এম. তাওহিদ হোসেন: মানবাধিকার হলো মানুষের জীবন, অধিকার, সমতা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সুযোগ সুবিধা। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার, এ অধিকার কেউ কখনো কারো কাছে থেকে কেড়ে নিতে পারে না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ অনুযায়ী “মানবাধিকার অর্থ- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত কোন ব্যক্তির জীবন, অধিকার, সমতা ও মর্যাদা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আদালত দ্বারা বলবৎযোগ্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলে ঘোষিত মানবাধিকার।”
মানবাধিকারের সংজ্ঞাকে আরো একটু সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলা যায় মানবাধিকার হলো সেই সকল অধিকারের সমষ্টি যা একজন মানুষের সার্বিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক কথায় রাষ্ট্র কর্তৃক সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকার গুলোই মানবাধিকার, কেননা পৃথিবীর সকল দেশের মৌলিক অধিকারই মানবাধিকার থেকে নেওয়া৷
বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের পিছনে কতকগুলো নিয়ামক অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে যা আজীবন ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইউনিভার্সাল ডিক্লেয়ারেশন অব হিউম্যান রাইটস বা বিশ্ব মানবাধিকারের ঘোষণার পিছনে সর্বপ্রথম যেটি বড় নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে সেটি হচ্ছে, সাইরাস সিলিন্ডার।৫৩৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারস্যের রাজা দ্বিতীয় সাইরাস ব্যাবিলন আক্রমণ করে সেখানকার নির্যাতিত জনগোষ্ঠী ও দাস-দাসীদের মুক্ত করে দেন এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাধীনতা প্রদান করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রথম মানবাধিকার সনদ হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত মানবাধিকারের চূড়ান্ত রূপরেখা প্রণয়নে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে মদিনা সনদ। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত মদিনা সনদকে মানবাধিকারের প্রধান ভিত্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়। পৃথিবীর প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও ৪৭টি অনুচ্ছেদবিশিষ্ট সর্বপ্রথম লিখিত এই সংবিধানে নবগঠিত বহু ধর্মীয় রাষ্ট্রে সবার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, সব নাগরিকের নিরাপত্তা রক্ষা, রক্তপাত, হত্যা ও ধর্ষণ রোধে আইন প্রণয়ন এবং পুরো সম্প্রদায়কে দোষারোপ না করে শুধু অপরাধীকে সাব্যস্ত করে গোত্রীয় কলহ থেকে মুক্তির উপযুক্ত পদ্ধতি যুক্ত করা মদিনা সনদের মূলকথা হিসেবে আর মদিনা সনদের উল্লেখযোগ্য এসব বৈশিষ্ট্য বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ক্ষেত্রে বড় নিয়ামক হিসাবে ভূমিকা পালন করেছে।
এছাড়াও ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জন কর্তৃক ব্যারনদের সাথে ম্যাগনাকার্টা চুক্তি, ১০ ডিসেম্বরকে মানবাধিকার দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
১৭৬০ সালের পর শিল্পবিপ্লবোত্তর পরিবর্তনশীল বিশ্বে বৈষম্য, অধিকারহরণ, জান মালের নিরাপত্তাহীনতা, অপশাসন এবং একশ্রেণির সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব পুরো পৃথিবীর মানুষকে দুটি বলয়ে বিভক্ত করে যার ফলে ১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলা এ যুদ্ধের ধ্বংসলীলা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯২০ সালে গঠিত হয় লীগ অব নেশনস।
কিন্তু আধিপত্যবাদী, স্বৈরাচারী বৈষম্যমূলক মনোভাবের কারণে ১৯৩৯ সালে বিশ্বের ইতিহাসে দ্বিতীয় বার সংঘটিত হয় আরো একটি বিশ্বযুদ্ধ এবং এ যুদ্ধের ভয়াবহতা এতোই বেশি যে পুরো বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে যায় এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা তখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে ফলশ্রুতিতে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর গঠিত হয় জাতিসংঘ। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বরকে বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণা করে এবং ১৯৫০ সাল থেকে ১০ ডিসেম্বরকে মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে প্রতি বছর মানবাধিকার দিবস পালন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকারের চর্চা আজ পর্যন্ত বিশ্ব দরবারে জুতসই ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জন্মগতভাবে সমান মর্যাদা লাভ, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার, দাসত্বহীন জীবন লাভের অধিকার , আইনের সমতার অধিকার, আত্মসম্মানবোধ রক্ষার অধিকার, চলাচল ও বসবাসের স্বাধীনতা, জাতীয়তার অধিকার, সম্পত্তি লাভের অধিকার, মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নাগরিকের জন্য প্রদানকৃত সব কিছুতে সমানভাবে অংশগ্রহণের অধিকার, ভোট প্রদানের স্বাধীনতা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির স্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকারগুলোর (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা) কথা উল্লেখ থাকলেও এসবের কিছুই প্রকৃত অর্থে বিশ্বে বাস্তবায়ন হয়নি।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের ধারণা ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। লাগামহীন অসম পুঁজিবাদের দৌরাত্ম, দূর্বল গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ, স্বেচ্ছাচারী রাজনৈতিক মনোভাব, ফ্যাসিবাদের উত্থান , কুক্ষিগত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বিচারবর্হিভূত হত্যা এবং সর্বোপরি আইনের শাসন এবং সুশাসনের চরম অভাব বর্তমানে বিশ্ব মানবাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বর্তমানে মানবাধিকার চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। ইসরায়েলী আধিপত্যবাদ বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতিকে চরম বিতর্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলায় গত বছর থেকে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১ লক্ষ ৪৪ হাজার ৫০ জন মানুষ নিহত হয়েছে যাদের মধ্যে সিংহভাগ শিশু, মহিলা, সংবাদমাধ্যম ও স্বাস্থ্যকর্মী। ইসরায়েলের হামলা থেকে রেহাই পায়নি খোদ জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যকর্মীরা।
ইসরায়েলী বাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিনের বেসামরিক মানুষদের হত্যার বাইরেও বর্তমানে বৈশ্বিক মানবাধিকার চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধ, ট্রাম্প সরকারের ভবিষ্যৎ অভিবাসন নীতি, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রকাশ্য পরীক্ষা, চিনে উইঘুর মুসলমানদের উপর নির্যাতন, ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রকাশ্যে ধর্ম চর্চায় বাঁধা ও নির্যাতন, মিয়ানমারের জান্তা সরকার কর্তৃক সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর নির্যাতন ও জবরদস্তিমূলক ভাবে অভিবাসীকরণ মানবাধিকার পরিস্থিতিকে ক্রমশই অস্থিতিশীল করছে।
বৈশ্বিক মানবাধিকার থেকে চোখ ফিরিয়ে যদি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকে তাকাই তাহলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে দৃশ্যমান হবে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে রাষ্ট্রীয় সরকার কর্তৃক ছাত্র-জনতার উপর নির্যাতন স্মরণকালের ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো একটি ঘটনা। জুলাই আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পড়ে তৎকালীন আওয়ামী সরকার অবৈধভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে প্রায় ২০০০ হাজারের কাছাকাছি মানুষকে হত্যা করেছে এবং লক্ষাধিক মানুষ শরীরে নির্মম নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছে।
এছাড়া ভারতের সীমানারক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক বিচারবহির্ভূতভাবে সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা মানবাধিকারের সংজ্ঞাকেই কলঙ্কিত করেছে। দেশের বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে ও নির্যাতনে অন্তত ৬০৭ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া দেশের আরেক প্রখ্যাত মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , ২০০৯ থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বিএসএফ সদস্যদের হাতে অন্তত ৫৮২ বাংলাদেশি নিহত এবং ৭৬১ জন আহত হয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত হত্যা ছাড়াও মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাড়তি চাপ এদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করে তুলেছে।
বর্তমানে বিশ্বে মানবাধিকারের এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে পৃথিবীতে মনুষ্য জাতির বেঁচে থাকা দায় হয়ে যাবে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল
দেশগুলোর সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। মানবাধিকারের সংজ্ঞায় প্রত্যেক মানুষ যে জন্মগতভাবে স্বাধীন ও সমমর্যাদার অধিকারী সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে তাই বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে-
প্রথম, জাতিসংঘ সনদের বর্তমান বিধানের সংস্কার করতে হবে।
দ্বিতীয়, নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ মোড়ল রাষ্ট্রের ভেটো পাওয়ারের বিধান বাতিল করতে হবে।
তৃতীয়, মানবাধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করার বন্দোবস্ত করতে হবে।
চতুর্থ, মানবাধিকার সংক্রান্ত কনভেনশন ও চুক্তিগুলোতে অংশগ্রহণকারী ও স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলোকে বৈশ্বিক মানবাধিকার সুরক্ষায় আন্তরিক হতে হবে।
পঞ্চম, প্রত্যেক দেশের চলমান সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর স্বচ্ছ রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
ষষ্ঠ, গণতন্ত্রকে সীমিত না করে মুক্ত গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে।
সপ্তম,পুঁজিবাদ যেন লাগামহীন না হয় এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
অষ্টম, বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড এবং ঘুম রাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করতে হবে।
নবম, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
দশম, ধর্ম, বর্ণ,ভৌগোলিক, জাতিগত পার্থক্যের কারণে রাষ্ট্রের নাগরিকদের আলাদা করে দেখা যাবে না।
একাদশ, স্ব স্ব দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে।
এবং সর্বোপরি প্রত্যেক দেশের সংবিধানে সংরক্ষিত মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা রাষ্ট্র কর্তৃক দৃঢ়ভাবে দিতে হবে কেননা মানবাধিকার মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোন বিষয় নয়।
আইনের শাসন, সু-শাসন, স্নেহ, মায়া, মমতায় ভরে উঠুক পুরো পৃথিবী, অক্ষুণ্ণ থাকুক মানবাধিকারের মান, সমাপ্ত হোক মানবাধিকার নামক অসমাপ্ত উপন্যাসের।
লেখক- আইনের শিক্ষার্থী ও শিক্ষানবিশ আইনজীবী