সংস্কার আসুক আদালতের নাম ও বিচারকের পদবি ব্যবহারের প্রচলিত  রীতিতে
মতিউর রহমান; জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট

সংস্কারের প্রাক্কালে ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সাক্ষীদের সুরক্ষা ও খরচা বিষয়ে পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা এবং করণীয়

মতিউর রহমান: আমাদের দেশে বিচার ব্যবস্থা বিশেষ করে ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যথাযথ ব্যবস্থা বা বিধান না থাকায় ন্যায়বিচার ব্যহত হয়। আসামীরা ভিকটিম ও সাক্ষীদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি ও লোভ দেখিয়ে প্রভাবিত করে। এমনকি সিভিল মামলাতেও নিরপেক্ষ পাবলিক সাক্ষী আদালতে উপস্থিত হতে চায় না কারণ স্বার্থ জড়িত অপর পক্ষ বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। তাছাড়া, জেলা পর্যায়ে আদালত হওয়ায় একটি কর্মদিবস নষ্ট করে নিজস্ব খরচে স্বাক্ষিরা সাক্ষ্য প্রদানের নিমিত্ত আদালতে উপস্থিত হতে চায় না।

সরকারি সাক্ষীরা চাকুরীতে থাকা অবস্থায় টি এ/ডি এ প্রাপ্ত হলেও অবসরে যাওয়ার পরে কোন খরচা প্রাপ্ত হয় না। তাই এই সাক্ষীরা সাক্ষ্য প্রদানে আদালতে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেন না। ভিকটিম একটি মামলায় অন্যতম সাক্ষী, তাছাড়াও একটি মামলায় অনেক নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী থাকে। বিচার চলাকালীন সময়ে এই সাক্ষীদের নিরাপত্তাজনিত কারণে স্বাক্ষী অনুপস্থিত থাকে বা সাক্ষী বৈরী হয়ে যায়। কোনো মামলা নিষ্পত্তির অন্যতম মূল উপকরণ হচ্ছে সাক্ষ্য। তাই তো ইংরেজ দার্শনিক ও আইনতত্ত্ববিদ জেরেমি বেন্থাম বলেছেন- ‘উইটনেসেস আর দ্য আইজ অ্যান্ড ইয়ারস অব জাস্টিস’।

সাক্ষীর সহযোগিতা এবং সত্যনিষ্ঠ সাক্ষ্য ছাড়া ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করা দিবাস্বপ্নের মতো। বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার আমাদের দেশে খুবই কম। যার কারণ হচ্ছে এ দেশে বেশির ভাগ মামলারই সম্পূর্ণরুপে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় না। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে মামলায় সাক্ষীর অনুপস্থিতি বা স্বাক্ষিরা প্রভাবিত হয়ে বৈরী হয়ে যাওয়া। আইনে তাদের জন্য কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় ও খরচা প্রদানের ব্যবস্থা না থাকায় তারা আদালতে সাক্ষ্য দেয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে বা বৈরী হয়।

অনেক সময় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলেও সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা যায় না। আমাদের সাক্ষ্য আইন, ১৯৭২-এর ধারা ১৫১ এবং ১৫২-এর মতো কিছু বিধান রয়েছে, কিন্তু এগুলো কেবল আদালতের ভিতরে সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য প্রযোজ্য। একটি নির্দিষ্ট আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অনুপস্থিতিতে, সাক্ষীদের সুরক্ষা এখনো অধরাই রয়ে গেছে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৪ ধারায় সাক্ষীর খরচের বিষয়ে বলা আছে। এই ধারায় সাক্ষীর ও বাদীর খরচা প্রদানের জন্য আদালতকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এই ধারার অধীনে সরকারকে বিধি প্রণয়নের নির্দেশনা দেয়া হলেও অদ্যবধি তা হয় নি। ১৯৮২ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে সাক্ষীদের যাতায়াত ও খাবার বাবদ একটি খরচা নির্ধারণ করেন। যদিও তা নুন্যতম তাও বর্তমানে প্রদান করা হয় না।

ইতোপূর্বে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কোডে সাক্ষীর খরচ বাবদ সরকার বরাদ্দ প্রদান করতো এবং সাক্ষীদের তা দেয়া হতো। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক বিষয়ে কোন কার্যক্রম না থাকায় সাক্ষীদের খরচা প্রদান বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে এমন কোন অর্থনৈতিক (কোড) সচল না থাকায় তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।

ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে সরকারি সাক্ষীদের যাতায়াত ভাড়াসহ প্রয়োজনীয় খরচ দিতে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত ৩১/১/২৩ তারিখে নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। নির্দেশনায় ফৌজদারি মামলায় সরকারি সাক্ষীদের সাক্ষ্য ভাতা প্রদানের নিমিত্ত নতুন অর্থনৈতিক কোড/ খাত সৃজন এবং এই খাতে অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। তবে, সাধারণ পাবলিক সাক্ষীদের খরচা বিষয়ে অদ্যবধি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নি।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশেই সাক্ষীর সুরক্ষায় আইন রয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের মূল দিক হচ্ছে ভিকটিম ও সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নে উৎসাহ প্রদান। এই উদ্দেশ্যে ২০০৮ সালে UNDOC সাক্ষ্য সুরক্ষা আইনের Model witness protection Bill প্রস্তুত করেন। ভারত ২০১৮ সালে witness protection Scheme গ্রহণ করেন। ভারতের উত্তরখণ্ড প্রদেশ ২০২০ সালে সাক্ষী নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেন। পাকিস্তান ২০১৫ সালে সাক্ষী নিরাপত্তা আইন করেন।

ভারতের ২০১৮ সালের সাক্ষী নিরাপত্তা স্কিমের আওতায় জেলা ও দায়রা জজের সভাপতিত্বে একটি স্থানীয় সাক্ষী নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। সাক্ষীদের নিরাপত্তায় ও খরচা বহনে ফান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই ফান্ড হতে সাক্ষীদের ভাতা প্রদান করা হয়। বিচার বিভাগ সংস্কারের এই সময়ে বাংলাদেশেও সাক্ষীদের নিরাপত্তা ও খরচা প্রদানের নিমিত্ত ব্যবস্থা গ্রহণ সমীচীন। এই উদ্দেশ্যে ভারত ও পাকিস্তানের আলোকে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে;

১। ভিকটিম, সাক্ষীর এবং তাদের পরিবারের সদস্য, সম্পত্তির সুরক্ষার নিমিত্ত আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। তাছাড়া, সাক্ষীদের যাতায়াত ও খাবার বাবদ খরচা (সাক্ষী ভাতা) প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

২। প্রতিটি জেলায় একটি সাক্ষী সুরক্ষা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। উক্ত কমিটিতে সভাপতি হবেন জেলা ও দায়রা জজ/মহানগর দায়রা জজ, সদস্য হিসেবে থাকবেন চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার/পুলিশ কমিশনার ও পি. পি.।

৩। ভিকটিমের ক্ষতিপূরণ,সাক্ষীদের সুরক্ষা ও সাক্ষীদের খরচা বাবদ অর্থ পরিশোধ করার জন্য প্রতিটি জেলায় সাক্ষী সুরক্ষা কমিটির অধীনে একটি ফান্ড গঠন করতে হবে। এই ফান্ডে সরকার নির্ধারিত কোডে বাজেট প্রদান করবেন। তাছাড়া, আদালত কর্তৃক আসামীকে জরিমানা বাবদ অর্থ এই ফান্ডে জমা দেয়ার নির্দেশ প্রদান করার বিধান করা যেতে পারে।  তাহলে জরিমানা হতে এই ফান্ডে অর্থ সংগ্রহ হবে। অধিকন্তু, স্থানীয় ভাবে এই ফান্ডে ডোনেশন সংগ্রহের বিধান রাখা যেতে পারে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি ফান্ড হতে এই ফান্ডে অর্থ গ্রহণের বিধান রাখা যেতে পারে। উল্লেখ্য যে ভারতে গৃহীত স্কিমে এইভাবে অর্থ সংগ্রহের বিধান আছে।

৪। সাক্ষীদের খরচা প্রদানের নিমিত্ত সরকার কর্তৃক দূরত্বের ভিত্তিতে খরচা হার নির্ধারন করে দিতে হবে। সাক্ষীর ঠিকানা হতে আদালতের দূরত্ব হিসেবে খরচা হিসাব করা যেতে পারে। সাক্ষীগণ আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করে সার্টিফিকেট নিয়ে  সাক্ষী সুরক্ষা কমিটির নির্ধারিত ডেস্কে জমা দিয়ে খরচার বাবদ অর্থ সংগ্রহ করবেন। এমনকি এই ফান্ড হতে ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

৫। সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে পুলিশের একটি সাক্ষী প্রটেকশন সেল গঠন করা যেতে পারে। নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হলে সাক্ষী বা তার আত্মীয় পক্ষে উক্ত সেলে বা সংশ্লিষ্ট আদালতে আবেদন করতে পারবেন। উক্ত আবেদন প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট সেল স্ব-উদ্যোগে বা আদালত কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে তদন্ত করবেন। জরুরি মর্মে প্রতীয়মান হলে সংশ্লিষ্ট সেল তাৎক্ষনিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন। সংশ্লিষ্ট সেল ৭ দিনের মধ্যে নিরাপত্তা হুমকি পর্যালোচনা করে Threat Analysis Report সংশ্লিষ্ট আদালতে দাখিল করবে। হুমকির মাত্রা বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট আদালত নিরাপত্তা জনিত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবেন। সাক্ষী ও ভিকটিমের নিরাপত্তা নিশ্চিতের নিমিত্ত সাক্ষী প্রটেকশন সেল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সাক্ষী ও ভিকটিমের নিরাপত্তায় সকল আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি বেসরকারি দপ্তর ও ব্যক্তি সহযোগিতা করতে বাধ্য থাকবে মর্মে বিধান করা যেতে পারে। নিরাপত্তার জন্য গৃহীত ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট আদালতকে  মনিটর করার ক্ষমতা অর্পন করা যেতে পারে।

৬। সাক্ষী সুরক্ষা সেল প্রতিমাসের কার্যক্রমের একটি রিপোর্ট পর্যালোচনার নিমিত্ত সাক্ষী সুরক্ষা কমিটির নিকট উপস্থাপন করবেন। সাক্ষী সুরক্ষা কমিটি প্রতিমাসে ১ বার মিটিং করে নিরাপত্তা জনিত গৃহীত পদক্ষেপ পর্যালোচনা করবে, ব্যয় অনুমোদন করবে ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দিক নির্দেশনা প্রদান করবে।

৭। ভিকটিম/সাক্ষীর প্রতি কেউ হুমকি প্রদর্শন বা অধিকার ভোগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা যেতে পারে।

৮। ভিকটিম ও সাক্ষী সুরক্ষার একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয় হতে হবে যথা সম্ভব দ্রুত  অপরাধের তদন্ত এবং বিচার কাজ নিষ্পন্ন করা। দ্রুত ও সুষ্ঠু বিচার অনুষ্ঠান সুরক্ষার জন্য সহায়ক এবং এতে সুরক্ষাকালীন সময়ের মেয়াদও কমে আসবে। তাই কোন মামলায় নিরাপত্তা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দরকার হলে ব্যবস্থা গ্রহণ অন্তে সেই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

সাক্ষী ও ভিকটিমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে  ও সাক্ষীদের খরচা প্রদানের ব্যবস্থা থাকলে , সাক্ষীগণ আদালতে সাক্ষ্য প্রদানে উৎসাহ পাবেন। সাক্ষীগণ সাক্ষ্য প্রদান করলে প্রকৃত অপরাধীরা বিচারের আওতায় আসবে ও মামলা দ্রুত সুষ্ঠু নিষ্পত্তি হবে, ফলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখক: মতিউর রহমান; জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বাগেরহাট।