সংবিধান সংস্কার এর প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিক বাস্তবতা

মোবাইল কোর্ট, সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রসঙ্গ

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম: বাংলাদেশের ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম ২০০৯ সাল থেকে চলমান রয়েছে। তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্থাৎ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসী ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হওয়ার পরে মোবাইল কোর্ট কাদের মাধ্যমে পরিচালিত হবে বা হওয়া উচিত বা পার্শ্ববর্তী দেশ গুলোর মোবাইল কোর্ট কারা পরিচালনা করছে এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে আইনাঙ্গনে। এমনকি মোবাইল কোর্ট আইনী কাঠামোতে সাংবিধানিক প্রশ্নে ঠিকঠাক চলছে কিনা সে বিষয়টি চড়ান্ত নিস্পত্তির জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।

যাই হোক বিচারাধীন বিষয় নিয়ে বক্তব্য চলবে না। আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। তবে সচেতন নাগরিক হিসেবে মোবাইল কোর্ট নিয়ে সাধারণ জনগণ কি ভাবছে বা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পরে বিপ্লবী ছাত্র জনতার চাওয়া কি? আইন ও বিচার বিভাগ সংস্কার নিয়ে ছাত্র জনতা কি কি সংস্কার চাই সেসব গুরুত্বপূর্ণ টপিক নিয়ে দুয়েকটা কথা বলা যেতেই পারে।

মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ অনুযায়ী মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে নির্বাহী বা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে। এটা সাংবিধানিক ভাবে সঠিক নয় মর্মে তিনটা রীট পিটিশন নিষ্পত্তি করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল বেশ আগে। এখন সরকার আপিল করায় তা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। এখন ছাত্র জনতা মনে করেন বিচার বিভাগের কাজ বিচারক তথা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে পরিচালিত হওয়া উচিত। তাই উচ্চ আদালতে মোবাইল কোর্ট নিয়ে পেন্ডিং থাকা পিটিশনের দ্রুত নিষ্পত্তি চাই। বিচার সংশ্লিষ্টরাও তেমনটা চায়। তবে এক্সিকিউটিভ হাকিম দিয়ে পরিচালিত মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম নিয়ে কিছু কথা বলে রাখা ভালো তাহলে লেখাটি প্রাসঙ্গিক হবে।

বাংলাদেশেরর সর্বোচ্চ আদালত তিনটি রিট পিটিশন নিষ্পত্তি করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা সংক্রান্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা বৈধ নয় বিধায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পরিচালিত বিচারিক কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা করে। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’ নীতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনটি বিভাগ; আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ একটি সমন্বিত কাঠামোর মধ্যে থাকা উচিত। একটি বিভাগ অন্য বিভাগের উপর কর্তৃত্ব পরায়ণ না হয়ে জুলাই বিপ্লবে ছাত্র জনতার মতের উপর প্রাধান্য দিবে এটাই সংবিধানের মৌলিক চেতনা।

দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের নিউজে (১৯ জুলাই ২০২০) দেখলাম মিডফোর্ডে র‌্যাবের অভিযানে ২০ লাখ টাকার নকল ওষুধ জব্দ, ফার্মেসি সিলগালা করা হয়েছে। শুধু এটি নয়, সারা বছরই এরকম সুখবর এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানার বিচারের খবর প্রায়ই দেখে থাকি। এই খবরে অনেকে বাহবা দিবে যে কি সুন্দর ও ত্বরিত বিচার। কিন্তু এই ধরনের শর্টকার্ট বিচার দীর্ঘ মেয়াদে কি ফল বয়ে আনবে তা ভাবতে হবে। লেখাটিতে আইনগত আলোচনা হবে। লেখাটি নিয়ে শুধু একাডেমিক আলোচনা করব। দয়া করে কেউ পক্ষে-বিপক্ষে গিয়ে নিজের মতো করে দেখবেন না।

ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম মতে বিচার হচ্ছে দৃশ্যমানভাবে দুই পদ্ধতিতে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে অপরটি নিয়মিত বিচারিক আদালতে বা ট্রাইব্যুনালে। উভয় আদালতের বিচারে জনগণের সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি রয়েছে। যেমন- ভ্রাম্যমাণ আদালতে বৃদ্ধকে কান ধরিয়ে ওঠবস করার ছবি ভাইরাল হয়ে যাওয়া, আইনজীবীকে ব্যক্তিগত ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাজা দেওয়া, একসাথে ১২৩ শিশুকে এখতিয়ার বহির্ভূত সাজা দেওয়া ইত্যাদি নানা ধরনের বিচার জনগণকে ইতিমধ্যে মোবাইল কোর্ট উপহার দিয়েছে।

তবে মোবাইল কোর্টের যে কিছু সফলতা নেই তা বলবো না। ধরুন, ইভটিজিং ও বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে বেশ সক্রিয় ভূমিকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। যাহোক সমালোচনা ও আলোচনার মাঝেই চলছে সুপারসনিক মোবাইল কোর্ট ও তার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ। (শিশুর অবৈধ সাজার মাননীয় হাইকোর্টের রায়ে সুপারসনিক বায়োনিক ম্যান শব্দটি এসেছে)। হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায় : ভ্রাম্যমাণ আদালতে শিশুদের সাজা দেওয়া অবৈধ। (সূত্র দৈনিক সময়ের আলো ১২ মার্চ ২০২০)

যে সাজাটি মিডফোর্ডে ওষুধের দোকানে বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়েছেন সেখানে কিছু প্রাসঙ্গিক ও আইনী বিশ্লেষণ দেওয়া উচিত বলে মনে করি। পুরান ঢাকার মিটফোর্ডে নকল, ভেজাল ও অননুমোদিত ওষুধ বিক্রি ও মজুদ করায় পাঁচটি ফার্মেসির মালিককে ০৭ লাখ টাকা জরিমানা করেছে র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভেজাল ওষুধ শুনলেই গা শিহরিত হয়। কী ভয়ঙ্কর ও মারাত্মক অপরাধ আর শাস্তি, শুধু টাকা জারমানা অনাদায়ে ২-৩ মাসের জেল। কি বিচিত্র!

এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা কীভাবে চলছে সেটি। উদাহরণত, নকল, ভেজাল ও অননুমোদিত ওষুধ বিক্রি ও মজুদ করার জন্য ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খুব সুন্দর করে ওইরুপ অপরাধের বিবরণ এবং অপরাধ সংঘটন করলে শাস্তি কি তা বলা হয়েছে। স্পষ্টতই ভেজাল ওষুধ, ইনসুলিন ও মেয়াদোত্তীর্ণ বেচাকেনা বা মজুদ করে অপরাধী মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করলেন।

তা সত্ত্বেও ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কিছু টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দিলেন এবং দোকান সিলগালা করে দিলেন। এই বিচারে কি অপরাধীর উপযুক্ত বিচার হলো। অবশ্যই না। যেখানে নকল, ভেজাল ও অননুমোদিত ওষুধ বিক্রি ও মজুদ করার জন্য থানায় বা নিয়মিত আদালতে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করার সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে সেখানে শুধু জরিমানা অনাদায়ে দু-এক মাসের শাস্তি এই ধরনের গুরুতর অপরাধে মোটেও যথোপযুক্ত নয়।

বিশেষ ক্ষমতা আইনে গুরুতর অপরাধগুলো এভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে: রেশনে সরবরাহকৃত দ্রব্যাদির কালোবাজারি এবং রেশনের লাইসেন্স, পারমিট ইত্যাদি কেনাবেচা করা; আইনে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি দ্রব্যাদি মজুদ করা; ধারা: ২৫ (১) খাদ্য, পানীয়, ওষুধ ও প্রসাধনী দ্রব্যে ভেজাল দেওয়া বা ভেজাল সামগ্রী বিক্রি করা; (ধারা-২৫ গ) এবং ১৯৭৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বিশেষ ক্ষমতা আইন করা হয়। ইংরেজি ভাষায় করা আইনের ২৫ ধারায় কালোবাজারে লেনদেনের দণ্ড, ২৫ (এ) ধারায় মুদ্রা-নোট এবং সরকারি স্ট্যাম্প জাল করার দণ্ড, ২৫ (বি) ধারায় চোরাচালানের দণ্ড, ২৫ (সি) ধারায় খাদ্য, পানীয়, ওষুধ, প্রসাধন দ্রব্যে ভেজাল মেশানো বা বিক্রির দণ্ড, ২৫ (ডি) ধারায় অপরাধ সংঘটনে উদ্যত হলে দণ্ড এবং ২৫ (ই) ধারায় কোম্পানি দ্বারা অপরাধের বিষয়ে বলা হয়েছে।

এখন আইন কমিশন ২৫ (সি)-এর পরে ২৫ গগ নতুন ওই ধারা সংযোজন করার সুপারিশ করেছে। আইনের ২৫ (সি) ধারায় দুটি উপধারা আছে। এর মধ্যে উপধারা ২ তে দুটি দফা রয়েছে। কমিশন এখন ‘গ’হিসেবে গৃহনির্মাণ সামগ্রী বা আসবাব বা অন্য যেকোনো ব্যবহারযোগ্য দ্রব্যের সঙ্গে নিম্নমানের দ্রব্য দিয়ে ভেজাল মেশানো অপরাধ হিসেবে গণ্য করার কথা বলেছে। এবং উহা বিক্রয় বা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে পরিবহন করে বা মজুত করে; তবে সে ব্যক্তি অনধিক যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। (সূত্র: ১৪ আগস্ট, ২০১৪, দৈনিক প্রথম আলো।)

কিন্তু বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্ট আইনে তড়িঘড়ি করে যে সাজাটি দিলেন তা কি উপযুক্ত শাস্তি হলো। জরিমানা পরিশোধ করে আবার একই অপরাধ করার সুযোগ তৈরি হলো কিনা সে বিষয়টি দেখতে হবে। বরং বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যা করতে পারতেন তা হলো তিনি বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (১), ২৫ সি ও সংশ্লিষ্ট আইনে থানা এজাহার করে (জিআর কেস) নিয়মিত মামলা দায়ের করে আসামিকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দিলে উপযুক্ত বিচার হতো। মূল বিচার হতো বিশেষ ট্রাইব্যুনালে।

বেশি সাজা যে আইনে বা অপরাধে সুনির্দিষ্ট আইন-কানুন বিদ্যমান সেখানে মোবাইল কোর্ট আইনে শুধু জরিমানা করলে যুগপৎভাবে আরেকটি বিচার ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে মানুষকে অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করা যাবে কিনা তা প্রশ্নের উদ্রেক করে। শুধু জরিমানা অনাদায়ে ২-৩ মাসের সাজা ওষুধে ভেজাল বা মজুতদারির জন্য প্রদান মোটেই উপযুক্ত সাজা নয়।

আমি ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিরুদ্ধে নই এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিরুদ্ধেও এই লেখাটি না। আমি শুধু বলছি অপরাধের ধরন ও গুরুতর কিনা তা উপলব্ধি করে যেখানে যে অপরাধের বিচার হওয়া উচিত সেখানেই বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম পরিচালনায় ভুল ভ্রান্তি পরিলক্ষিত হওয়ায় এবং আইন মাফিক বিচার প্রক্রিয়া পরিচালিত না হওয়ায় জনমনে মোবাইল কোর্ট নিয়ে ভুল মেসেজ যাচ্ছে। ফলে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হতে হবে আইনে পড়া বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে। পরিবেশ আদালত আইন এবং বিশুদ্ধ খাদ্য আইন অনুযায়ী মোবাইল কোর্ট ইতোমধ্যে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে বেশ কয়েকটি জেলায় যা ইতোমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে।

বিচার দ্রুত করতে গিয়ে ন্যায়বিচারকে কোনোভাবেই ছুড়ে ফেলা যাবে না। শুধু বিচার করলে চলবে না, ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসন ওই বিচারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা হচ্ছে তা জনগণকে বোঝাতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত কি সকল ক্ষেত্রে জনগণের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। সেটিও অনেক মূল্যের প্রশ্ন। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর এবং এজন্য ইতিমধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার, সংবিধান সংস্কার, পুলিশ সংস্কার, নির্বাচন সংস্কার এবং জনপ্রশাসন সংস্কারসহ বিচার ব্যবস্থাকে ডিজিটাইজ করতে গৃহীত ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্প, লিগ্যাল এইড ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি এবং আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার আইন আমাদেরকে আশাবাদী করেছে।

আবার বিদ্যমান ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হয় এমন অভিযোগ প্রায়ই শুনি। কেন বিলম্ব হয়, কীভাবে দ্রুত ন্যায়বিচার জনগণের দোরগোঁড়ায় পৌঁছানো যায় তার সমাধান করতে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আনতে হবে এবং সে অনুযায়ী আইন মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে শিগগিরই। মোবাইল কোর্টকে আইনী কাঠামোতে সংবিধান ও বিদ্যমান ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা অনুসারে ঢেলে সাজাতে হবে। মোবাইল কোর্ট চলবে বিচার বিভাগের অধীনে। নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব বিচার করা নয়। বিচার বিভাগের ন্যায় সমান্তরালে অন্যান্য শর্টকার্ট বিচার ব্যবস্থা বা মোবাইল কোর্ট যতোই জনপ্রিয় হয়ে উঠুক না কেন সাংবিধানিকভাবে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা মোবাইল কোর্ট আইনে বর্ণিত অপরাধের বিচার না হলে মানুষ দীর্ঘমেয়াদে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন থেকে বঞ্চিত হবে।

লেখক: মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম; পিএইচডি ফেলো, আইন গবেষক ও কলামিস্ট।