সংবিধান সংস্কার কমিশনের বৈধতা কতটুকু
জিয়াবুল আলম

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাতকড়ার অপব্যবহার করছে

জিয়াবুল আলম: বেশ কিছু দিন ধরে লক্ষ্য করলাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাতকড়ার অপব্যবহার করছে। এর ফলে রাষ্ট্রের নাগরিকের মৌলিক ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। অথচ আমাদের আইন বিজ্ঞানের ভাষায় ফৌজদারি মামলার মূলনীতি হচ্ছে Doctrine of innocent. অর্থাৎ একজন আসামি ততক্ষণ পর্যন্ত নির্দোষ যতক্ষণ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায়ে অভিযোগ প্রমাণ না হবে।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেকোন ব্যক্তিকে এমনকি জামিনযোগ্য ছোট অপরাধের মামলায়ও গ্রেফতার করা হলে আসামির কোমরে রশি এবং হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালত হাজির করানো হচ্ছে। শুধু এখানে শেষ নয়। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারকৃত আসামির সাথেও এসব অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। যা আমাদের সংবিধানের বর্ণিত মৌলিক মানবাধিকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট বলা আছে, আটক কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবেনা কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেওয়া যাবেনা কিংবা কাহারো সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাবেনা। যাহা জাতিসংঘের মৌলিক মানবাধিকার অংশ।

অথচ রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিন দিন আইনের কোন বিধি-বিধান তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রের নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন করছে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের কোন মানবাধিকার কর্মী এসব ব্যাপারে কোন কথা বলছেনা। ফলে পুলিশ একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ঠুনকা অভিযোগে ধৃত করলেও আসামি কোমরে রশি এবং হাতকড়া পড়িয়া জনসম্মুখে হাজির করা হচ্ছে।

এর ফলে আমাদের ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। যা আমাদের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের সামিল। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বারবার পুলিশ প্রবিধানের দোহাই দিয়ে আসামীর সাথে এসব অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ করছে। অথচ পুলিশ প্রবিধানের বিধি ৩৩০ অনুসারে পুলিশ কখন একজন আসামিকে হাতকড়া পরাতে পারে এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট বলা আছে।

পুলিশ প্রবিধানের বিধি ৩৩০ এর মধ্যে কি আছে জানার জন্য সামান্য সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করছি। আমাদের পিআরপি ১৯৪৩ সালের বিধি ৩৩০ অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট বা কারাগারে স্থানান্তরিত করার জন্য পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃতরা তদন্ত, এবং বিচারের অধীনে থাকা বন্দীদেরও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন না তাদের পলায়ন রোধ করতে।

হাতকড়া বা দড়ি ব্যবহার প্রায়শই একটি অপ্রয়োজনীয় এবং ক্রোধ মূলক কাজ। কোনও অবস্থাতেই, মহিলাদেরকে হাতকড়া দেওয়া হবে না; বা যারা বয়সের দ্বারা বা অক্ষমতা, অসুস্থতা জনিত কারণে সহজে এবং নিরাপদে হেফাজতে রাখা হয়।

এছাড়া ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৭১ ধারায় গ্রেপ্তারকৃত সাক্ষীকে কোনও অবস্থাতেই হাতকড়া দেওয়া হবে না।

আপত্তিজনক মামলার ক্ষেত্রে, বন্দীদের হাতকড়া পরানো উচিত নয় যদি না সে আক্রমণাত্মক না হয় এবং থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার এর আদেশ অথবা এই পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার কারণ বি. পি. ফর্ম নং ৫৭ এ সাধারণ ডায়েরি করার কারণ থাকে।

অ-জামিনযোগ্য ক্ষেত্রে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার পরিমাণ বিবেচনায় রেখে হাত কড়া পরাতে হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে হাতকড়া ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে না বলে মনে করলেও হাত কড়া পড়াতে হবে না।

পালানোর সম্ভাবনা আছে উদাহরণস্বরূপ, বন্দী কোনও অপরাধের জন্য হেফাজতে থাকাকালে একজন শক্তিশালী মানুষ, সহিংসতা বা কুখ্যাত পূর্বসূরি বা যদি যাত্রা দীর্ঘ হয়, বা বন্দীদের সংখ্যা বড়, হাতকড়া পরাতে হয় যা যথাযথভাবে ব্যবহার করা উচিত শুধু পালানো রোধ করতে।

অবাক করার বিষয় হচ্ছে পিআরবির বিধি ৩৩০ এর মধ্যে হাতকড়া ও দড়ির ব্যাপারে সব সময় নিরুৎসাহিত করেছে। কিন্ত বাস্তব দেখা যাচ্ছে পুলিশ হাতকড়া পরানোর ক্ষেত্রে পিআরবির বিপরীতে নিরুৎসাহিত চেয়ে দিনদিন উৎসাহ উদ্দীপনা বেড়ে চলছে। যারা খুবই দুঃখজনক।

তারা বরাবর যুক্তি দেখাচ্ছে পিআরবির ৩৩০ অনুয়ায়ী পালানোর সম্ভাবনা রোধ করার জন্য এই আসামীকে হাতকড়া পড়ানো হচ্ছে। আমার কথা হচ্ছে একজন আসামিকে আদালতের হাজির করার সময় আগে পিছনে বামে ডানে পুলিশ থাকে। এর পরেও কেন পালানোর সম্ভাবনা থাকবে? অনেক সময় দেখা যাচ্ছে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিকেও আদালতে হাতকড়া পরিয়ে হাজির করানো হচ্ছে। যা আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।

এই ব্যাপারে ২০১৮ সালে মে মাসে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে হাতকড়া পরানোর পর জারি করা স্বতঃপ্রণোদিত রুলের শুনানি শেষে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের বেঞ্চ আটককৃত ব্যাক্তিদেরকে হাতকড়া অপব্যাবহার না করার নির্দেশ দেওয়ার শর্তেও পুলিশ এসব বিধিনিষেধ তোয়াক্কা না করে পিআরবির অজুহাত দেখিয়ে একজন অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে হাতকড়া পড়িয়ে পশুর মত আচরণ করছে।

তাছাড়াও In Sunil Batra Etc. v. Delhi Administration and Ors. Etc., [1979] 1 SCR 392 এই মামলায় আদালত বলেছেন,

under-trials shall be deemed to be in custody, but not undergoing punitive imprisonment. Fetters, especially bar fetters, shall be shunned as violative of human dignity, within and without prisons. The indiscriminate resort to handcuffs, when accused persons are taken to and from court and the expedient of forcing irons on prison inmates are illegal and shall be stopped forthwith save in small category of cases where an under-trial has a credible tendency for violence and escape a humanely graduated degree of “iron” restraint is permissible if – other disciplinary alternatives are unworkable. The burden of proof of the ground is on the custodian. And if he fails, he will be liable in law. Reckless handcuffing and chaining in public degrades, puts to shame finer sensibilities and is a slur on our culture.

মামলায় সুস্পষ্ট ভাবে বলা আছে একজন আসামিকে হাত পড়ানোর ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতির কথা। কিন্তু কথা হচ্ছে কাজীর গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নেই। অর্থাৎ আইনের বিধান আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক অধিকার ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আমাদের বিট্রিশ আমলের প্রণীত পিআরবি সংশোধন আনায়ন করে একটা নীতিমালা করা দরকার যে, পুলিশ কোন মামলায়, কাকে, কখন হাতকড়া পড়াতে পারবেন। এতে করে আইনের শাসনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের নাগরিকের সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত হবে।

লেখক: আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও চট্টগ্রাম জজ কোর্ট