সুলতান মোহাম্মদ অহিদ: দেশের বিদ্যমান খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি [Alternative Dispute Resolution (ADR)] পদ্ধতি ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দিয়ে গত ১২ মে, ২০২৪ তারিখে একটি নতুন সার্কুলার জারি করেছে, যা বিআরপিডি সার্কুলার নাম্বার-১১ হিসেবে পরিচিত।
উক্ত সার্কুলার দ্বারা বিকল্প বিরোধ পদ্ধতি (ADR) অনুসরণের মাধ্যমে আগামী ৩০ জুন,২০২৬ তারিখের মধ্যে প্রত্যেক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ স্থিতির ন্যূনতম ১% নগদ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
সার্কুলারটি দ্বারা বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত বকেয়া ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়ে নির্দেশনা প্রদান করে, যথা:-
(১) ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনাদায়ী পাওনা সহ অন্যান্য যেকোনো বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে তফসিলি ব্যাংকসমূহকে Bangladesh International Arbitration Centre (BIAC) এর সহায়তা নেওয়া;
(২) BIAC সহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানে তালিকাভুক্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ মধ্যস্থতাকারী অথবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আইনজীবী অথবা অন্য যেকোনো উপযুক্ত ব্যক্তি যাদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সফলতার রেকর্ড রয়েছে তাদেরকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নির্বাচন করা;
(৩) মধ্যস্থতাকে সফল করা এবং খেলাপি ঋণ দ্রুত আদায়ের স্বার্থে প্রয়োজনে কেস টু কেস ভিত্তিতে বিদ্যমান বিআরপিডি সার্কুলার/নির্দেশনা মোতাবেক ব্যাংক কর্তৃক ছাড় প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা;
(৪) মধ্যস্থতার মাধ্যমে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকারী টিমকে স্বীকৃতি প্রদান/পুরস্কৃত করার পাশাপাশি আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা;
(৫) মধ্যস্থতায় ব্যর্থতার ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধান করত: প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
(৬) মধ্যস্থতা ফলপ্রসূ না হলে এবং সে ক্ষেত্রে উভয়পক্ষ আগ্রহী হলে আরবিট্রেশন প্রক্রিয়ায় যাওয়ার জন্য এবং প্রয়োজনে BIAC সহ এরূপ অন্যান্য আরবিট্রেশন সেন্টার সমূহের সাথে ব্যাংক সমূহকে চুক্তি (MoU) সম্পাদন করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: মামলা নয়, সমঝোতায় খেলাপি ঋণ আদায়ের নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের
বাংলাদেশ ব্যাংকের উক্ত সার্কুলারে অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর ২২ ধারায় বর্ণিত মধ্যস্থতার (Mediation) মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির বিধানকে আলোকপাত করলেও অর্থঋণ আদালত আইনের আওতায় দায়েরকৃত মামলাসমূহে মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে সফলতার হার আশানুরূপ না হওয়ার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়, যথা:-
১. খেলাপি গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে সদিচ্ছার অভাব,
২. মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে ব্যাংকসমূহের ছাড় না দেওয়ার প্রবণতা,
৩. ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দেয়া,
৪. মধ্যস্থতাকারীর পারিশ্রমিক নির্ধারণ ও পরিশোধে অনীহা/কালক্ষেপণ,
৫. পক্ষসমূহের মতভেদ দূর করতে মধ্যস্থতাকারী কর্তৃক যথাযথ ভূমিকা না রাখা ইত্যাদি।
মূলত: আইনানুগ ভাবে খেলাপি বা বকেয়া ঋণ আদায়ের জন্য দেশে মূল যে বিচার ব্যবস্থা বিদ্যমান, তা ২০০৩ সালের অর্থঋণ আদালত আইনের অধীনে দেশের প্রতিটি বিভাগে অর্থঋণ আদালত (যুগ্ম জেলা জজ মর্যাদা সম্পন্ন আদালত) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। উক্ত আইনের ২২, ২৩, ২৪ ও ২৫ ধারার বিধান মতে মামলার মূল বিচারকার্য শুরু করার প্রারম্ভে মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টাকে আইনে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
অর্থাৎ এই মধ্যস্থতা পদ্ধতি ব্যতীত কোন অর্থ ঋণ মামলার বিচার দৌতরফা সূত্রে নিষ্পত্তি করা যাবে না। তাছাড়া উল্লেখিত আইনে নিযুক্তিয় মধ্যস্থতাকারীকে ২-৩ মাসের মধ্যে তাহার কার্যক্রম সমাপ্ত করে সংশ্লিষ্ট আদালতে রিপোর্ট দাখিলের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, উক্ত অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিগত ১২ মে, ২০২৪ তারিখের বিআরপিডি সার্কুলার নাম্বার ১১-তে বর্ণিত মধ্যস্থতা (Mediation) কার্যক্রম দ্বারা বাস্তবিক পক্ষে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সফলতা কতটুকু?
বাস্তবিক অভিজ্ঞতা থেকে এর উত্তরে বলা যায়, মধ্যস্থতা পদ্ধতিতে অর্থঋণ মামলা নিষ্পত্তির হার ১%(এক) শতাংশের নিচে। আমার দৃষ্টিতে এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে প্রধান বা মূল কারণ হলো, মধ্যস্থতার মাধ্যমে আপোষ করার ক্ষেত্রে ব্যাংকের অসহযোগিতা।
আরও পড়ুন: ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, পাবে না ট্রেড লাইসেন্স
অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর ২৪ ধারানুসারে বাদী তথা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ বা এরকম কোন উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ রেজুলেশনের মাধ্যমে তার কেন্দ্রীয় আঞ্চলিক বা স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবস্থাপক বা অন্য কোন কর্মকর্তাকে মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে কার্যকর ভূমিকা নেবার ক্ষমতা অর্পণ করবেন মর্মে আইনে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আপোষে সুদ মওকুফের কিংবা অন্য কোন ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে নিজের অক্ষমতার কথা প্রকাশ করে।
মধ্যস্থতা কার্যালয়ে একটি ছোট সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাংক কর্মকর্তাগণ তাদের প্রধান কার্যালয়ের অনুমতির দোহাই দিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকে। অথচ, এই ধরনের আপোষের বৈঠকে বিবাদী তথা খেলাপি ঋণ গ্রহীতাগণ ব্যাংক ঋণের সুদ ও অন্যান্য খরচ মওকুফ সহ কিস্তিতে পরিষদের সহজ সুবিধা পেলে অর্থঋণ মামলায় মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে নিষ্পত্তি হার কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে।
এ ধরনের ক্ষমতা বিহীন ব্যাংক কর্মকর্তাগণের উপস্থিতিতে মধ্যস্থতার কার্যক্রম পরিচালনা করা নিতান্তই হাস্যকর, যা সময় ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গত ১২ মে, ২০২৪ তারিখের বিআরপিডি সার্কুলার নং- ১১ দ্বারা কিংবা অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর বিধান দ্বারা ব্যাংক ঋণ সংক্রান্ত বিদ্যমান বিরোধ বিকল্প পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করাকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তাই, ব্যাংক ঋণ সংক্রান্ত বিরোধ সমূহ বিকল্প পদ্ধতিতে নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেই সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হতে হবে এবং মধ্যস্থতাকারীর নিকট যারা প্রতিনিধিত্ব করবে তাদেরকে অবশ্যই সিদ্ধান্ত প্রদান করার ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি হতে হবে। নতুবা অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর ২২ ধারা কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার দ্বারা মধ্যস্থতার বিষয়ে কোন আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাবে না।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।