সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ১১ বছর কেন আমি বাইরে থাকলাম? ২০১৩ সালে আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি হলো। দেশের অবস্থা বেশি খারাপ। আমাদের বেশি ঘরের বাইরে থাকতে হচ্ছে। চিন্তা করলাম, মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য লন্ডন যাবো।
তিনি বলেন, ‘১৮ ডিসেম্বর সকালে লন্ডনে গিয়ে নামলাম। হঠাৎ করে দুপুরে জানতে পারলাম আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমি নাকি ঢাকার রাস্তায় ছিলাম। পুলিশের ওপর বোমা মেরেছি।’
সোমবার (৬ জানুয়ারি) সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এসব কথা বলেন। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক অ্যাসোসিয়েটস এই সংবর্ধনার আয়োজন করে।
জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার, প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন, ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, সিনিয়র আইনজীবী এস এম শাহজাহান, মোহাম্মদ হোসেন, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন প্রমুখ।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, ‘জুডিশিয়ারি যদি রক্ষা করতে পারতাম, অনেক লিডারকে দেশ ছাড়তে হতো না। অনেকের জেলে যেতে হতো না। ১৯৩৫ সালের ব্রিটিশ সরকার থেকে গত সরকার পর্যন্ত অল মোস্ট আমাদের জুডিশিয়ারি স্বাধীন ছিল, প্রেস স্বাধীন ছিল। মানুষের স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু এই স্বাধীনতাকে গত সরকার হরণ করেছিল। সুতরাং, জডিশিয়ারিকে যদি আমরা বাঁচাতে পারতাম, পারতাম কিনা আমি জানি না— তাহলেও এই জাতি অনেক আগে এই ডিক্টেটরশিপের হাত থেকে রক্ষা পেতো। আজকে বার বেঞ্চ, আপামর জনসাধারণ সবার একটা লক্ষ্য হওয়া উচিত— আমরা আমাদের জুডিশিয়ারিকে কোনও সময়ই পরাধীন হতে দেবো না। একইসঙ্গে আমরা একটা স্বাধীন বার গড়ে তুলবো।’
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, ‘আমরা যদি সত্যিকার অর্থে এই বাংলাদেশকে তার নিজের জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, সব ধরনের ইন্টারেস্ট থেকে বারকে মুক্ত করতে হবে। আমরা স্বাধীন বার চাই। আমরা স্বাধীন জুডিশিয়ারি চাই। যদি এগুলোর নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারি, তাহলে সত্যিকার অর্থে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে। মানুষের ঋণ শোধ করতে পারবো। আমার আহ্বান হবে— আমরা বাইরে রাজনীতি করবো। কিন্তু এখানে (বার) মেম্বারস অব দ্য বার। উই আর লাকি দ্যাট উই হ্যাভ গট ভেরি কম্পিটেন্ট, এডুকেটেড, অনেস্ট চিফ জাস্টিস।’
‘১১ বছর কেন আমি বাইরে থাকলাম? ২০১৩ সালে আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি হলো। দেশের অবস্থা বেশি খারাপ। আমাদেরকে বেশি ঘরের বাইরে থাকতে হচ্ছে। চিন্তা করলাম, মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য লন্ডন যাবো। ১৮ ডিসেম্বর সকালে আমি লন্ডনে নামলাম। হঠাৎ করে দুপুরে জানতে পারলাম আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমি নাকি ঢাকার রাস্তায় ছিলাম। পুলিশের ওপর বোমা মেরেছি। এর কিছুদিন পরে আমি জানতে পারলাম উচ্চ পর্যায়ের একটি দেশের কূটনৈতিক সোর্স থেকে— শেখ হাসিনা আমাকে গ্রেফতার করার অনুমতি দিয়েছেন, আইসিটির অধীনে। কিছুই আমি জানতাম না। সুতরাং, এটা আল্লাহর মেহেরবানী। ৫ বছর পুলিশ আমাকে অত্যন্ত জ্বালাতন করেছে। ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর পুলিশ আমার বাসায় গিয়েছে। কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্ত বিদেশে চলে গেলাম। ফিরতে ১১ বছর লেগেছে। ১১ বছর আমি ইংল্যান্ডে থেকে প্র্যাকটিস করেছি।’
তিনি বলেন, ‘আপনি ইংল্যান্ডে একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রভাবিত করতে পারবেন না। কোনও উপায় নেই। আর এখানে কী চলছে আমরা সবাই জানি। আসুন, সবাই একমত হই।’
সভাপতির বক্তব্যে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘এখানে যারা আইনজীবী আছেন তারা প্রশাসনে যাবেন। আপনারা যদি শক্তশালী হয়ে থাকেন, আজ হোক কাল হোক দেশ ভালো হতে বাধ্য। আমরা সমাজকে দিয়ে যাবো, কী দিয়ে যাবো। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের জ্ঞান দিয়ে যেতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশরা আমাদের শাসন-শোষণ করেছে, কিন্তু তারাও আইনকে সম্মান করতো। কিন্তু একজন রাজনীতিক রাস্তা দিয়ে যাবে, আর তাকে উধাও করে দেওয়া হবে— এমন উধাও করে দেওয়াটা অতীতে ছিল না।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ১১ বছর পরে দেশে ফিরে এসেছেন, এজন্য আমি আনন্দিত। একইসঙ্গে আমি মনে করি, আগামীর বাংলাদেশে, বৈষম্যহীন বাংলাদেশে এক অনবদ্ধ মানুষ হিসেবে, আইনজীবী হিসেবে তিনি ভূমিকা রাখবেন।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আইনজীবী তার মক্কেলের পক্ষে কথা বললে, আইনি সহায়তা করলে, সেই আইনজীবীকে বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করতে হয় ১১ বছর, সেটা ব্যারিস্টার রাজ্জাককে দেখলে বোঝা যায়। আমি মনে করি, ব্যারিস্টার রাজ্জাক যে একটি প্রতিষ্ঠান, তিনি যে ক্ষণজন্মা পুরুষ সেটা বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার মনের অজান্তে প্রমাণ করে গেছে।’
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘স্বৈরাচারী সরকার যখন দেখলো ওনাকে আর দেশে থাকা চলতে দেওয়া যায় না, তখন ওনার পেছনে লেগে গেলো। উনি দেশ ছেড়ে যান। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক (আইনের) ধারালো অস্ত্র ধরে রাখতেন বলে স্বৈরাচারি সরকার চিন্তা করে— তাকে দেশে থাকতে দেওয়া যায় না। আল্লাহ ওনাকে আবার ফিরিয়ে দিয়েছেন।’
জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক খুবই অসুস্থ ছিলেন। মহান আল্লাহ তাকে আবারও আমাদের মাঝে ফিরিয়ে এনেছেন। আমরা আশা করবো, তিনি আবারও আইন পেশায় ফিরে আসবেন। বিগত দিনে তিনি জ্ঞানের আলো দান করেছেন। তাকে আমরা আবার ফিরে পাবো।’
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের ১১ বছর আগে চলে যাওয়া, আবার ফিরে আসা আমার কাছে আলৌকিক মনে হয়। ৫ আগস্টের আগে কেউ মনে করেনি— শেখ হাসিনার মতো দুর্দান্ত প্রতাপশালী শাসক এভাবে পালিয়ে যাবে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় অর্জন আর কিছু হতে পারে না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া এইদিন তিনি মানুষকে দেখিয়েছেন।’