প্রসঙ্গ : আইন পেশার ইতিহাস ও আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা
অ্যাডভোকেট দীপজয় বড়ুয়া

জামিন কী, কখন একজন ‘অভিযুক্ত’ জামিন লাভ করে?

দীপজয় বড়ুয়া: ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় জামিন একটি বহুল প্রচলিত পরিভাষা। সাধারণত গ্রেফতার বা আটকের পর আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আদালতে হাজির হয়েও জামিনের আবেদন করতে পারেন। নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির থাকার শর্তে জামিনদারের জিম্মায় এ ধরনের মুক্তি দেওয়া হয়।

সাধারণতঃ জামিন বলতে সংশ্লিষ্ট আদালতে সময় মত হাজির করার শর্তে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে আইনগত হেফাজত হতে মুক্তি প্রদান করে জামিনদারের নিকট সমর্পণ করা বুঝানো হয়।

ব্যাপক অর্থে জামিন অর্থ হল – যখন তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য, কখনো তদন্ত প্রভাবিত যাতে করতে না পারে সেজন্য আইনগত হেফাজতে নেওয়া হয়। সেটা পুলিশ বা আদালত যেকোনো হেফাজতে হতে পারে। বিচার চলাকালেও অপরাধের ধরণ অনুযায়ী আসামিকে আদালতের হেফাজত বা জেলহাজতের রাখা হয়। এ ধরনের আইনগত হেফাজত থেকে কাউকে ছেড়ে দেওয়াই জামিন।

আবার বিচার শেষে সাজা হলে আসামি কারাগারে থাকলে আপিলের পর  আদালত জামিন দিতে পারেন। জামিন বিষয়ে আদালতের ক্ষমতা সম্পর্কে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬ ও ৪৯৭ ধারায় আলোচনা করা হয়ছে। জামিন অযোগ্য ধারায় তদন্ত বা বিচারে বিলম্বের কারণেও আদালত জামিন দিতে পারেন।

আরও পড়ুন: আগাম জামিনের ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিতে পারবে না হাইকোর্ট

কমন ‘ল’ তে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ‘জামিন’ দেয়া হয় বলে ধরা হয়, যখন তাকে আদালতের অফিসারগণের হেফাজত হতে মুক্ত করে জামিনদার হিসাবে পরিচিত লোকদের জিম্মায় ন্যস্ত করা হয়, যারা নির্দিষ্ট সময়ে ও স্থানে তার বিরুদ্ধে আনীত চার্জের জবাব দিতে তাকে হাজির করতে বাধ্য থাকেন এবং যারা উক্তরূপ না করার কারণে জামিন দেয়ার সময়ে ধার্যকৃত অর্থ বাজেয়াক্ত করার জন্য দায়ী থাকেন।”

Wood Roffe এর ভাষায়-জামিন বলতে কোন অভিযুক্তকে আইনানুগ অফিসারের হেফাজত হতে কোন বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির হেফাজতে দেয়া বুঝায়, যিনি উক্ত অভিযুক্তকে সঠিক সময় ও তারিখে উপস্থাপন করার নিশ্চয়তা দান করেন তার বিরুদ্ধে আনীত চার্জের জবাব দিতে।

5 DLR (FC) 154 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, ‘জামিন’ অভিব্যক্তিটির মৌলিক ধারণা হলো-যেকোন ব্যক্তিকে পুলিশ কাষ্টডি হতে প্রতিশ্রুতি দাতার হাতে অর্পণ এবং উক্ত প্রতিশ্রুতি দাতা এরূপ ব্যক্তি যিনি আদালত যখনই প্রয়োজন মনে করেন তখনই উপযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করার প্রতিশ্রুতি দেন।

51 DLR (AD) 242 The State Vs. Abdul Wahab Shah Chowdhury মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “জামিন শব্দের মৌলিক অর্থ হচ্ছে কোন লোককে পুলিশের হেফাজত হতে মুক্ত করে জামিনদারের হাতে সমর্পণ করা, যিনি প্রয়োজন হওয়া মাত্র তাকে আদালতে হাজির করতে অঙ্গীকার করে থাকেন।

জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬(৪) (খ) ধারায় জামিনযোগ্য অপরাধের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- এমন একটি অপরাধ যা (ফৌজদারি কার্যবিধির) দ্বিতীয় তফসিলে জামিনযোগ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে অথবা যা বর্তমানে বলবৎ কোনো আইন দ্বারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাওয়া আইনগত অধিকার। এ ধরনের অপরাধে গ্রেফতার ব্যক্তি জামিন চাইলে এবং জামিনদার দিতে প্রস্তুত থাকলে তাকে জামিন দেওয়াটা আদালতের জন্য বাধ্যকর।

15 DLR (SC) 429 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “দরকার হলে সন্তোষজনক জামানতের শর্তে জামিনযোগ্য অপরাধগুলিতে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাবার অপরাজেয় অধিকার আছে।”

41 DLR 291 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,” জামিনে মুক্ত হতে হলে কোন ব্যক্তিকে অবশ্যই হেফাজতে বা অন্য কোন প্রকার আবদ্ধ স্থানে থাকতে হবে, অন্যথায় তাকে কোন আবদ্ধ স্থান থেকে বা হেফাজত থেকে মুক্তি দেয়া হবে তা বোঝা যাবে না”।

জামিনের অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিনের কিরূপ ব্যবস্থা

১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় এ সংক্রান্ত বিধান করা হয়েছে। এই ধারা অনুসারে-

“(১) জামিন অযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত কোন লোক কোন থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার কর্তৃক বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার হলে বা আটক থাকলে অথবা আদালতে হাজির হলে বা তাকে হাজির করা হলে, তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া যেতে পারে, কিন্তু সে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোন অপরাধে অপরাধী বলে বিশ্বাস করার মত যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে উক্তরূপে মুক্তি দেয়া যাবে নাঃ

তবে শর্ত থাকে যে, এরূপ অপরাধে অভিযুক্ত কোন লোক ষোল বৎসরের নিম্ন বয়স্ক বা স্ত্রীলোক বা পীড়িত বা অক্ষম হলে আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দিতে পারেন।

(২) তদন্ত অনুসন্ধান বা বিচারের কোন পর্যায়ে উক্ত অফিসার বা আদালতের নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, আসামী কোন জামিন অযোগ্য অপরাধ করেছে বলে বিশ্বাস করার মত যুক্তিসংগত কারণ নাই, তবে তার দোষ সম্পর্কে আরও তদন্তের পর্যাপ্ত ভিত্তি রয়েছে, তাহলে এরূপ তদন্ত সাপেক্ষে আসামীকে জামিনে অথবা উক্ত অফিসার বা আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতায় অতঃপর বর্ণিতভাবে সে হাজির হবার জন্য জামিনদার ব্যতীত মুচলেকা সম্পাদন করলে তাকে মুক্তি দিতে হবে।

আরও পড়ুন: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কিভাবে জামিন নিবেন

(৩) কোন অফিসার বা আদালত (১) উপধারা বা (২) উপধারার অধীন কোন লোককে মুক্তি দিলে তার ঐরূপ করার কারণ লিপিবদ্ধ করবেন।

(৪) জামিন অযোগ্য কোন অপরাধে অভিযুক্ত লোকের বিচার সমাপ্ত হবার পর এবং রায় দানের পূর্বে কোন সময় আদালত যদি মনে করেন যে, আসামী উক্ত অপরাধে অপরাধী নয় বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে, তাহলে আসামী হাজতে থাকলে রায় শ্রবণের উদ্দেশ্যে হাজির হবার জন্য জামিনদার ব্যতীত মুচলেকা সম্পাদনের পর তাকে মুক্তি দিবেন।”

49 DLR (AD) 119 Jobaida Rashid Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “যে মামলায় জামিন না দেওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে সেই মামলায়ও কোন মহিলা কিংবা অসুস্থ ও বৃদ্ধ আসামীকে জামিন দেয়া যায়।” 18 DLR (SC) 390 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “প্রকৃতপক্ষে দুর্বল এবং অসুস্থ ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড কিংবা তার চেয়ে কম দণ্ডযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হলেও তাকে জামিন দেয়া যায়।”

7 BCR (AD) 145 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “যাদের নামে এজাহার করা হয়েছে, জামিনের আবেদন বিবেচনা করার জন্য তাদের প্রত্যক্ষ বা প্রকাশ্যে কৃতকার্য বিবেচনা করা প্রয়োজন। যদি ইহা দেখা যায় যে, এজাহারে বর্ণিত কতিপয় আসামী যদিও উপস্থিত ছিল তবুও মৃত ব্যক্তির আক্রমণের ক্ষেত্রে তারা, প্রধান এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে নাই, তাহলে তারা জামিন পেতে অধিকারী”।

তদন্তে বিলম্বের কারণে জামিন

জামিন অযোগ্য মামলায় তদন্তে ১২০ দিনের বেশি বিলম্ব হলে আদালত জামিন দিতে পারেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ (৫) ধারার বিধান মতে, অপরাধ সংঘটনের ব্যাপারে সংবাদ পাওয়ার তারিখ হতে অর্থাৎ মামলা দায়ের থেকে অথবা তদন্তের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ পাওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন না হলে অপরাধটি মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা দশ বছরের বেশি মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হলে দায়রা আদালত এবং অনান্য ক্ষেত্রে অপরাধ আমলে নেওয়ার এখতিয়ার সম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট স্বীয় সন্তুষ্টি মোতাবেক শর্তে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন।

13 MLR(AD) (2008) 62- The State Vs. Joinal fakir & others-মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,যখন ৮ মাসের মধ্যে তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হয় না এবং আসামীরা জেলে থাকে, তখন হাইকোর্ট বিভাগ আসামীদের জামিন মঞ্জুর করে। সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের এই সিদ্ধান্তকে যুক্তিসংগত মনে করে”।

বিচারে বিলম্বের কারণে জামিন

ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৯ গ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষেত্রে বিচারকার্য সমাপ্ত করার সময় ১৮০ দিন এবং দায়রা আদালত কর্তৃক বিচারকাজ নিষ্পত্তির সময় ৩৬০ দিন। এই সময়ের মধ্যে বিচারকাজ নিষ্পত্তি না করা গেলে এই ধারা অনুযায়ী বিচারিক আদালত জামিন অযোগ্য মামলায় জামিন দিতে পারেন।

55 DLR 33(AD) মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ এমনকি অ-জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে আসামী জামিনে থাকিবেন,যতক্ষণ পর্যন্ত না আদালতে নিকট মামলা সংক্রান্ত ভিন্ন কোন কারণ পরিলক্ষিত হয়”।

15 BLD 88-৩৩৯-গ(৩) ধারায় বলা হয়েছে যে, “মামলার বিচার নির্দিষ্ট ও বর্ধিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা না গেলে বিচার সম্পর্কে  আরো কার্যক্রম বন্ধ থাকবে এবং অভিযুক্তকে মুক্তি দিতে হবে।৩৩৯-গ(৪) ধারায় বলা হয়েছে যে,মামলা বিচার সম্পর্কে আরো কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে এবং অভিযুক্তকে জামিনে মুক্তি দেয়া বাধ্যতামূলক”।

হাইকোর্ট দায়রা আদালত কর্তৃক জামিন অযোগ্য মামলায় জামিন

জামিন অযোগ্য যেকোনো অভিযোগে হাইকোর্ট বিভাগ ও দায়রা আদালত জামিন দিতে পারেন। এ বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘দণ্ডের পর আপিল থাকুক আর না থাকুক হাইকোর্ট বিভাগ বা দায়রা আদালত যেকোনো ক্ষেত্রে যেকোনো ব্যক্তিকে জামিন মঞ্জুর করিবার আদেশ দিতে পারেন। ’ নিম্ন আদালতের জামিন নামঞ্জুরের আদেশের বিরুদ্ধে এই ধারায় ফৌজদারি বিবিধ (সিআর মিস) মামলা দায়ের করে জামিন চাওয়া হয়।

আগাম জামিন কখন নেওয়া যায়

আগাম জামিনের জন্য আইনে আলাদা কোনো বিধান নেই। হাইকোর্ট বিভাগে আগাম জামিনের দরখাস্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮ ধারাতেই করা হয়। মূলত, পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার বা বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের পূর্বেই হাইকোর্ট বিভাগ সীমিত একটি সময়ের জন্য আগাম জামিন মঞ্জুর করে থাকেন।

এক্ষেত্রে, আপাত দৃষ্টিতে জামিন পাওয়ার মতো যুক্তি সঙ্গত ভিত্তি থাকতে হবে বা জামিন দেওয়া না হলে তিনি অন্যায়ের শিকার হতে পারেন মর্মে আশঙ্কা থাকতে হবে। আগাম জামিন আদালতের বিবেচনায় বিশেষ ও ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে মঞ্জুর করা হয়। তদন্ত চলাকালে এমনকি চার্জশিট দাখিলের পরও আগাম জামিন নেওয়া যায়। তবে আগাম জামিনের পর উচ্চ আদালতের নির্দেশ মোতাবেক নিম্ন আদালতে জামিননামা দাখিল করে নিয়মিত জামিন নিতে হয়।

সুতরাং বলা যায় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইনগত হেফাজত থেকে মুক্তি হলো জামিন। পুলিশ বা আদালতের হেফাজত থেকে নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির থাকার শর্তে জামিনদারের জিম্মায় নির্দিষ্ট পরিমাণ জামানত প্রদানের প্রতিশ্রুতি সাপেক্ষে জামিনে মুক্তি প্রদান করা হয়।চূড়ান্ত বিচারের পূর্বে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অনেক ক্ষেত্রে আইনগত হেফাজতে নেওয়া হয়।

লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।

তথ্যসূত্র

ফৌজদারী কার্যবিধি-জহিরুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধি- মুহাম্মদ সাইফুল আলম, ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য-গাজী শামসুর রহমান, শতাধিক বছরের ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্স-এডভোকেট কামালউদ্দিন, ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্স- জীবরুল হাসান,উইকিপিডিয়া,ল’পোর্টাল, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং ম্যাজিষ্ট্রেটের করণীয়- বিচারপতি মোঃ আজিজুল হক, Section Wise 100 years Reference on Crpc, Section Wise 100 years Reference on Penal Code- Md. Abul Kalam Azad।