মোকাররামুছ সাকলান:
বিচার বিভাগ একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোয় আইন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অভিভাবক এবং আইনগত বিরোধের চূড়ান্ত বিচারক হিসেবে সর্বোচ্চ গুরুত্বের অধিকারী। বাংলাদেশে এই মূহুর্তে একটি সংস্কার কার্যক্রম চলছে এই প্রেক্ষাপটে, সুপ্রিম কোর্টে তরুণ বিচারকদের নিয়োগের ধারণাটি বিশেষভাবে বিবেচ্য হতে পারে, কারণ এটি বিচার বিভাগের দক্ষতা, আধুনিকীকরণ এবং অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বর্তমান বিচারক নিয়োগের ধারা
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি, সাধারণত বার বা বিচার বিভাগের সিনিয়র সদস্যদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এই ধারা মূলত এই ধারণা থেকে উদ্ভূত যে দীর্ঘ কর্মজীবন মানেই গভীর আইনগত জ্ঞান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রজ্ঞা। তবে এই প্রচলিত পদ্ধতি হয়তো তরুণ, উদ্যমী বিচারকদের অনন্য অবদানের সম্ভাবনাগুলোকে উপেক্ষা করছে।
তরুণ বিচারকদের প্রয়োজনীয়তা:
তাজা দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক চিন্তাধারা
তরুণ বিচারকরা বিচার বিভাগে নতুন ধারণা এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসতে পারেন। আধুনিক আইনি শিক্ষা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং বৈশ্বিক আইন চর্চার সঙ্গে তাদের পরিচিতি একটি অগ্রসরমুখী বিচার বিভাগ গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে, যা দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম।
প্রযুক্তিগত অভিযোজন ক্ষমতা
বিচার বিভাগ এখন ক্রমবর্ধমানভাবে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল, যেমন কেস ব্যবস্থাপনা, ভার্চুয়াল শুনানি এবং কার্যকরী আদালত পরিচালনার জন্য। তরুণ বিচারকরা প্রযুক্তির সঙ্গে বেশি মানিয়ে নিতে পারেন এবং একটি ডিজিটাল বিচার বিভাগে রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করতে সক্ষম। সরকার ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের নানা উদ্যোগের ফলে গত কয়েকবছর ধরে নিম্ন আদালতে মামলাজট বৃদ্ধির হার কমেছে। একটু পরিসংখ্যান দেখলেই দেখা যায় যে উচ্চ আদালতের চেয়ে নিম্মআদালতে মামলার নিষ্পত্তির হার আগের যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। এর মূল কারন হিসাবে ঘেটে দেখলে দেখা যাবে যে অধস্থন আদালতের অপেক্ষাকৃত তরুন বিচারকদের মামলার নিষ্পপ্তির হার অনেক বেশি। এক্ষেত্রে তরুন বিচারকদের প্রযুক্তিগত অভিযোজন ক্ষমতা অনেক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বিগত বছর গুলো যারা চীফ জাস্টিস এওয়ার্ড পেয়েছেন তাদের অনেকেই তরুন বিচারক।
স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা
তরুণ বিচারকদের নিয়োগ দীর্ঘমেয়াদী সেবা নিশ্চিত করে, যা বিচার বিভাগের স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। তাদের দীর্ঘ উপস্থিতি ধীরে ধীরে বিচারশাস্ত্রের বিকাশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতিকে শক্তিশালী করতে পারে। তরুন বিচারকরা সঠিক প্রশিক্ষন পেলে বর্তমান বিচারক নিয়োগের যে ধারা রয়েছে মেধার দিক থেকে তরুনদের নিয়োগের ধারা আরো কার্যকরী করে তোলা সম্ভব বলে মনে করি।
মামলা জট কমানো ও দক্ষতা বৃদ্ধি
বাংলাদেশের বিচার বিভাগ মামলার বড় ধরনের জটের মুখোমুখি। তরুণ বিচারকরা তাদের উদ্যম এবং শক্তি দিয়ে এই জট দ্রুত কমাতে ভূমিকা রাখতে পারেন। তাদের তুলনামূলকভাবে কম পেশাগত ইতিহাস তাদের তাজা এবং পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মামলা পরিচালনা করতে সহায়ক করতে পারে।
বৈচিত্র্য ও প্রতিনিধিত্ব
তরুণ বিচারকদের নিয়োগ বিচার বিভাগকে আরও বৈচিত্র্যময় করতে পারে, যা সমাজের প্রতিফলন ঘটায়। এই অন্তর্ভুক্তি জনগণের বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা বাড়াতে পারে, কারণ তারা দেখতে পায় যে তাদের মূল্যবোধ এবং আকাঙ্ক্ষা বিচার ব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ এবং উদ্বেগ
তরুণ বিচারকদের নিয়োগের সুবিধাগুলি স্পষ্ট হলেও, এই নীতির কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা প্রয়োজন। অধস্থন আদালত হতে তরুন বিচারক নিয়োগে একটি প্রছন্ন বাধা দেখা যায়। যেমন বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫(২)(খ) অনুযায়ী বিচারবিভাগীয় কাজে ১০ বছর অভিজ্ঞতা হলে একজন অধস্থন আদালতের বিচারক উচ্চ আদালতের বিচারক হিসাবে নিয়োগ পেতে পারেন। কিন্ত অধস্তন আদালতের একজন বিচারকের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের বিচারক হবার স্বপ্নে বাধ সাধে তাদের সার্ভিস রুলস। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস বিধিমালা, ২০০৭ এর তফশিল পর্যবেক্ষন করলে দেখা যায় যে, একজন অতিরিক্ত জেলা জজ হতে গেলে তাঁকে ১০ বছরের সার্ভিস হতে হয়। সেক্ষেত্রে একজন তরুন অতিরিক্ত জেলা জজ যতই দক্ষ হোক না কেনো তাঁকে আজ অবধি সরাসরি উচ্চ আদালতে বিচারক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় না। কারন হয়তো মনে করা হয় তিনি জেলা জজ হন নাই। এদিকে একজন অতিরিক্ত জেলা জজ থেকে জেলা জজ হতে গেলে তাঁকে ১৫ বছরের সার্ভিস হতে হয়। বিগত বছর গুলো থেকে অধস্তন আদালতের বিচারক হতে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলা জজ ছাড়া অন্য কোন অতিরিক্ত বা যুগ্মজেলা জজ যাদের বিচারবিভাগীয় চাকুরীর বয়স ১০ হয়েছে তাদের হতে নিয়োগ দেওয়া হয় নাই। এক্ষেত্রে হয়তো যে মনস্তত্ব কাজ করে তা হলো জেলা জজ না হলে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি হওয়া যায় না।
অন্যদিকে হাইকোর্ট এ যেসব তরুন আইনজীবীর ১০ বছরের আইনপেশার অভিজ্ঞতা আছে তারা উচ্চ আদালতের বিচারক হবার যোগ্যতা অর্জন করলেও তাদের বিচারক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় না। ইদানিং দেখা যায় যে, ২২ বছর বয়সেই একজন তরুন এল.এল.বি পাশ করে ফেলছে বা লন্ডন হতে বার-এট-ল সম্পন্ন করে ফেলছে। সেক্ষেত্রে প্রায় ২৬ বছরের মাঝে সে উচ্চ আদালতে প্রাক্টিস পারমিশন পেয়ে যায়। ফলে ৩৬ বা ৩৭ বছর বয়সে তার ১০ বছর প্রাক্টিস হয়ে গেলেও বিগত বছরগুলোতে ৪৫ বছরের নিচে কাউকে উচ্চ আদালতের বিচারক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে যাদের বয়স ৫০ তাদেরকে বিবেচনার করার হার বেশি।
অভিজ্ঞতা বনাম উদ্দীপনা
সমালোচকরা বলেন, তরুণ বিচারকদের জটিল সাংবিধানিক এবং আইনগত বিষয়গুলি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার অভাব থাকতে পারে। এই উদ্বেগ বিচারকদের বয়স নির্বিশেষে অসাধারণ আইনগত দক্ষতা চিহ্নিত করার জন্য একটি শক্তিশালী নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তাকে নির্দেশ করে।
পেশাগত প্রাপ্তবয়স্কতা
বিচারিক সিদ্ধান্ত প্রায়ই আইনগত দক্ষতা, প্রজ্ঞা এবং সামাজিক গতিশীলতার ব্যবহারিক বোঝাপড়ার একটি মিশ্রণ প্রয়োজন। তরুণ বিচারকদের কেবলমাত্র প্রযুক্তিগত জ্ঞানই নয়, বরং সংবেদনশীল এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মামলা পরিচালনার জন্য পরিপক্কতা প্রদর্শন করতে হবে।
প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ
অভিজ্ঞতার যে কোনো শূন্যতা পূরণ করার জন্য একটি ব্যাপক প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ প্রদান কর্মসূচি প্রয়োজন। সিনিয়র বিচারক এবং আইন বিশেষজ্ঞরা তরুণ বিচারকদের দিকনির্দেশনা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন, যা তাদের সুপ্রিম কোর্টের জটিলতাগুলি পরিচালনার জন্য ভালভাবে প্রস্তুত করবে।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত
বিভিন্ন দেশ তাদের সর্বোচ্চ আদালতে তরুণ বিচারকদের সফলভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্টে তরুণ বিচারপতিদের নিয়োগ একটি সাধারণ প্রথা, যা বিচারিক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে বজায় রাখতে সাহায্য করে। একইভাবে, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলিতে, মেধাভিত্তিক নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রায়ই অসাধারণ সম্ভাবনাময় তরুণ বিচারকদের অন্তর্ভুক্তির পথ তৈরি করে।
নীতিগত সুপারিশ
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে তরুণ বিচারকদের নিয়োগ সহজতর করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি সুপারিশ করা হয়:
নিয়োগের মানদণ্ড সংস্কার
বর্তমান নির্বাচন প্রক্রিয়াটি শুধুমাত্র চাকরির বছরের উপর নির্ভর না করে মেধা, সম্ভাবনা এবং অভিযোজনযোগ্যতাকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। অধস্তন আদালতের যুগ্মজেলা জজ হতে শুরু করে সুপ্রীম কোর্টের মেধাবী তরুন আইনজীবীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে মনস্তাতিক বাধা দূর করতে হবে। এক্ষেত্রে যোগ্যতা এবং যোগ্যতাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। যোগ্যদের খুঁজে বের করতে হবে।
একটি বিচারিক একাডেমি প্রতিষ্ঠা
একটি বিশেষায়িত একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে যা তরুণ বিচারকদের প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ প্রদান করবে, তাদের সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্বের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং জ্ঞান দিয়ে সজ্জিত করবে।
একটি ভারসাম্যপূর্ণ বেঞ্চ তৈরি করা
বেঞ্চের গঠন অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্যের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিফলিত করা উচিত, যাতে বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অবদান রাখতে পারে।
স্বচ্ছতা বাড়ানো
নিয়োগ প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া উচিত, যা জনগণের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং অখণ্ডতার প্রতি আস্থা জাগিয়ে তুলবে।
শেষ কথা:
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে তরুণ বিচারকদের নিয়োগ শুধুমাত্র বয়সের প্রশ্ন নয়, বরং এটি দৃষ্টি এবং আধুনিকীকরণের বিষয়। তারুণ্য এবং উদ্ভাবনকে গ্রহণ করে, বিচার বিভাগ নিজেকে এমন একটি গতিশীল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে পারে যা সমাজের পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম। চ্যালেঞ্জগুলি বিদ্যমান, তবে তা চিন্তাশীল পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে অতিক্রম করা সম্ভব। শেষ পর্যন্ত, অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্যের একটি বিচক্ষণ মিশ্রণ বিচার বিভাগকে বৃহত্তর দক্ষতা, অন্তর্ভুক্তি এবং উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অধস্তন আদালতের যুগ্মজেলা জজ হতে শুরু করে সুপ্রীম কোর্টের মেধাবী তরুন আইনজীবীদের নিয়োগের পথ প্রশস্থ করতে হবে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।