অভিজিৎ বিশ্বাস: গত ৫ জুন মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ রীট শুনানিতে ১ম ও ২য় শ্রেণীর চাকুরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরিয়ে এনেছে। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনে সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটা সহ সকল কোটা বাতিল করে ১ম ও ২য় শ্রেনীর চাকুরিতে কেবল মেধার ভিক্তিক নিয়োগের আদেশ জারী করে। কিন্ত ৬ বছর পর আদালতের আদেশে কোটাব্যবস্থা ফিরে আসায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবীতে আবার রাজপথে নেমে এসেছে। তাদের আন্দোলনে দেশ স্বভাবত স্থবির হয়ে পড়েছে। যদিও গত বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) আপীল বিভাগ হাইকোর্টের ঐ রায় স্থগিত করে ৪ সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিয়েছে।
এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পূর্বে সরকার ১ম ও ২ য় শ্রেণীর চাকুরিতে কোটা বাতিল করে যে প্রজ্ঞাপন দিয়েছিল পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত তা বহাল থাকছে। কিন্ত সুপ্রীম কোর্টের এমন সিদ্ধান্তের পরও কোটা সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীরা আন্দোলন-ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের বক্তব্য- কোটা সংস্কার বিষয়ক সিদ্ধান্ত তারা আদালত নয়, নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে চায়। চলমান পরিস্থিতিতে স্বভাবতই অনেকের মনে যে প্রশ্নটি আসছে তা হলো- কোটা নির্ধারণ, সংশোধন বা বিদ্যমান কোটা বাতিলের এখতিয়ার কার? আদালত নাকি নির্বাহী কর্তৃপক্ষের?
মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯ অনুসারে কোটা রাখা না রাখা সম্পূর্ণই নির্বাহী কর্তৃপক্ষের বিষয়, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী বিষয়, আদালতের নয়। রাষ্ট্র যদি ১% কোটাও কোনো চাকুরিতে না রাখে, তাহলেও সেটি সংবিধানের লঙ্ঘন নয়। আদালত তা বহাল করতে পারেন না, কারণ সরকারি চাকুরিতে কোটার ভিত্তি হলো- সংবিধানের ২৯(৩)(ক) অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদ কোটা সংরক্ষণে রাষ্ট্রকে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেনি যে, তা অনুসরণ না করলে সংবিধানের লঙ্ঘন হবে এবং আদালত দ্বারা তা বলবৎযোগ্য হবে।
অনুচ্ছেদ ২৯(৩)(ক) পড়ার পূর্বে আমাদের অনুচ্ছেদ ২৯(১) পড়তে হবে, এখানে বলা হয়েছে- প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সুযোগের সমতা থাকবে। কিন্ত অনুচ্ছেদ ২৯(৩)(ক) এ বলা হয়েছে- নাগরিকদের অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, তেমন বিধান করা হতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবেনা।
আরও পড়ুন: পিএসসির প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে রিট
সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্ব্বোচ্চ আইন, সংবিধানে প্রতিটা শব্দের ব্যবহার সুচিন্তিত এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এইযে নিবৃত্ত করিবেনা শব্দের তাৎপর্য হলো এই সংরক্ষণ বা কোটা রাখা রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যকর নয়। রাষ্ট্র যদি রাখে তবে তা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯(১) এর লঙ্ঘন নয়। আবার রাখতেই হবে এমন নয়। অর্থাৎ কোটা রাখা না রাখার এখতিয়ার এই সংবিধানই এককভাবে রাষ্ট্রকে দিয়েছে।
দেশের খ্যাতনামা সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম স্যার তার “Constitutional Law of Bangladesh” বইয়ের ৩য় সংস্করণ এর ২২৯ পৃষ্ঠায় অনুচ্ছেদ ২৯(৩) এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন –
“Special provision in art.29(3) includes reservation as also preference. Such provision can be made not only by law, but also by executive order.
অর্থাৎ স্যার তার বইয়ে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, এই যে সংরক্ষন বা কোটার বিধান তা আইন প্রণয়ন বা নির্বাহী আদেশ দুই ভাবেই করা যেতে পারে। এই বইয়ের ২৩০ নং পৃষ্ঠায় মাহমুদুল ইসলাম স্যার আরো বলেছেন –
Article-29(3) does not, however confer any right on any one nor impose any constitutional obligation on the state to make the preservation.
অর্থাৎ সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ বলে কোন ব্যক্তির ওপর কোনো অধিকার বর্তায় না, না রাষ্ট্রের ওপর সংরক্ষন বা কোটা রাখার বাধ্যবাধকতা তৈরি করে। এটা হতে স্পষ্ট হয় যে, কোটা রাখা না রাখায় সংবিধান রাষ্ট্রকে কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করেনি আবার করলে করা হতে বিরত ও করেনি।
সংবিধানের অভিভাবক ও বাস্তবায়ক হিসাবে মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট ন্যায়বিচারের স্বার্থে কোনো বিষয়ে তখনি হস্তক্ষেপ করতে পারে যেখানে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নাই বা এই সংবিধান কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করার পরও রাষ্ট্র তা লঙ্ঘন করেছে। এটাই অনুসৃত বিধান যে, যেখানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে সেখানে আদালত হস্তক্ষেপ করবেন না।
এই সংবিধানের অভিভাবক হিসাবে সুপ্রীম কোর্ট আরেকটি ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারে, ধরুন সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বলে রাষ্ট্র একটি গোষ্ঠীর জন্য কোটা রাখলো কিন্ত বস্তত তারা অনগ্রসরগোষ্ঠীর নয়। তখন সংক্ষুদ্ধ যে কেউই সেটা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রীট দায়ের করতে পারে যে অনগ্রসরগোষ্ঠীর না হয়েও তাদের জন্য কোটা সংরক্ষণ কেনো সংবিধান বিরোধী হবেনা? এই গ্রাউন্ডস বা যুক্তিতে কিন্ত যে কেউ মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা অনগ্রসর শ্রেণীভুক্ত কিনা এবং কোটা পেতে পারে কিনা সেটাও উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
আরও পড়ুন: হাইকোর্টের রায় প্রকাশ: সরকার চাইলে কোটা সংস্কার করতে পারবে
মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের ত্যাগ ও আত্বোৎসর্গের মাধ্যমে এই রাষ্ট্র পেয়েছি। আমরা যে রাজনৈতিক মতাদর্শেরই হইনা কেনো, তাদের অবদান স্বীকার করতে হবে। রাষ্ট্রের তাই অবশ্য দায়িত্ব তাদের যথাযোগ্য সম্মান এবং বাকি জীবনটা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যময় হয় তার জন্য আনুসঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্র মাসিক ভাতা, বাড়ি, ফ্রি পরিবহন ও সরকারি হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা, উৎসব ভাতাসহ নানাবিধ সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। যা নিয়ে জনআপত্তি নেই। কারণ,তারা এটি প্রাপ্য।
অনেক মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধকালে শহীদ হয়েছে, যুদ্ধাহত হয়েছে ফলে তার পরিবার সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এ বিবেচনায় তাদের সন্তানদেরও যতো রকম সুযোগ-সুবিধা দিক, এটা নিয়েও কিন্তু সেভাবে কোন আপত্তি নেই। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সরকারি চাকুরিতে যে কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছিল তাও কিন্তু তাদের অনগ্রসরগোষ্ঠী বিবেচনায়।
আন্দোলনকারীদের প্রশ্ন হলো- দেশ স্বাধীন হবার ৫৩ বছর পর তাদের নাতি-নাতনিরা কোন বিবেচনায় অনগ্রসর শ্রেণীভূক্ত হয়? কেউ কেউ অনগ্রসর শ্রেণীর হতেই পারে, কিন্তু ঢালাওভাবে সকলেই কি অনগ্রসর শ্রেণীভুক্ত? মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছে তার সুবাদে তারা এবং তাদের সন্তানরা রাষ্ট্রের সুবিধাভোগ করতে পারে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা দেশের অন্য পাঁচ জন নাগরিক থেকে কি এমন রাষ্ট্র গঠনে বিশেষ অবদান রাখছে যে, তাদের সন্তানেরা অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা সরকারি চাকুরিতে ৩০% সংরক্ষণ বা কোটা পেতে পারে? তাদের এ দাবী অবশ্যই বিবেচনার দাবী রাখে।
আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের জন্য আদালতের দরজা খোলা: প্রধান বিচারপতি
এই দাবী কি আসলেই মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগকে, তাদের অবদানকে অস্বীকার করে? আমাদের স্মরণ করতে হবে বীরমুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিল, জীবন উৎসর্গ করেছিল পাকিস্তানি বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে একটি শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মানে,তাদের নিজের জন্য এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মব্যাপী বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির আশায় নয়।
সংবিধান, যাকে বলা হয় প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন সেখানে অনগ্রসর শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব রক্ষায় কোটা সংরক্ষনের কথা বলেছে। এখন সাধারণ জিজ্ঞাসা কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষ এরা কি অনগ্রসর শ্রেণী নয়? রাষ্ট্র প্রতিবন্ধী, নৃগোষ্ঠী এদের অনগ্রসর গোষ্ঠী বিবেচনা করছে সেটাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্ত কৃষক-শ্রমিক, ভূমিহীন মানুষ তাদের সন্তানের জন্য কি কোনো কোটা রেখেছে? পরিতাপের বিষয় হলো, রাষ্ট্র তাদের সন্তানের জন্য কোটা সংরক্ষণ না করে সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকুরিজীবিদের সন্তানদের জন্য পোষ্য কোটার ব্যবস্থা করেছে!
অনগ্রসর কৃষক-শ্রমিকের সন্তানের কোটার পরিবর্তে একজন চাকুরিজীবির সন্তানের জন্য যখন রাষ্ট্র পোষ্যকোটা সংরক্ষণ করে তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে রাষ্ট্র কি তবে কৃষকের সন্তান কৃষক হবে এবং চাকুরিজীবিদের সন্তান চাকুরিজীবী হবে এই নীতি লালন করে কিনা? পরোক্ষে সেটা বাস্তবায়ন করে কিনা? আজ যে সকল শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবীতে আন্দোলন করছে এরা কিন্ত ২০১৮ সালেও কোটা বাতিল চায়নি, সংস্কার চেয়েছিল এখনো তাদের দাবী যৌক্তিক সংস্কার।
একটা গণতান্ত্রিক এবং জনকল্যানমুখী রাষ্ট্রে পিছিয়ে পড়া অনগ্রসরগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে কোটা সংরক্ষন অবশ্যই থাকা উচিৎ। কিন্ত সেটা হোক বাস্তবসম্মত, জনসংখ্যানুপাতিক এবং মেধার যথাযথ মূল্যায়নের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা। যেহেতু আমাদের সংবিধান স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রকে অনগ্রসরগোষ্ঠীর জন্য কোটা প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছে, যার প্রণয়ন ক্ষমতা থাকে তার বাতিল, সংশোধন, প্রতিস্থাপন ক্ষমতাও থাকে। তাই সরকারের উচিৎ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আদালত না দেখিয়ে দ্রুত নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারী করে উদ্ভূত সমস্যার নিরসণ করা, এতেই দেশ ও জাতি সকলেরই কল্যাণ নিহিত।
লেখক: অ্যাডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট।