যৌথ সম্পত্তি কিনলে সম্পত্তি হস্তান্তর আইনানুযায়ী ক্রেতার অবস্থান ও ব্যাখ্যা
সোহরাওয়ার্দী আরাফাত খান

রেজিষ্ট্রেশন ও সম্পত্তি হস্তান্তর আইনানুযায়ী হেবা ও দান প্রসঙ্গ

সোহরাওয়ার্দী আরাফাত খান: হেবা বা দান হলো কোন বিনিময় বা প্রতিদান ছাড়াই পণ মূল্য ব্যতিত স্বেচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে সম্পত্তি হস্তান্তর করে যে মৌখিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয় তাকে হেবার ঘোষনাপত্র বলে। সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ১৮৮২ এর ধারা ১২২ থেকে ১২৯ নং ধারা পর্যন্ত হেবা বা দান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

যাদের বরাবরে হেবার মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর করা যায়

রেজিষ্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ধারা ৭৮ক (খ) অনুযায়ী স্বামী – স্ত্রী, পিতা/মাতা ও সন্তান, দাদা/দাদী/নানা/নানী – নাতি/নাতনী, সহোদর ভাই/ বোনদের মধ্যে হেবার মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর করা যায়। তবে এই সম্পর্কের বাহিরে অন্যান্য সম্পর্কের মধ্যে বা ভিন্ন ধর্মালম্বীদের মধ্যে দানপত্র দলিল সম্পাদন করা যাবে।

রেজিষ্ট্রেশন কি বাধ্যতামূলক

মুসলিম মোহামেডান আইন অনুযায়ী হেবার বৈধতার জন্য লিখিত কোন দলিল সম্পাদনের প্রয়োজন নেই। তবে সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ১৮৮২ এর ১২৩ নং ধারা ও সংযোজিত রেজিষ্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ১৭ (১) (ক) ও (কক) নং ধারা মতে স্থাবর সম্পত্তির দানের ক্ষেত্রে উক্ত হেবা বা দানপত্র দলিল নিবন্ধিত হতে হবে এবং তা দলিল দাতা কর্তৃক সম্পাদিত হতে হবে ও কমপক্ষে দুই জন সাক্ষীর মাধ্যমে শনাক্তকৃত হতে হবে।

তাছাড়া হেবা দলিলের প্রত্যেক পৃষ্ঠায় দাতার আড়ায়াড়ি ভাবে স্বাক্ষর থাকবে এবং ১৯ নং কলামে সনাক্তকারীর স্বাক্ষর থাকবে। এছাড়া ২০ নং কলামে গ্রহীতার ও স্বাক্ষর থাকবে।

মুসলিম আইনের বিধান মতে হেবা বা দানের জন্য ৩টি শর্ত

মুসলিম আইনের বিধান মতে একটি বৈধ হেবা বা দানের জন্য ৩টি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত অবশ্যই পালনকরতে হবে।

১) দাতা কর্তৃক দানের কথা ঘোষণা করতে হবে

২) দান গ্রহীতা বা তার পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক সুস্পষ্ট ভাবে বা অস্পষ্ট ভাবে দানটি গ্রহণ করতে হবে।

৩) দাতা কর্তৃক দান গ্রহীতাকে দানের বিষয় বস্তুর দখল প্রদান করতে হবে।

তবে সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ১৮৮২ এর ১২২ ধারা মতে হেবা বা দান সম্পন্ন/বৈধ করতে হলে নিম্নোক্ত ৩টি বিষয় অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে-

১) হেবা বা দানটি স্বেচ্ছায় হস্তান্তর করতে হবে।

২) হেবা বা দানটি বিনাপণে হস্তান্তর করতে হবে।

৩) হেবা বা দানটি গ্রহীতা কর্তৃক হস্তান্তর করতে হবে।

দান গ্রহণের পূর্বে দান গ্রহীতার মৃত্যু

আরো উল্লেখ্য যে দাতা ও গ্রহীতার জীবদ্দশায় অবশ্যই দান পত্র বা হেবা দলিল সম্পাদন করতে হবে। দানগ্রহনের পূর্বে যদি দান গ্রহীতার মৃত্যু ঘটে তবে সেই দান বাতিল বলে গন্য হবে। এই ক্ষেত্রে দাতা বা গ্রহীতার ইচ্ছা বা অভিলাষ গ্রহণযোগ্য হবে না যদি দান গ্রহনের পূর্বে যদি দান গ্রহীতার মৃত্যু ঘটে।

দান সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে দাতার মৃত্যু

মৌখিক ভাবে দান সম্পন্ন করে যদি দাতা মৃত্যুবরন করেন সেক্ষেত্রে দাতার বৈধ ওয়ারিশগন যদি দানকৃত ভূমিগ্রহীতার বরাবরে রেজিষ্ট্রেশন প্রদান করে থাকেন তবে উক্ত দান পত্র দলিলকে অবৈধ হিসেবে গন্য করার সুযোগ নেই। দাতা মৃত্যুর পূর্বেই তিনি দান সম্পন্ন করেছেন। সুতরাং দাতার ওয়ারিশগন রেজিষ্ট্রেশন প্রদান করলে উক্ত দানপত্র দলিলকে বৈধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।

দান পত্র দলিল কখন কবলা দলিলে পরিণত হয়?

পণ মূল্যে বিনিময়

পণ মূল্যের বিনিময়ে যদি একটি দান পত্র দলিল সম্পাদন হয়ে থাকে তবে সেই দান পত্র দলিল তার বৈধতা হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ একটি দান পত্র দলিল সম্পাদন করতে হবে স্বেচ্ছায় এবং কোন প্রকার বিনিময় ছাড়া।

সরকারের রাজস্ব বা কর ফাঁকি দিতে যদি দানপত্র দাতা বা গ্রহীতা নিজেদের মধ্যে পণ মূল্যের বিনিময়ে কবলা দলিলের পরিবর্তে হেবা বা দান পত্র দলিল সম্পাদন করেন তখন উক্ত দলিল বিক্রয় হিসেবে গন্য হয়। (AIR 2011 NOC 98)

দেনা পরিশোধের পরিবর্তে দান পত্র দলিল সম্পাদনের মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর

কোন ব্যক্তি যদি দেনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় এবং দেনা পরিশোধের নিমিত্তে দান পত্র দলিল সম্পাদনের মাধ্যমে যদি উক্ত দেনা পরিশোধ করে থাকেন তবে উক্ত দানপত্র দলিল তার বৈধতা হারিয়ে কবলা দলিল হিসেবে গন্য হয়। (AIR 1951 All 86)

স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধের পরিবর্তে দান পত্র দলিল সম্পাদনের মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর

কোন পুরুষ ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীর প্রাপ্য দেনমোহর নগদে আদায়ের পরিবর্তে দান পত্র বা হেবা দলিল সম্পাদনের মাধ্যমে পরিশোধ করে তবে উক্ত দান পত্র দলিল কবলা দলিল হিসেবে গন্য হয় (23 BLT (AD) 111)। তবে কিছু কিছু সিদ্ধান্তে উক্ত দানকে হেবা বিল এওয়াজ হিসেবে গন্য করা হয়েছে (AIR 1936 All 600)।

উপরোক্ত কারণ সমূহের কারনে যদি দানপত্র দলিল কবলা দলিলে পরিণত হয় তখন খতিয়ানের সহ শরীকদারের দায়েরী প্রিয়েমশান মামলা গ্রহনযোগ্য কিনা?

যদি কোন দান পত্র দলিল উপরোক্ত বিষয় সমূহের কারনে বিক্রয় হিসেবে গন্য হয় সেক্ষত্রে খতিয়ানের কোন সহ শরীকদার উক্ত দান পত্র দলিলের গ্রহীতার বিরুদ্ধে অগ্রক্রয় মোকদ্দমা দায়ের করতে পারবেন বলে আপিল বিভাগ মতামত প্রদান করেছেন (26 BCR AD 1)।

উল্লেখ্য যে, অগ্রক্রয়ের মামলা শুধু মাত্র বিক্রয় দলিলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। যদিও উপরের বর্ণিত বিষয় সমূহের ক্ষেত্রে দান পত্র দলিল সম্পাদন হয়েছে কিন্তু উক্ত দান পত্র দলিল সমূহ বিক্রয় হিসেবে গন্য হয়েছে তাই এই ক্ষেত্রে অগ্রক্রয়ের মোকদ্দমা দায়েরকরতে কোন সমস্যা নেই।

নাবালকের পক্ষে তার পিতা/মাতাকে দান

নাবালকের পক্ষে তার পিতা/মাতা দানকৃত সম্পত্তি গ্রহণ করতে পারবেন এবং এর ফলে দানকৃত ভূমির দানপত্র অবৈধ হিসেবে গন্য হবে না কিংবা উক্ত দানপত্র বাতিল হিসেবে গন্য হবে না। (AIR 2004 P &H 257)

মুসলিমদের ক্ষেত্রে দাতা কর্তৃক দান গ্রহীতাকে দানের বিষয় বস্তুর দখল প্রদান করা আবশ্যক কিনা?

মুসলিম আইনের বিধান মতে একটি দান পরিপূর্ণ হয় দখল হস্তান্তরের মাধ্যমে। কিন্তু সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ১৮৮২ এর ধারা ১২২ হতে ১২৯ নং ধারায় কোথাও সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা হয় নাই যে স্থাবর সম্পত্তির হেবা বা দানের ক্ষেত্রে দখল হস্তান্তর আবশ্যক।

বরং ১২২ ও ১২৩ নং ধারায় হেবা ও দানের ক্ষেত্রে রেজিষ্ট্রেশনকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং উক্ত দলিল দুই জন সাক্ষী দ্বারা সনাক্ত করতে হবে উল্লেখ করা আছে। সুতরাং সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের বিধান মতে দখল হস্তান্তরকে আবশ্যক করা হয় নাই।

তবে বর্তমানে সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের বিধান মতে রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক। যেহেতু রেজিষ্ট্রীকৃত দলিলের মাধ্যমে স্বত্ব হস্তান্তর হয়ে থাকে এবং দলিলের দাতা স্বত্ব ত্যাগ করে রেজিষ্ট্রেশন প্রদান করে থাকে।

তাই বলা যায় দান বা হেবা দলিলের দাতা স্বত্ব ত্যাগ করে একই সাথে গ্রহীতার বরাবরে দখল হস্তান্তর করেছেন।

হিন্দুদের ক্ষেত্রে দাতা কর্তৃক দান গ্রহীতাকে দানের বিষয় বস্তুর দখল প্রদান করা আবশ্যক কিনা?

পূর্বে সনাতন ধর্মের ক্ষেত্রে দানপত্র দলিল সম্পাদনের সাথে সাথে দখল হস্তান্তর আবশ্যক ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালের ২৬ নং আইনের মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ১৮৮২ এর ১২৩ নং ধারা সংযোজন হওয়ার মাধ্যমে শুধু মাত্র দান পত্র দলিল রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে কিন্তু দখল হস্তান্তের আবশ্যকতাকে বিলোপ করা হয়েছে।

মূলত সামগ্রিক ভাবে সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১২২ নং ধারা মতে দানকৃত ভূমি দাতার নিকটহতে গ্রহন করতে সম্মতি প্রকাশের মধ্যেই দখল হস্তান্তর প্রকাশ পেয়ে থাকে। সনাতন ধর্মালম্বীদের ক্ষেত্রে দানপত্রদলিল যদি রেজিষ্ট্রেশন করা হয়ে থাকে তবে সেই ক্ষেত্রে দখল হস্তান্তরের আবশ্যকতা নেই মর্মে হাইকোর্ট বিভাগ মতামত প্রদান করেছেন। 23 BLC 771, 8 DLR 65

হেবা বা দান পত্র দলিল কি শর্ত সাপেক্ষে বাতিল করা যায়?

মুসলিল আইনের বিধান মতে শর্ত সাপেক্ষে দান কখনো কার্যকর হয় না। শর্ত প্রয়োগ করে হেবা বা দানকে কখনো সীমিত করার সুযোগ মুসলিম আইনের বিধানে নেই। একই সাথে সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২ এর ১০ ধারা মতে ইজারা চুক্তি ব্যতীত অন্য সকল ক্ষেত্রে স্বত্ব হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কোন শর্ত প্রয়োগ করা হলে সেই শর্ত অবৈধ হিসেবে গন্য করা হবে।

কিন্তু সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ১৮৮২ এর ১২৬ নং ধারায় দানপত্র দলিল প্রত্যাহার বা স্থগিত বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। উক্ত ১২৬ নং ধারায় বলা হয়েছে যে-

১) দাতা ও গ্রহীতাগনের সম্মতি প্রদান সাপেক্ষে পক্ষগনের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয় এমন কোন ঘটনা ঘটলে সে ক্ষেত্রে হেবা বা দান প্রত্যাহার করা যেতে পারে।

২) দাতা ও গ্রহীতা যদি এই মর্মে সম্মত হন যে, দাতার ইচ্ছা অনুযায়ী দানটি প্রত্যাহারযোগ্য তবে উক্তদানটি দাতা যে কোন সময় বাতিল করতে পারেন।

৩) চুক্তি ক্ষেত্রে যে সকল কারণে চুক্তি বাতিল হয়, ঠিক সে কারনে ও দান বাতিল হতে পারে।

এছাড়া উক্ত আইনের ৩১ ধারা মতে শর্ত সাপেক্ষে কোন অনিশ্চিত ঘটনা ঘটলে বা না ঘটলে সেই ক্ষেত্রে হস্তান্তরযোগ্য দলিল বাতিল হতে পারে।

সুতরাং বেসিক মুসলিম আইনের মূল নীতি, সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০ ধারা মতে শর্ত সাপেক্ষে কোন দলিল হস্তান্তর করা অবৈধ হলে ও একই আইনের ১২৬ ও ৩১ নং ধারা মতে শর্ত সাপেক্ষে হেবা বা দান পত্রদলিল সম্পাদন ও রেজিষ্ট্রেশন করা যাবে এবং বাতিল/প্রত্যাহার/স্থগিত ও করা যাবে।

লেখক: ব্যারিষ্টার ও অ্যাডভোকেট