বিষয়ে কোন শ্রমিক যদি প্রতিষ্ঠানের কাছে দরখাস্ত দিয়ে দাবী করেন এবং তা যদি অস্বীকার করা হয় তখন সেই অর্জিত ছুটি বাৎসরিক ছুটির সঙ্গে যোগ হবে। শ্রম আইনের ধারা- ৪,১১৭ এবং ২৩৪ ভঙ্গজনিত কারণে দেওয়ানি প্রতিকার হিসেবে ক্ষতিপূরণের বিধান আছে। যেখানে অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল (WPPF)অর্থ দাবি করে গ্রামীন টেলিফোন কোম্পানি শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন এর সিবিএ কর্তৃপক্ষ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট কেস নম্বর ১৬৬৬/২০১৯ দায়ের করেছেন তা এখনো নিষ্পন্নধীন।
উক্ত মামলা চলমান থাকা অবস্থায় শ্রম আদালতে একই বিষয় নিয়ে ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হয়েছে যাহা আইনত অরক্ষণীয়। রুল নিশিটির শুনানিতে সরকার পক্ষের নিয়োজিত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন যে- দরখাস্তকারী আসামীগণ ক্রমাগত শ্রম আইনের ৪, ১১৭ ও ২৩৪ ধারা ভঙ্গ করে যাচ্ছেন এবং তাহারা আইন ভঙ্গ করা থেকে বিরত থাকতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করছেন এবং একইসঙ্গে শ্রম আইন বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। শুনানীন্তে মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন রুলটি খারিজ করে দেয়।
হাইকোর্ট ডিভিশন পর্যবেক্ষণে বলেন যে- শ্রম আইনের ধারা ৪, ১১৭ এবং ২৩৪ ভঙ্গে শ্রম আইনের অধ্যায় উনিশে কোন দন্ডের বিধান না রাখলেও এমন বিধানগুলো ভঙ্গের কারণে ৩০৭ ধারার অধীন দন্ডযোগ্য এবং যা কিনা সর্বোচ্চ টাকা ২৫,০০০/- দন্ডে দন্ডিত হতে পারে। সত্য যে- ২৩৪ ধারা ভঙ্গের দেওয়ানী প্রতিকার হিসেবে ২৩৬ ধারায় যথা উপযুক্ত বিধান আছে কিন্তু তার প্রতিবিধান না চেয়ে ৩০৭ ধারায় অভিযোগ আনতে কোন আইনত বাধা নাই।
মাননীয় শ্রম আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেন যে- অত্র মোকদ্দমাটি শ্রমিকদের শিক্ষানবিশ কাল সময়ান্তে আইনের বিধান অনুযায়ী চাকুরী স্থায়ীকরণ না করা, আইনের বিধান অনুসারে মজুরিসহ বাৎসরিক ছুটি প্রদান না করা, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ প্রদান না করা এবং আইনের ২৩৪ ধারা অনুযায়ী শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা না করা এবং নিট লভ্যাংশের ৫% উক্ত দুটি তহবিল ও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন-২০০৬ অনুযায়ী গঠিত তহবিলে নির্দিষ্ট হারে (৮০:১০:১০) জমা প্রদান না করার অভিযোগে আনীত। যাহা সম্পূর্ণ শ্রমিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হওয়ায় বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ৩১০ ধারায় আদেশ প্রদানের জন্য যথা উপযুক্ত।
বাংলাদেশ শ্রম আইন -২০০৬ এর ৩০৭ ধারার শিরোনাম ‘অন্যান্য অপরাধের দন্ড’:- কোন ব্যক্তি এই আইন বা কোন বিধি, প্রবিধান বা স্কিমের কোন বিধান লংঘন করিলে বা মানিতে ব্যর্থ হইলে এবং ইহার জন্য উহাতে অন্য কোন দণ্ডের বিধান না থাকলে তিনি ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
শ্রম আইনের কতিপয় বিধি, বিধান, প্রবিধান প্রতিপালন করা হচ্ছে কিনা তা দেখভাল করার জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ।কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গ্রামীণ টেলিকম সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন টিম শ্রম আইন লংঘন পাইয়া উহা সংশোধনের জন্য গ্রামীণ টেলিকম বরাবরে পত্র প্রেরণ করে। উক্ত পত্রের প্রেক্ষিতে গ্রামীণ টেলিকম জবাব প্রদান করেন কিন্তু উক্ত জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় আবারো গ্রামীণ টেলিকম বরাবরে লঙ্ঘিত বিধি-বিধান সংশোধনের সময় সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়ে সংশোধনের জন্য পত্র প্রেরণ করেন। অধিকন্তু দ্বিতীয় জবাবেও গ্রামীণ টেলিকম শ্রম আইন লঙ্ঘন সন্তোষজনকভাবে সংশোধন না করায় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক মামলাটি দায়ের করতে বাধ্য হন। অত্র মামলাটি শ্রম আইনের ৩০৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে মূলত গ্রামীণ টেলিকমের ধারাবাহিক শ্রম আইন লঙ্ঘনের কারণে।
শ্রম আইন এর ৩০৩ (ঙ)ধারায় উল্লেখ আছে-এই আইন অথবা কোন বিধি,বিধান প্রবিধান, বা স্কিমের অধীন রক্ষনীয় বা প্রেরিতব্য কোন নকশা, তালিকা, নথি রেজিস্টার তথ্য, রিপোর্ট অথবা অন্য কোন দলিল দস্তাবেজ ইচ্ছাকৃতভাবে রক্ষন করিতে অথবা প্রেরণ করিতে ব্যর্থ হইলে অথবা গাফিলতি করিলে তিনি ছয় মাস পর্যন্ত অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত হইবেন। গ্রামীন টেলিকম তাদের জবাবে স্পষ্টত: স্বীকার করেছে যে- তারা নথি, রেজিস্টার বাংলাদেশ শ্রম আইন -২০০৬ অনুযায়ী সংরক্ষণ করে নাই। অত্র কার্য দ্বারা গ্রামীণ টেলিকম শ্রম আইন অনুযায়ী নথি, রেজিস্ট্রার সংরক্ষণে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের চাহিত মতে প্রেরণ করতে সুস্পষ্ট ভাবে গাফিলতি করেছে।উল্লেখ্য গ্রামীণ টেলিকমের অভিযোগ নামীয় চারজন আসামীর বিরুদ্ধে ৩০৩ (ঙ)ধারায় চার্জ গঠন করা হলে আসামীগণ উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ ক্রিমিনাল মিসলেনিয়াস কেস নম্বর- ৪১৯৮৪/২০২৩ দায়ের করলে মহামান্য আদালত শুনানীন্তে শ্রম আদালতের চার্জ গঠনের আদেশ বহাল রাখেন ।
চাকুরী বিধি অনুমোদনের জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের মহা পরিদর্শকের নিকট উপস্থাপিত হলে মহাপরিদর্শক কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন সেই বিষয়ে গ্রামীণ টেলিকম অবহিত হতে না পারলে শ্রম আদালতের মাধ্যমে জানবার সুযোগ ছিল। শ্রম আইন অনুযায়ী স্থায়ী শ্রমিকের সকল সুযোগ সুবিধা যে প্রদান করা হয়েছে তা গ্রামীণ টেলিকম অত্র আদালতে উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। শ্রমিকদের চাকুরী স্থায়ী না করা ও স্থায়ী শ্রমিকদের ন্যায় চাকুরীর সুযোগ-সুবিধা প্রদান না করায় গ্রামীণ টেলিকম শ্রম আইনের লংঘন করেছেন।
গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে :- প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক- কর্মচারীদের আইনের বিধান অনুসারে মজুরিসহ বাৎসরিক ছুটি প্রদান, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীত নগদ অর্থ প্রদান করা হয় নাই যা শ্রম আইনের লঙ্ঘন। তৃতীয় অভিযোগ হইল শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয় নাই এবং নিট লভ্যাংশের ৫% উক্ত দুটি তহবিল শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন- ২০০৬ অনুযায়ী গঠিত তাহলে নির্দিষ্ট হারে (৮০:১০:১০) জমা প্রদান করা হয় নাই যাহা বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ২৩৪ ধারার লংঘন করেছেন। আসামীদের স্বীকৃত মতেই প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করেন নাই। গ্রামীন টেলিকম নট ফর প্রফিট কোম্পানি তা তাদের দাখিলিও মেমোরেন্ডাম এন্ড আর্টিকেলস অফ অ্যাসোসিয়েশনের কোথাও পরিলক্ষিত হয় না বরং অনুচ্ছেদ একাত্তরে গ্রামীণ টেলিকমের প্রফিট সম্পর্কে বলা আছে। তাছাড়া কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা শ্রমিকদের মুনাফা প্রদান হতে কোন প্রতিষ্ঠানকে অব্যাহতি প্রদান করা হয় নাই। সুতরাং গ্রামীণ টেলিকম যেহেতু প্রফিট করে সেহেতু উক্ত প্রফিট অংশ অনুপাতে শ্রম আইনের ২৩৪ ধারা অনুযায়ী শ্রমিকের প্রাপ্য কিন্তু শ্রমিকের কল্যাণে তাহা প্রদান না করায় গ্রামীণ টেলিকম সেই বিধান লংঘন করেছেন।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ই-মেইল: mondolarif@yahoo.com