প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছেন, আইন একটি সহজ বিষয়, কোনো বিচারেই এমনটি দাবী করা যাবে না। এমনকি আমরা যারা আইনের জগতের মানুষ, সারা জীবন আইনের বইপত্র-সাময়িকী কিংবা মামলার নথিতেই যাদের জীবন কেটে যাচ্ছে। তাদের কাছেও আইন প্রায়শই দুর্বোধ্য হয়ে ধরা দেয়।
সুপ্রীম কোর্ট লিগাল এইড কমিটির সহায়তায় আজ মঙ্গলবার (৭ মে) বিকাল ৪:১৫ ঘটিকায় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রযোজিত আইন বিষয়ক উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠান ‘প্রমাণিত: অপ্রমাণিত- আইনের সহজপাঠ’ – এর আনুষ্ঠানিক যাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুল হাসান বলেন, দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে আইনের বিভিন্ন দিক সহজবোধ্য করে তুলে ধরার কঠিন কাজটি যিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, আজকের এই সৃষ্টিশীল কর্মের যিনি মূল রূপকার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা আইন সচেতনতামূলক নাটিকা নির্মাণের মাধ্যমে সময়োপযোগী এই উদ্যোগ গ্রহণের জন্য।
আরও পড়ুন: পরিবেশ রক্ষায় সারা দেশে গাছ কাটা নিয়ন্ত্রণে হাইকোর্টের রুল
প্রধান বিচারপতি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে প্রমাণিত, অপ্রমাণিত সাধারণ দু’টো শব্দ মনে হলেও, আইনের জগতে এই শব্দ দু’টি নানা মাথায় আমাদের কাছে ধরা দেয়। আমাদের দেশে আদালতে কোনো কিছু প্রমাণ ও অপ্রমাণের যে যাত্রা তা অনেক ক্ষেত্রেই সুদীর্ঘ। এই যাত্রা পথে কত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার জড়িয়ে রয়েছে তা আমরা অনেকেই হয়তো হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারি না।
তিনি বলেন, দেশের মাত্র ২০০০ হাজার বিচারক ৪০ লাখেরও অধিক মামলা নিষ্পত্তির কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে, তবুও মামলাজট হতে পরিত্রাণ পাচ্ছি না। অনেক ক্ষেত্রেই একটি মামলা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হতে দশ-বারো বছর লেগে যায়। ইতোমধ্যে হয়তো বিচারপ্রার্থী লোকটি সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে মামলার খরচ চালাতে গিয়ে। এ সবই আমাদের দেশের বাস্তবতা।
তিনি আরও বলেন, আবার একথাও সত্যি, আদালতে এমন অনেক বিষয় নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হয় যা হয়তো মামলা পর্যন্ত গড়াতই না, যদি সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের মধ্যে আইনি সচেতনতা থাকত। এমন প্রেক্ষাপটে বিটিভির মত একটি সুদূর বিস্তৃত প্লাটফর্ম মানুষের মধ্যে আইনি সচেতনতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক।
আরও পড়ুন: ১ মাস আইন পেশা পরিচালনা করতে পারবেন না খুলনার পিপি
প্রধান বিচারপতি বলেন, এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, সরকার বিগত এক দশকে বিচার কার্যক্রমকে গতিশীল করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে, লিগ্যাল এইড কার্যক্রমকে তৃণমূল পর্যায়ে কার্যকর করার মাধ্যমে এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আইনের আশ্রয় লাভের সাংবিধানিক অধিকার আরও সহজতর হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট হতে শুরু করে দেশের ইউনিয়ন পর্যায়েও লিগ্যাল এইড কমিটি রয়েছে।
তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, আজ যে অনুষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হলো আরও অনুষ্ঠান নির্মাণ করে যদি সিরিজ আকারে প্রচার করা হয় এবং সেই অনুষ্ঠানগুলো যদি দেশের সকল লিগ্যাল এইড অফিস ও লিগ্যাল এইড কমিটির মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে প্রদর্শন করা হয় তবে দেশের সাধারণ মানুষ মানুষের আইনি সচেতনা বৃদ্ধি পাবে, মানুষ আইনের সহজপাঠের প্রাথমিক দীক্ষা পাবে।
তিনি আরও বলেন, উন্নত রাষ্ট্রে বিভিন্ন জনপ্রিয় লিগ্যাল টিভি শো, রিয়ালিটি শো রয়েছে যার মাধ্যমে বিভিন্ন আইনগত সমস্যা বা বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে জনগণের মাঝে আইনগত সচেতনতা তৈরি করা হয়। এর ফলে বিনোদনের ছলে হলেও ছোটখাটো বিভিন্ন বিষয়ের আইনি ব্যাখ্যা , নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের আইনি প্রতিকার ইত্যাদি মানুষ নিজেরাই সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়।
আরও পড়ুন: সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদায় উন্নীত হলেন অধস্তন আদালতের ৫ বিচারক
ডিজিটাল বাংলাদেশ হতে আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের পথে যাত্রা শুরু করেছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই যাত্রা তবেই সফল হবে যখন ধর্ম-বর্ণ-শ্রেনি নির্বিশেষ সকলের জন্য বিচারের অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে পারবো। এছাড়া, আইনি প্রক্রিয়ায় সকলের অভিগম্যতা ছাড়া টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব একটি ব্যাপার। তাই এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের প্রত্যেককেই যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ অবসরে গিয়েছেন, কিন্তু সমাজের প্রতি তাঁর যে দায়বদ্ধতা রয়েছে সে কথা তিনি ভুলে যাননি। আজকের এই আয়োজন তারই প্রমাণ। আমার মনে হয়, আমাদের সবারই এখান থেকে শিক্ষণীয় রয়েছে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আনিসুল হক।
আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিবৃন্দ, সাবেক বিচারপতিবৃন্দ, সুপ্রীম কোর্ট লিগাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান, আইনজীবীবৃন্দ, অ্যাটর্নি জেনারেল, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় আইন সহায়তা প্রদান সংস্থার কর্মকর্তাবৃন্দ, সুপ্রীম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মকর্তাবৃন্দ, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক ও কর্মকর্তাবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিবর্গ।