ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সহিদুল ইসলাম পাপুলের শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের আয়কর রিটার্ন নথি ঘষামাজা করে পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা করার অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ঢাকা কর অঞ্চল-৮ অফিসের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আজ সোমবার (২৯ এপ্রিল) এ মামলার অনুমোদন দিয়েছে কমিশন।
সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সহিদ ইসলাম পাপুলের অবৈধ টাকায় বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হন তার শ্যালিকা জেসমিন প্রধান। তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ও পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে পৃথক কর সার্কেলে দুটি টিআইএন খোলেন। এরপর ২০২১ এক বছরে প্রস্তুত করেন পাঁচ করবর্ষের রিটার্ন দাখিলের নথি। এ ছাড়া অডিট প্রতিবেদন ও ব্যাংক বিবরণী ঘষামাজা করে তৈরি করেন।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে এসব তথ্য-প্রমাণ পাওয়ায় জেসমিন প্রধান ও কর অফিসের দুইজনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশসহ কমিশন অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেন দুদকের উপপরিচালক মো. মশিউর রহমান। কমিশন প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই শেষে মামলার অনুমোদন দেয়।
মামলার আসামিরা হচ্ছেন ঢাকা কর অঞ্চল-৮ অফিসের সার্কেল-১৬৫ এর উপ কর কমিশনার খন্দকার মো. হাসানুল ইসলাম, কর অফিসের উচ্চমান সহকারী (বর্তমানে পিআরএল ভোগরত) হিরেশ লাল বর্মণ ও জেসমিন প্রধান।
এ বিষয়ে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, জেসমিন প্রধানের আয়কর রিটার্নের তথ্য ঘষামাজা করে তথ্য সরানোর অভিযোগে ঢাকা কর অঞ্চল-৮ অফিসের সার্কেল-১৬৫ এর উপ কর কমিশনারসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। শিগগিরই মামলাটি দায়ের করা হবে।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, জেসমিন প্রধান ঢাকা কর অঞ্চল-৮ অফিসের সার্কেল-১৬৫ এর কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে যোগসাজশের মাধ্যমে ২০১৬-১৭ করবর্ষ থেকে ২০২০-২০২১ করবর্ষ পর্যন্ত রিটার্ন একই দিনে দাখিল করেন। ওই পাঁচ বছরের আয়কর রিটার্নের রেকর্ড থেকে দেখা যায়- তার মোট আয়ের কলামে ঘষামাজা রয়েছে।
৭৪ ধারার কলামে, ব্যবসায় মূলধন বিনিয়োগ কলামে ঘষামাজা, হাতে নগদ ও ব্যাংক স্থিতি কলামে, রিটার্ন রেজস্টিারে নিট সম্পদ কলামে ভিন্ন হাতের লেখায় বিভিন্ন সংখ্যা বসানো ছাড়াও রিটার্ন রেজিস্ট্রারে পারিবারিক ব্যয়ে আয়কর রিটার্নে ভিন্নতা পাওয়া যায়।
করদাতা জেসমিন প্রধানের ওই পাঁচ করবর্ষ পর্যন্ত সার্বজনীন স্ব-নির্ধারণী পদ্ধতিতে দাখিল করা আয়কর রিটার্নের সঙ্গে যেসব ব্যাংক বিবরণী জমা দিয়েছেন তার প্রতিটির জেনারেটেড ও প্রিন্টেড তারিখ ২০২০ সাল। এ ছাড়া তার আয়কর রিটার্নের সঙ্গে দাখিল করা অডিট প্রতিবেদনটিও জাল করেছেন। পাঁচ বছরের অডিট প্রতিবেদনগুলো পৃথক থাকার কথা থাকলেও সেগুলো ২০২০ সালে প্রস্তুত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করদাতা জেসমিন প্রধানের ২০১৬-১৭ করবর্ষে ৩,৫০,০০০ টাকা; ২০১৭-১৮ করবর্ষে ৩,৫০,০০০ টাকা, ২০১৮-১৯ করবর্ষে ৪,৫০,০০০ টাকা; ২০১৯-২০ করবর্ষে ৪,৫০,০০০ টাকা মোট আয় লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। কিন্তু তার আয়কর রিটার্নে ২০১৬-১৭ করবর্ষে মোট আয় ১৩,৫০,০০০ টাকা, ২০১৭-১৮ করবর্ষে ২১,৫০,০০০ টাকা; ২১৮-১৯ করবর্ষে ৩৬,৪৫,০০০ টাকা এবং ২০১৯-২০ করবর্ষে ৪৩,৭৫,০০০ টাকা উল্লেখ রয়েছে।
এই করদাতার আয়কর রিটার্নের সঙ্গে স্টক রেজিস্টার এবং মাসিক কর নির্ধারণী রেজিস্টারের কোনো মিল পাওয়া যায়নি; অর্থাৎ মূল রিটার্নগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে। জেসমিন প্রধান কর অঞ্চল-৮ এর সার্কেল- ১৬৫ এর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে রিটার্ন রেজিস্ট্রার ঘষামাজা করে মোট আয়, মোট সম্পদ, নিট সম্পদ, পারিবারিক ব্যয় ইত্যাদি পরিবর্তন করেন।
এ ঘটনার সঙ্গে কর অঞ্চলের উপ কর কমিশনার খন্দকার মো. হাসানুল ইসলাম ও উচ্চমান সহকারী (বর্তমানে পিআরএল থাকা) হিরেশ লাল বর্মণ এবং করদাতা জেসমিন প্রধান পরস্পর যোগসাজশ রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় মামলা দায়েরের অনুমোদন দেওয়া হয়।
দুদকের তথ্যমতে, ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে জেসমিন প্রধান, তার ভগ্নিপতি সাবেক এমপি পাপুল, বোন সেলিনা ইসলাম ও ভাগনি ওয়াফা ইসলামকে আসামি করে মামলা করে দুদক। মামলার এজাহারে বলা হয়, জেসমিন প্রধান ২ কোটি ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৮ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। জেসমিন প্রধান একটি সাধারণ পরিবারের মেয়ে। অথচ সাধারণ পরিবারের সন্তান জেসমিন প্রধান এখন বিত্তশালী।
বাড়ি, গাড়ি, আলিশান ফ্ল্যাট সব কিছুই আছে তার। ২৩ বছর বয়সী জেসমিনের নিজস্ব কোনো আয়ের উৎস নেই। অথচ ৭ বছরের ব্যবধানে তিনি বনে গেছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। তার ‘লিলাবালি’ নামে একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে জেসমিন প্রধান ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৪৮ কোটি ৪১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৬১ টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪(২), ৪(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কাজী সহিদ ইসলাম পাপুল। পরে তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করিয়ে আনেন। অর্থ ও মানবপাচার এবং ঘুষ প্রদানের অভিযোগে ২০২০ সালের জুন মাসে কুয়েতে গ্রেপ্তার হন পাপুল। ওই মামলার বিচার শেষে ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি তাকে চার বছরের কারাদণ্ড দেয় কুয়েতের একটি আদালত। কুয়েতের রায়ের নথি হাতে পাওয়ার পর ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাপুলের সংসদ সদস্য পদ বাতিল করে জাতীয় সংসদ।