১.
বিচারিক কাজের গতিশীলতা এবং বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সকল পর্যায়ের বিচারকদের জন্য গাড়ির প্রাধিকার ও গাড়িসেবা নগদায়ন সুবিধা প্রাপ্তি জরুরী প্রয়োজন হয়ে দাড়িয়েছে। পাবলিক পরিবহনে মামলার বাদী ও বিবাদীর সাথে পাশাপাশি সিটে বসে যাতায়াত, মাদকসহ অন্যান্য মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামীর রিক্সায় বা গাড়িতে উঠে পড়া এখন বিচারকদের জীবনে নিয়মিত কাকতালীয় ঘটনা, যা বিচারকদের নিরাপত্তায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া এসমস্ত কাকতালীয় ঘটনার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে বিচারক নির্দোষ হওয়া স্বত্বেও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ ওঠার সম্ভাবনা একেবারে অমূলক নয়। অধিকন্তু পাবলিক পরিবহনে যাতায়াতের কারণে বিচারকগণ অল্প সময়ে কর্মস্থলের পাবলিক পরিবহনের চালক ও কর্মচারীদের সাথে এবং নিয়মিত যাতায়াতকারী সাধারণ যাত্রীদের সাথে পরিচিত হয়ে যাওয়ায় অপ্রত্যাশিত ও অস্বস্তিকর তদ্বিরের সম্মুখীন হতে হয়। নিঃসন্দেহে নিরাপত্তাহীনতা এবং অস্বস্তিকর তদ্বির বিচারকের বিচারিক মনমানসিকতায় গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
২.
দেওয়ানী মামলার মেরিটে বাস্তব দখল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা দালিলিক ও মৌখিক সাক্ষ্য দ্বারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুধাবন সম্ভব নয়। তাছাড়া বিবদমান বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ঘটনাস্থল পরিদর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দি কোড অব সিভিল প্রসিডিউর ১৯০৮ এর ১৮ আদেশের ১৮ নিয়ম মতে দেওয়ানী আদালতের বিচারকদের মামলার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সুযোগ থাকলেও গাড়ি না থাকায় এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিচারিক কার্যক্রম কখনোই গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।
৩.
সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিচারক কর্তৃক সাক্ষ্যের যথাযথ মূল্যায়ণ ন্যায়বিচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৮৯৮ এর ৫৩৯(বি) ধারা মতে ফৌজদারি মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারকের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাক্ষ্যের মূল্যায়ণ করার ক্ষমতা থাকলেও তা গাড়ি সুবিধা না থাকায় সম্ভব হয় না।
৪.
জুডিসিয়াল ইনকোয়ারি বিচার ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও গাড়ি সুবিধা না থাকায় এর পরিসর ক্রমশ ছোটো হয়ে এসেছে। গাড়ি না থাকায় ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থল পরিদর্শন, ঘটনাস্থলে গিয়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ, ঘটনাস্থলের পারিপার্শিক অবস্থা অনুধাবন এবং বস্তুগত সাক্ষ্য সংগ্রহের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করতে পারছেন না যা অনুসন্ধানের মান ও নির্ভরযোগ্যতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
৫.
পরিবেশ আদালত আইন ২০১০ এর ১২(১১) ধারা মোতাবেক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৮৯৮ এর ২৬০ ধারা মতে সামারি ট্রায়াল, বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতসহ অন্যান্য আইনে ঘটনাস্থলে গিয়ে সামারি ট্রায়ালের ব্যবস্থা থাকলেও গাড়ি সুবিধা না থাকায় ম্যাজিস্ট্রেটগণ তাদের বিচারিক দায়িত্বের পুরোটা পালন করতে সক্ষম হন না।
৬.
পরিবেশ আদালত পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন ও বিধিমালার মাধ্যমে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার একটি বিস্তৃত অংশ দখল করে আছে। পরিবেশ আদালত আইন ২০১০ এর ১৭ ধারা মোতাবেক নালিশী সম্পত্তি, বস্তু ও ঘটনার স্থান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পরিবেশ আদালতের ঘটনাস্থল পরিদর্শনের ক্ষমতা থাকলেও গাড়ি সুবিধা না থাকায় সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না।
৭.
সহকারী জজ বা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট থেকে জেলা ও দায়রা জজ পর্যন্ত সকল বিচারকের কাজের প্রকৃতি একই ধরণের। একটি ফৌজদারি মামলায় সাজা দিলে আসামীর মনে যে ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, একটি গুরুত্বপূর্ন জমিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে, ভায়োলেশন মিস মামলায়, জারী মামলায়, পারিবারিক মামলায় সাজা দিলে বা রায় বিপক্ষে গেলে বিবাদীর মনেও একই ধরণের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। একজন বিচারক তার বিচারিক কাজে অবিরতভাবে যে পরিমান নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন বা পুরো বিচারক গোষ্ঠীই যে পরিমান নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, সে পরিমান নিরাপত্তাহীনতা সামষ্টিকভাবে আর কোনো কোনো সার্ভিসেই নেই। যাতায়াত ও পরিবহণের পর্যাপ্ত নিরাপদ সুবিধার ব্যবস্থা বিচারকদের জন্য কখনোই নিশ্চিত করা হয়নি।
৮.
জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও চৌকি আদালতের বিচারকের জন্য কোনো গাড়ি সুবিধাই নেই। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারকে সংশ্লিষ্ট জেলার উপজেলা কমিটি, চৌকি আদালতের বিশেষ কমিটি এবং ইউনিয়ন কমিটির সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধন করতে হয়, মাঠ পর্যায়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে কাজ করতে হয় অথচ তার যাতায়াতের জন্য কোনো গাড়ি সুবিধা নেই। এছাড়া আইনগত সহায়তা প্রদান (আইনী পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধিমালা ২০১৫ এর ৫ বিধি অনুযায়ী লিগ্যাল এইড অফিসার সুবিধাজনক স্থানে তথা ঘটনাস্থলে মীমাংসা সভা বা উঠোন বৈঠক করার ক্ষমতাবান হলেও গাড়ি সুবিধা না থাকায় তা আলোর মুখ দেখছে না।
৯.
প্রত্যেক সিনিয়র সহকারী জজ এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত সহকারী জজ তার আঞ্চলিক এখতিয়ারের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রক। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ এর ১৬ ধারা অনুযায়ী বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের নালিশী বাড়িতে প্রবেশ ও পরিদর্শন করার ক্ষমতা থাকলেও গাড়ির অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না।
১০.
দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৮৯৮ এর ২৫ ধারা মতে দায়রা জজ, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটগণ তাদের স্ব স্ব আঞ্চলিক এখতিয়ারে জাস্টিস অব দি পিস। সেমতে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে তাদের আঞ্চলিক এখতিয়ারের যেকোনো স্থানে গমনের প্রয়োজনে “অফ রোড” গাড়ি প্রয়োজন। এছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি মহোদয়দের প্রটোকল প্রদান করার। এজন্য সকল দায়রা জজ, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের অফ রোড জীপগাড়ি সরবরাহ করা প্রয়োজন।
১১.
স্বশস্ত্র বাহিনী, বিসিএস প্রশাসন, বিসিএস ইকনমিক, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং স্বায়ত্বশাসিত ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড (ওজোপাডিকো) ইতোমধ্যে সুদমুক্ত ঋন ও গাড়িসেবা নগদায়ন সুবিধা পেলেও বিচারকরা এই সুবিধা থেকে এখনো বঞ্চিত। বিচারকদের নিরাপত্তা ও বিচারিক কাজের ধরণ বিবেচনায় সকল বিচারকের জন্য সুদমুক্ত ঋন এবং গাড়িসেবা নগদায়ন সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
১২.
ক্রিমিনাল রুলস এন্ড অর্ডার্স ২০০৯ এ সন্নিবেশিত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্য অনুসরণীয় নীতিমালার ৮ নং নীতিমালায় বলা হয়েছে, “তাকে (বিচারককে) অন্যান্য সাধারণ ব্যক্তি হতে স্বতন্ত্রভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে সচেষ্ট হওয়া উচিত”। তাছাড়া সামগ্রিকভাবে ৮ নং নীতিমালা প্রতিপালনে প্রত্যেক বিচারকের স্বতন্ত্ব পরিবহণ একান্ত প্রয়োজন।
উপর্যুক্ত পর্যালোচনায় এটা সুষ্পষ্ট যে বিচারকদের নিরাপত্তা, কাজের প্রকৃতি, নির্ভরযোগ্য ইনকোয়ারি, ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সাক্ষ্যের সঠিক মুল্যায়ন, মোবাইল কোর্ট ও সামারি ট্রায়াল পরিচালনাসহ সর্বপরি দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার দিতে ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সকল পর্যায়ের বিচারকদের জন্য গাড়ির সুবিধা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন।
লেখক: ইফতি হাসান ইমরান; সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মুন্সীগঞ্জ।