প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছেন, দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাস্তবতায় আইনের কঠোর প্রয়োগ সময়ের দাবি। গণতন্ত্রের অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে জবাবদিহিতা। রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক পরিচালনা কাঠামো গড়ে তোলা হলে দুর্নীতি এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। তা না হলে কখনোই দুর্নীতির গভীর ক্ষত সেরে উঠবে না।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সোমবার (৮ জুলাই) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে ‘দুর্নীতি ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ-গঠনে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক হারুন–অর–রশীদ। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. মশিউর রহমান।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে গণভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ডেপুটি মন্ত্রী এবং যেসব ব্যক্তি এ ধরনের পদ মর্যাদার ভোট করছেন তাদের নামে ও তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের নামে থাকা সম্পত্তির হিসাব বঙ্গবন্ধুর কাছে জমা দিতে হবে। একই বছরের ১৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু সংসদ সদস্যদের প্রতিও এরূপ হিসাব দাখিলের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ওই দূরদর্শিতা যে কতটা প্রাসঙ্গিক, আজকের দিনেও তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি।
তিনি বলেন, কেবল আইন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা হয় না, দুর্নীতিও বন্ধ হয় না। এর জন্যে দরকার সচেতনতা, সামাজিক আন্দোলন। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু বারবার মানুষের কাছে ফিরে গিয়েছেন, উদ্ধুদ্ধ করেছেন, মিনতি করেছেন, যাতে সমাজের প্রত্যেকটা স্তর থেকে দুর্নীতি বিতাড়ণে গণচেতনা বিকশিত হয়।
প্রধান বিচারপতি বলেন, তরুণদের প্রশ্ন করতে হবে তাদের পিতা-মাতার অর্জিত অর্থটা ন্যায়সঙ্গত পথে এসেছে তো? স্ত্রীদের কৌতূহল থাকতে হবে, স্বামীর বিত্ত-বৈভবে অবৈধ অর্থের অংশ নেই তো? বন্ধু পরিজনদের সচেতন হতে হবে, নিকটজনদের উপার্জনটা সঠিক নিয়মে, হচ্ছে তো? এটাই সামাজিত সচেতনতার প্রথম ধাপ। দুর্নীতিবাজ পিতাকে, দুর্নীতিবাজ স্বামী বা স্ত্রীকে, দুর্নীতিবাজ সহকর্মীকে একঘরে করা না গেলে, বয়কট করা না হলে কখনোই দুর্নীতির গভীর ক্ষত সেরে উঠবে না, এ রোগের উপশম হবে না।
এগিয়ে যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘শিক্ষা, জীবনমান উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ গঠন থেকে শুরু করে সামাজিক সুরক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব—এ রকম নানা মাত্রায় আমরা অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছি, নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে চলেছি। কিন্তু একই সঙ্গে স্বীকার করতে হবে, দুর্নীতির মতো অতলবিস্তৃত ব্যাধি থেকে আমরা পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের উন্নয়নের সুফলগুলো দুর্নীতির চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে, আমাদের উজ্জ্বল অর্জনগুলো দুর্নীতির অন্ধকারে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এ দুর্নীতি আমাদের জন্য একদিকে যেমন কলঙ্কের, অপমানের, তেমনি বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়, আমাদের সুবিচারবোধের উন্মেষের পথে বৃহত্তম প্রতিবন্ধক।’
গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হচ্ছে জবাবদিহি
দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাস্তবতায় আইনের কঠোর প্রয়োগ সময়ের দাবি উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, সুবিবেচনার সুযোগ এতে নেই বললেই চলে। গণতন্ত্রের অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে জবাবদিহি। সুতরাং রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করে পরিচালনাকাঠামো গড়ে তোলা হলে দুর্নীতি এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।
পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্নীতি
প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান শিক্ষার হারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্নীতিও। এ ত্রুটি শিক্ষার নয়, এ ত্রুটি আমাদের শিখনপ্রক্রিয়ায়, শিক্ষার প্রতি আমাদের মনোভাবের। শিক্ষা যদি হয় কেবল চাকরি পাওয়ার অনুঘটক, তাহলে সেটা শিক্ষা নয়, শিক্ষার নামে প্রহসন।’ তিনি বলেন, ‘দুঃখের বিষয়, আমাদের তরুণসমাজের একটা বিরাট অংশের মধ্যে আমরা এখনো শিক্ষর সঠিক বোধ সঞ্চারিত করতে পারিনি, সততার মুকুট নিয়ে বেঁচে থাকা শেখাতে পারিনি, অল্পে তুষ্ট থেকে সাধারণ জীবনযাপনের মাহাত্ম্য শেখাতে পারিনি।’
আরও পড়ুন: বিচার বিভাগে অনিয়ম-দুর্নীতি হলে গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া জরুরী: প্রধান বিচারপতি
বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ তার প্রবন্ধে বলেন, দুর্নীতি বহুল আলোচিত একটি বিষয়। উন্নত-অনুন্নত, গণতান্ত্রিক-অগণতান্ত্রিক সব সমাজে এটি বিদ্যমান। ক্যানসারের মতো এটি সম্পূর্ণ নিরাময় করা না গেলেও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেদে এর মাত্রা বা পরিধি সীমিত রাখা সম্ভব। দুর্নীতির সঙ্গে রয়েছে ক্ষমতার নিবিড় সম্পর্ক। ক্ষমতাবান ছাড়া কারো পক্ষে বড় ধরনের দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। ‘ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিতে প্ররোচিত করে। আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সর্বগ্রাসী দুর্নীতির জন্ম দেয়’ (লর্ড এস্টন)। দুর্নীতির অর্থ শুধু আর্থিক লেন-দেন নয়, এর সংজ্ঞা বা পরিধি ব্যাপক। যেকোনো অনিয়ম, অসৎ আচরণ, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়াও দুর্নীতি। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতি বলতে তাই বুঝিয়েছেন।
এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, শুধু আবেদন-নিবেদন কিংবা গুলি করে হত্যা করার মতো আইন পাস করেও দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণজাগরণ ও দুর্নীতির উৎসমূলে আঘাত হানা। ১৯৭৫ সালের তার দ্বিতীয় বিপ্লব বা সিস্টেম চেঞ্জ কর্মসূচির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল তাই। শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যক্তিগত সততা দুর্নীতি দমনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে যে পারে না বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তারই প্রমাণ। এজন্য প্রয়োজন আইনের শাসন, কোনো দুর্নীতিবাজকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়া, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, স্বাধীন গণমাধ্যম, শক্তিশালী বিরোধী দল, প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান কাঠামো গঠন ও এদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা। দীর্ঘ ২০ বছর ক্ষমতাসীন থাকায় আওয়ামী লীগের একটি অংশ ও রাষ্ট্র রাজনীতির অন্যান্য শক্তি বলয়ের মধ্যে একটি অলিখিত ‘নেক্সাস’ গড়ে উঠেছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে যা ভাঙ্গা অতি জরুরি।’
আরও পড়ুন: সমাজে শালিস ও বিচারের মাধ্যমে মামলা কমানো সম্ভব: প্রধান বিচারপতি
সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মশিউর রহমান বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র তার জীবনজুড়ে সংগ্রামের যে নির্যাস তা সংবিধানে সমুন্নত করেছিলেন সেটিই ছিল বাংলাদেশ পরিচালনার আদর্শ। আমাদের প্রতিটি সন্তান সংবিধানের চারটি মূলনীতির কাছে ফিরে যেতে পারলে বাংলাদেশ পৃথিবীর ইতিহাসে নেতৃত্বে আসীন হতো এটি আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’
সভায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর আবদুস সালাম হাওলাদার। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল-হোসেনের সঞ্চালনায় সভায় বিচারপতি, আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট এবং সিন্ডিকেট সদস্যবৃন্দ, অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরের বিভাগীয় প্রধান, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।