নির্বাচনের নিরাপত্তা
বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান

হারানো বিশ্বাস ও আস্থা ফেরানো নির্বাচন কমিশনের বড় চ্যালেঞ্জ

বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান: সার্বজনীন নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দেশে সরকার পরিচালনায় জনমতের প্রতিফলন হওয়ার কারণে নির্বাচনকে পবিত্র রূপে বিবেচনা করা হয়। যে প্রতিষ্ঠান এই নির্বাচন পরিচালনা করে সেই প্রতিষ্ঠানটিও জনগণের দৃষ্টিতে একটি পবিত্র প্রতিষ্ঠান রূপে স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলাদেশে এই পবিত্র প্রতিষ্ঠানটির সাংবিধানিক নাম “নির্বাচন কমিশন”।

সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যেভাবে বর্ণিত আছে- সেটি হচ্ছে

প্রধান নির্বচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন।

নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের বিধান সম্বলিত আইনটি ২০২২ সালে প্রবর্তিত হলেও ইতোপূর্বে ২০১৪ সালে অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। “প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন ২০২২” (২০২২ সালের ১ নং আইন) নামের এই আইনটিতে সুপ্রীম কোর্টের আপীলেট ডিভিশনের একজন বিচারপতির সভাপতিত্বে একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের দুটি করে প্রস্তাবিত নাম রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরিত হলে প্রতিটি পদের জন্য দুটি করে নামের বিপরীতে রাষ্ট্রপতি নিজ ইচ্ছায় একজনকে মনোনীত করলে তাদের দিয়ে এই নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে।

২০১৪ এর নির্বাচনের আগে আপীল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং ২০১৮ নির্বাচনের আগে আপীল বিভাগের আরেকজন বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দরের সভাপতিত্বতে গঠিত সার্চ কমিটি যে দুজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের মনোনীত করেছিলেন তাদের কর্মকান্ডে দেশবাসী হতাশ হয়েছিল। তৎকালীন শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক নির্বাচনকে কলুষিত করে প্রতিটি নির্বাচনের ফলাফল নিজ পক্ষে নেয়ার নিকৃষ্ট কর্মকান্ডকে ঐ দুটি নির্বাচন কমিশনের প্রকাশ্য সহায়তা প্রদানের ইতিহাস জাতি কখনো ভুলবেনা।

প্রকৃতপক্ষে জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা এই নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠানটিকে শক্তিশালী করে। জনগণের বিশ্বাস ও আস্থার ভিত্তিতে ম্যান্ডেট লাভ করে নির্বাচন কমিশন দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। জনগন একবাক্যে তাদের সিদ্ধান্তের সঠিকতাকে বিশ্বাস করে থাকে এবং সেই অনুযায়ী নির্বাচনের ফলাফল মান্য করে চলে। এই কারণেই এই প্রতিস্টানটি পবিত্র প্রতিষ্ঠান রূপে বিবেচিত হয়।

নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে বলেই ভোটের দিনটি দেশবাসীর কাছে একটি আনন্দময় দিন হয়ে ওঠে। ভোট প্রদানে যোগ্যতা সম্পন্ন দেশের সকল জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট প্রদান করে। কোনরূপ বাধ্যবাধকতা কিংবা আহ্বান ব্যতীতই সাধারণতঃ ৬৫%-৭০% শতাংশ ভোটার ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভোট দেয়ার মতো তাদের পবিত্র দায়িত্ব পালন করে থাকে।

কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশে নির্বচনের এই পবিত্র দৃশ্য অদৃশ্য হয়ে গেছে। নির্বাচন এখন একটি ভীতিকর অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ভোটের আগের রাতে প্রতিপক্ষের সকল কর্মীকে গণহারে গ্রেফতার করা এবং আদালতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় তাদের জেলখানায় আটক রাখা, গণহারে ফৌজদারী মামলা দায়ের করে সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য করে তোলা, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে ভোটের ফলাফল নিজপক্ষে নেয়া, প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা, দিনের ভোট রাতে সম্পন্ন করা, ভোটকেন্দ্রে এলে ‘কল্লা’ ফেলে দেয়া, ব্যালট পেপারের নিজেরাই সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা ইত্যাকার নানা অনিয়ম ও বেআইনী কর্মকান্ডের মাধ্যমে সমগ্র নির্বাচন ব্যবস্থাটাই কলুষিত করে তুললে জনগণ নির্বাচন ব্যবস্থাদির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরে।

বিশেষ করে এই অনিয়ম ও বেআইনী কর্মকান্ড জনগণের চোখের সামনে দৃশ্যমান থাকলেও দিন শেষে নির্বাচন কমিশন এই অনিয়ম ও বেআইনী নির্বাচনকে স্বীকৃতি দিয়ে “একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দেয়ায় জনগণকে ধন্যবাদ জানালে” জনগণ নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পিত বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে ফেলে।

ফলশ্রুতিতে আমরা দেখি সরকারে অধিস্ঠিত রাজনৈতিক দলের ৫% কর্মীদের ভোট কেন্দ্রে উপস্থিতিকে ৩০%-৩৫% রূপে প্রচার করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যখোন বিবৃতি দেন- তখন জনগণ এমনকি নিজের ওপরই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। নিজ চক্ষে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থতির হার কি দেখলেন আর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মুখের বক্তব্যে এই হারের কথা কি শুনলেন এই দুটির সমীকরণ মেলাতে না পেরে সমগ্র নির্বাচন ব্যবস্থাদির ওপর সংক্ষুদ্ধতায় নিজের মাথার চুল নিজে ছিড়ে ফেলার ইচ্ছা সংবরণ করেন।

এই সকল বাস্তব কারণে নির্বাচন কমিশনের ওপর নাগরিকের যে বিশ্বাস ও আস্থা চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল শেখ হাসিনা মুক্ত বাংলাদেশে সেই বিশ্বাস ও আস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন সর্ব গুরুত্বের চ্যালেঞ্জ। আশার কথা একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে উল্লেখিত আইনে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে যে সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে সে সার্চ কমিটির মাধ্যমে সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ হয়েছে।

এবার নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনারদের অগ্রাধিকার ভিত্তিক কাজ কি হবে সেটা একটু পর্যালোচনা করা যাক। খেয়াল রাখতে হবে এই নতুন নির্বাচন কমিশনকে এ কথাটি মাথায় রাখতে হবে যে নাগরিকদের মানসিকতায় নির্বাচন কমিশনের স্থান এখন শূন্যের কোটায় দাঁড়িয়ে আছে। সেটিকে তাদের কাজ ও কথার মাধ্যমে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুন নির্বাচন কমিশনের অগ্রাধিভিত্তিক সম্ভাব্য কার্য তালিকা নিম্নরূপ হতে পারে।

নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিষ্কলুষ করতে নির্বাচন কমিশনকে নিম্নরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে-

(১) নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা ফেরাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
(২) নির্বাচন ব্যবস্থাদির প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
(৩) নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে কয়েকটি নির্বাচন আইনে সংশোধন করানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
(৪) নির্বাচন অনিয়ম প্রতিরোধ করতে অধঃস্তন জুডিসিয়ারির মাধ্যমে গঠিতব্য “নির্বাচন তদন্ত কমিটিকে” শক্তিশালী করতে হবে।
(৫) নির্বাচন দিবসের নিরাপত্তায় আইন শৃন্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষ ভুমিকা গ্রহনে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে।
(৬) “আমার ভোট আমি দেব, যাকে ইচ্ছা তাকে দেব” স্লোগানকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
(৭) নির্বাচনে আস্থার সাথে অংশ গ্রহণের গ্যারান্টি স্বরূপ প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্রকে নিরাপদ করতে হবে।
(৮) নির্বাচন ব্যবস্থার স্বচ্ছতায় তরুণ প্রজন্মের বিশ্বাস উৎপাদনে অংশগ্রহণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
(৯) নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন করার জন্য ঘরে ঘরে অনুসন্ধান চালাতে হবে।
(১০) আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসগুলোকে পুনর্বিন্যাস করে এতে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে।
(১১) নির্বাচন প্রশিক্ষণ একাডেমিতে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাংবাৎসরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাতে হবে।
(১২) ভোট প্রদান কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে সার্ভিলেন্স ব্যবস্থা প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
(১৩) ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধানে ও পর্যবেক্ষণে অধিক সংখ্যক কর্মকর্তাকে ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
(১৪) ভোট কেন্দ্রের অনিয়ম অবাধ হয়ে গেলে অবিলম্বে কেন্দ্রটি বাতিল করতে হবে।
(১৫) নির্বাচন পূর্ব অনিয়ম কঠিন হস্তে দমন করতে হবে।

সর্বোপরি নির্বাচনের এই পবিত্র দায়িত্ব পালনের যথার্থতার জন্য কোন অনিয়মের সাথেই আপোষ করা যাবেনা।

দেশের ধ্বংসপ্রাপ্ত নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্বমহিমায় এর পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার কোন বিকল্প নেই। নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি দেশবাসীর হারিয়ে যাওয়া আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে না পারলে ২৪ এর শহীদদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। সে কারণে জাতি হিসাবে আমরা আর কখনো বিশ্ব সভায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।