মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব: জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র ও দেশের প্রথম সংবিধানে উল্লেখিত এ তিনটি বিষয়কে ভিত্তি করে ১৯৭২ সালে সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি ঘোষনা করা হয়।
সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুসারে, রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা। যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছে সে ন্যায় কি আদৌ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি আমরা? শুধু চাকুরির ক্ষেত্রে নয় অন্যান্য ক্ষেত্রে কি সমতার বিধান রয়েছে?
সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে। কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হবেন না বা বৈষম্য করা যাবে না। তবে নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সে উদ্দেশ্যে তাঁদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করতে পারবে রাষ্ট্র।
এ অনুচ্ছেদ অনুসারে চাকুরির জন্য অনগ্রসর মানুষের জন্য বিশেষ বিধান করার ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রের। সরকারকে কোটা রাখতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই এ অনুচ্ছেদ অনুসারে। সরকার চাইলে অনুগ্রসর মানুষদের জন্য কোটা রাখতে পারে আবার নাও পারে।
অনগ্রসর অংশ বলতে কি বোঝায় এটা বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করবে। উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে, দেশের কোথাও একটা বড় রকম দূর্যোগ ঘটলো। সেখানকার মানুষজন দীর্ঘ সময় ধরে এ দুর্যোগের প্রভাব বয়ে বেড়ালো। তাঁরা রাষ্ট্রের অনান্য মানুষদের থেকে পিছয়ে পড়লেন। রাষ্ট্র চাইলে তাদরে জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারেন।
আরও পড়ুন: কোটা সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া, জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়ণই ভরসা
১৯৭২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর “ইন্টেরিম রিক্রুটমেন্ট রুলস”- এর আওতায় তৎকালীন সরকারের একটি নির্বাহী আদেশে প্রথম শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ মেধা এবং বাকি ৮০ শতাংশ জেলা কোটা প্রবর্তিত হয়। এ ৮০ শতাংশ জেলা কোটার মধ্য থেকেই ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধা এবং ১০ শতাংশ কোটা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। উল্লেখ্য যে, রুলটির নামই ছিল “ইন্টেরিম রিক্রুটমেন্ট রুলস”; অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে এ নিয়ম চালু করা হয়েছিল।
১৯৭৬ সালে মোট কোটার ৪০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে ও ১৯৮৫ সালে উপ-জাতীদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা প্রবর্তিত হয়। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ১৯৯৭ সালে। ২০০২ সালে সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত ৩০% কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে উক্ত কোটার শূন্যপদগুলো মেধাভিত্তিক পূরণ করার সিধান্ত নেয় সরকার। তবে ২০০৮ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য নির্ধারিত কোটা পূরণ করা সম্ভব না হলে পদ খালি রাখার নিয়ম করা হয়। ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদেরও ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সবশেষ ২০১২ সালে এক শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
বর্তমান সময়ে গোটা দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা কোটার সংস্কার নিয়ে আন্দোলন জারি রেখেছে মূলত সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্যই। যেহেতু সংখ্যার দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটার পরিমাণ বেশি ফলে এ নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে বেশি। আন্দোলনকারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কোন রকম বিদ্বেষ প্রকাশ করেনি। তাদের দাবি কোটা পদ্ধতির সংস্কার। যৌক্তিকহারে কোটা রাখতে কারো কোন দ্বিমত নেই। ২০১৮ সালেও আন্দোলনের বিষয়বস্তুই ছিল কোটা পদ্ধতির সংস্কার।
আরও পড়ুন: কোটা নিয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও দেশের বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধা বা তাঁদের পরিবার অনগ্রসর থাকবে এটা জাতীর জন্য দুঃখজনক। আরও দুঃখজনক যে দেশে মুক্তিযোদ্ধারের প্রকৃত তালিকা তৈরী করতে ব্যর্থ হয়েছে এদেশ। এমন ঘটনাও আমরা দেখেছি যে দেশে স্বাধীনতার বয়সের থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স কম হয়েছে। এটা থেকেই স্পস্ট যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অথবা তাঁদের পরিবার কতটা সম্মানীত। জাতীর বীর সন্তানদের জন্য স্বর্ণের মেডেল কেলেঙ্কারি প্রমাণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমারদের আচরণ কেমন। মুক্তিযোদ্ধাগণকে নানা ভাবেই সম্মানীত করা যায়, এমনকি চাকুরিতে কোটাও থাকতে পারে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বা তাঁদের সন্তানদের জন্য যৌক্তিকহারে কোটা রাখা যেতে পারে।
সংবিধানের রক্ষাকারক হিসেবে সুপ্রীম কোর্ট জনগণের সর্বোত্তম উপকার বিবেচনায় নিয়ে চলমান এ বিষয় নিয়ে রায় প্রদান করবেন বলেই আমরা আশা করি। কেননা নানা সংকটে এখন পর্যন্ত একমাত্র সুপ্রীম কোর্টই ন্যায় বিচারের প্রতীক হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
লেখক: মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব, এডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা এবং আইনজীবী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি।