সাইবার অপরাধ আইন বিশ্লেষণ ও মতামত
মোহাম্মদ মনির উদ্দিন

সাইবার অপরাধ আইন বিশ্লেষণ ও মতামত

মোহাম্মদ মনির উদ্দিন: আইন প্রণয়ন মানুষের জন্য। মানুষের যাতে কল্যাণে নিশ্চিত হয়। গণমূখী আইন রাষ্ট্রের নিয়ামক। অন্যায়-অত্যাচার, অপরাধ দমন রাখার নিমিত্ত আইন প্রণীত হয়ে থাকে। ফলে আইন সুস্পষ্ট, সম্পূর্ণ, ত্রুটিমুক্ত এবং দ্ব্যর্থহীন করা অবশ্যই সমীচীন। প্রণীত আইন যদি অস্পষ্ট, ত্রুটিযুক্ত, ঝাঁপসা ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় না।আকাঙ্ক্ষা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। অনেক সময় বুমেরাং হয়ে যায়।
যে-কোনো আইন প্রণয়ন যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়, মানুষের অধিকার হরণ ও বিরোদ্ধমত-পথ দমনের হাতিয়ার হয়, তবে এ আইনকে নিঃসন্দেহে আইনের ভাষায়  ‘কাল আইন’ হিশেবে বিবেচনা করতে হয়। বাংলাদেশে হরেকরকমের ‘কুচকুচে কাল’ আইনের বিদ্যমান রয়েছে। বিদ্যমান এসব ‘কুচকুচে কালো’ আইন সামষ্টিকভাবে জাতির জন্যে  দুর্ভাগ্যজনক।
বিস্তর কালো আইন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও, মানুষের জন্যে অ-কল্যাণ হবে, এমন আরও অনেক আইন শাসকগোষ্ঠী তাঁর শাসন-শোষণ, দমন-পীড়নের স্বার্থে করে থাকে। ঠিক এভাবেই ধাপে-ধাপে সাইবার অপরাধ দমন, প্রতিরোধ ও নিবারণ করতে বাংলাদেশে প্রথমে- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এরপর সর্বশেষ সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ প্রণীত হয়। এ আইনগুলো অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণপূর্বক মতামত জনসমক্ষে হাজির করা হলো।
সাইবার অপরাধ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টারনেট মাধ্যমে সংঘটিত হয়। কমবেশি সব দেশই প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত তথা হামলার শিকার হচ্ছে। এতে করে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। ফলে এ অপরাধ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ দেবারতি হালদার ও কে জয়শংকর সাইবার অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, ‘আধুনিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক, যেমন ইন্টারনেট (চ্যাট রুম, ই-মেইল, নোটিশ বোর্ড ও গ্র“প) এবং মোবাইল ফোন (এসএমএস/এমএমএস) ব্যবহার করে, অপরাধমূলক অভিপ্রায়ে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে সম্মানহানি, কিংবা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি বা ক্ষতির কারণ হওয়া’।
এ ধরনের অপরাধ যে-কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে হুমকির কারণ হতে পারে। বৈশ্বিকভাবে রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তি সত্ত্বা কর্তৃক  গুপ্তচরবৃত্তি, ডিজিটাল আর্থিক প্রতারণা, প্রলোভন দেখিয়ে সাইবার স্পেস-এ প্রচারনা, অনলাইন প্রতারণা ফাঁদ, সীমান্ত অপরাধ-সহ নানা রকমের সাইবার অপরাধ অহরহ সংঘটিত হচ্ছে। ফলে এ অপরাধ দমন ও অপরাধীকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্যে যুগোপযোগী আইন অতি জরুরী। এ বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে আইন করার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে কতগুলো আইন প্রনয়ণ করা হয়। ভিন্ন-ভিন্ন সময়ে প্রণীত আইনসমূহের নানা সঙ্গতি-অসঙ্গতি বিদ্যমান। শাসকগোষ্টীর শাসন নিরঙ্কুশ ও নির্বিঘ্ন করার নিমিত্ত কুট কৌশলের উদ্দেশ্য প্রণীত আইনসমূহের বিশ্লেষণ করা হলো।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-জামাত ইসলামীর সরকার কর্তৃক পাস হয়। আইন প্রণয়নের পর ২০ আগস্ট, ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এক অধ্যাদেশ পাসের মাধ্যমে সংশোধন করা হয়েছিল; যা- ০৯ অক্টোবর বাংলাদেশের সংসদ দ্বারা পাস হয়েছিল। সংশোধনকৃত আইনের অধীনে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আটক করার অনুমতি দেয়। এবং কারাদণ্ড  বৃদ্ধি করা হয়। সংশোধনকৃত আইনের অধীনে মামলা দায়ের করার আগে সরকারের কাছ থেকে পূর্বানুমতি নেওয়ার জন্যে আইন প্রয়োগকারীর প্রয়োজনীয়তাকেও সরিয়ে দিয়েছিলো। সংশোধনকৃত আইন মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্ভাবনা রয়েছে মর্মে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিলো। অনেকেই বলেছেন যে- আইনের এ সংশোধনী বাংলাদেশকে ‘মধ্যযুগে’ টেনে নিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত এ আইনের প্রয়োগের বাস্তব ভয়াবহতা টের পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত আইনটি একই সনের ৩৯ নম্বর আইন।আইনে মোট ০৯টি অধ্যায় ও ৯০টি ধারা রয়েছে। আইন প্রণীত হওয়ার সাথে-সাথে মৃদু প্রতিবাদ হয়, বিভিন্ন মহল থেকে। আইনের যখন প্রয়োগ শুরু হয়, তখন ভয়াবহতা ও তীব্রতা বিশেষভাবে টের পাওয়া যায়। মূলত ভুক্তভোগীরা অত্যাধিক টের পান। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন  প্রনয়ণ ও প্রয়োগ হওয়ার সাথে-সাথে গোটা দেশে ৫৭ ধারা নিয়ে ব্যাপক আওয়াজ ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। ফলে সর্বত্র মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সচেতন মানুষজন সোচ্চার হন, বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিবাদ করেন। দেখা যায় যে, সংশোধনকৃত ৫৭ ধারাটিতে পরিবর্তন এনে কারাদণ্ডের মেয়াদ বৃদ্ধি করে অন্যূন সাত বছর এবং অনধিক ১৪ বছর করা হয়।
প্রথম থেকেই ধারাটি ছিল অ-জামিনযোগ্য কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এর সকল ধারাই ছিল অ-আমলযোগ্য। এর অর্থ দাঁড়ায়- পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের লিখিত অনুমতি ব্যতীত এ আইনে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না। সংশোধনকৃত এ আইনকে আমলযোগ্য করায় পুলিশের ওপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকেনি। পুলিশ চাইলেই যে-কোনো সময় যে-কাউকে এ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতায় গ্রেপ্তার করতে পারবে।
আইনে দোষীকে অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানা করা যাবে। ফলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, সমালোচনার ঝড় ওঠে। মানুষ প্রতিবাদ করেন। যে- কারণে ২০০৬ সালের আইন ২০০৯ এবং ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে দু’বার সংশোধন করা হয়। এতৎসত্বেও  এ আইনের অসঙ্গতি দূর হয়নি। ফলশ্রুতিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এর ৫৪, ৫৫, ৫৬ এবং ৫৭ ধারা বাতিল করা হয়। ধারাগুলো বাতিলের পরও এ আইনের বিস্তর অ-প্রয়োগ হয়েছে।
ধারাগুলো বাদে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ অধ্যাবধি বহাল আছে। কিন্তু অপরদিকে সাইবার কার্যক্রম যতই বেড়েছে- ঠিক ততই সাইবার অপরাধ বেড়েছে। ক্রমাগতভাবে অপরাধের ধরণ ও বৈশিষ্ট্য পাল্টানোর কারণে এ আইনে সংকুলান না-হওয়ায় নতুন করে ভাবতে হয়। নতুন আইন হাজির করা হয়-ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০২৮। এ আইন প্রণয়ন করে আওয়ামীলীগ জোট সরকার। অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে-এ আইনও দমন পীড়নের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার দুষ্টোমন নিয়ে প্রণয়ন করা হয়। অর্থাৎ উদ্দেশ্যে ছিল দমন-পীড়ননীতির।
সাইবার অপরাধ দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ২৯-০১-২০১৮ তারিখে মন্ত্রিপরিষদ সভায় আইনটির খসড়া অনুমোদিত হয়। খসড়া আইনটি বিল আকারে মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবিত আইনটি পাশ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর শেষে এটি আইন হিসেবে কার্যকর হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-তে মোট ৪৮টি ধারার মধ্যে ০১ থেকে ১৬ ধারায় ডিজিটালের সংজ্ঞা, ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব, ইমার্জেন্সি রেসপন্সটিম গঠন এবং ১১ সদস্যের একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।
এ আইনে ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪ ধারাসমূহ আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য এবং আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে আপসযোগ্য, অপরাধের বিচার ও দণ্ডের বিষয়ে ১৭-৪৮ ধারায় বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। বহুল আলোচিত ৫৭ ধারাসহ উল্লিখিত পাঁচটি ধারা বাতিল করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-তে ৪৮টি ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্তির বিধান উল্লেখ রয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর উল্লেখযোগ্য বহুল আলোচিত ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্টানে কেউ যদি বেআইনীভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যে কোনো ধরনের ইলেকট্রানিক্স যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচর বৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে সেই ব্যক্তি ১৪ বছরের কারাদন্ড ও ২০ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দণ্ডিত হবেন।’
এ আইনের ২৮ ধারায় রয়েছে, ‘কেউ যদি ধর্মীয়বোধ ও অনুভূতিতে আঘাত করে, তাহলে তার ১০ বছরের জেল ও ২০ লক্ষ টাকা জরিমানা হবে। ২৯ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কেউ মানহানিকর কোনো তথ্য দিলে সেই ব্যক্তির ৩ বছরের জেল ও ৫লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডি হবে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ একটি গণবিরোধী ও সংবিধান পরিপন্থী আইন হিসেবে আবির্ভূত হয়। আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে ভয়াবহভাবে নিপীড়নের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ আইনের ফলে মানুষের অধিকার খর্ব করা হয়েছে, বাক স্বাধীনতা দমনের ব্যবস্থাসহ অপরাপর যেসব প্রভাব পড়েছে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:-
▪️সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ এর অ-প্রয়োগের কারণে মানুষের নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি;
▪️সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ এর ফলে দুর্নীতির সুযোগ হয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রসার;
▪️শাসকদের হাতে নিপিড়নের শক্তিশালী অস্ত্র তুলে দিয়ে বহু মানুষ নিপীড়নের শিকার;
▪️আমলাদের ক্ষমতা অ-প্রয়োগের দাপট বহুগুন বেড়ে যায়;
▪️সরকারের ইচ্ছায় অনেক মানুষকে অতি সহজে আটক করে দিনের পর দিন কারাগারে রাখা;
▪️এ আইনের কারণে সংবাদের তথ্য সংগ্রহ করা জটিল হয়। সাংবাদিকরা কারো কাছ থেকে কোনো তথ্য সংগ্রহ করে সংবাদ পরিবেশন করতে মারাত্বক প্রতিবন্ধকতা সম্মূখীন;
▪️ঘুষ-দুর্নীতির মাত্রা সর্বত্র প্রসারিত;
▪️ঘুষ-দুর্নীতি সহনশীল হয়ে অধিকতর প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃস্টি;
▪️গণমাধ্যমের অনেক ক্ষেত্রে পঙ্গুত বরণ;
▪️সাংবাদিকদের দৃশ্যত হাত-পা বেঁধে দেওয়া;
▪️সাংবাদিককে অতি সহজেই গুপ্তচর হিসেবে চিহ্নিত; ▪️অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করা রুদ্ধ;
▪️আমলাদের দুর্নীতি-ঘুষ বাণিজ্যের খবর প্রকাশ করা যায় না;
▪️লেখক, ব্লগার, সিটিজেন সাংবাদিকতা-সহ মুক্তচিন্তার গলা টিপে ধরা;
▪️এ আইনের ফলে ঘুষ গ্রহণের ছবি ও তথ্য প্রকাশ করা অধিকতর কঠিন তোলা;
▪️গোপনীয়তার সংস্কৃতি চর্চা বৃদ্ধি ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি;
▪️লেখার জন্যে একরকম এবং অনলাইনে লেখার জন্যে আরেকরকম শাস্তি বা দণ্ড;
▪️দুর্নীতিবাজ-শাসক, আমলাদের দুর্নীতি ও ঘুষগ্রহণ অবাধ;
▪️অসাধুদের প্রভাব ও অপতৎপরতা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া;
▪️নানা ধরনের-রকমের হয়রানী, দমন-পীড়ন, প্রতিবন্ধকতা, ভয়-ভীতি ইত্যাদি জনমনে প্রবল আকারে রেখাপাত;
উল্লেখ্য যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যখন খসড়া হিসেবে মন্ত্রীসভা অনুমোদন করার কারণে তৎকালিন সময়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিলো। তৎকালে অনেকের আশঙ্কা ও সমালোচনার অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো-
আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক-
‘৩২ ধারার মাধ্যমে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, অনুসন্ধানী রিপোর্টটা বন্ধ হয়ে যাবে। অনুসন্ধানী রিপোর্টটি গণতন্ত্রের জন্যে সরকারের জবাবদিহিতার জন্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। এটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মানে সংবাদ মাধ্যমে তার প্রধান কাজটা করা থেকে বিরত থাকবে এবং যাদের বা যেসব প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে, তারা জবাবদিহিতার উর্ধ্বে উঠে যাবে। দেশ, সমাজ, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন কোনটার জন্যেই এধরনের বিধান বাঞ্চনীয় নয়।’
‘রাষ্ট্রের গোপনীয় তথ্য সিল ছাপ্পর দিয়ে গোপনীয় রাখা হয়। সংবাদ মাধ্যমের লোকজন রাষ্ট্রের কোনো গোপনীয় তথ্য অনুসন্ধানী রিপোর্টে প্রকাশ করেনা। যেগুলো রাষ্ট্রের গোপনীয় সেগুলো প্রকাশে যদি বাঁধা দেওয়া হয় এবং অনুসন্ধানী রিপোর্ট বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মিডিয়া রেখে লাভ কী? খসড়ায় এটা তো পার্থক্য করেনি যে, কোনটি গোপনীয় বা গোপনীয় নয়।’
টিআইবি’র ইফতেখারুজ্জামান-
‘এ আইনের ফলে তথ্য প্রকাশের অধিকার খর্ব হবার পাশাপাশি দুর্নীতির বিস্তার ঘটবে।’ ‘এই আইনের ফলে দুর্নীতির যেমন বিস্তার ঘটবে পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘন, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ সংক্রান্ত যে সমস্ত তথ্যাবলী মানুষের জানার কথা বা জানার অধিকার রয়েছে; এমন কি প্রকাশের অধিকার রয়েছে সাংবাদিকসহ অন্যান্য গণমাধ্যম কর্মীদের তা খর্ব হবে।’
মানবাধিকার কর্মী নূর খান-
‘নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আগের ৫৭ ধারাকে ও ছাড়িয়ে গেছে। ওই আইন বাতিল করে এবার যা করা হচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হবে, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বাঁধাগ্রস্থ হবে এবং সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহ আরও কঠিন হয়ে পড়বে।’
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া-
‘৫৭ ধারা যেভাবে ছিল, নতুন আইনটিতে সেটিই প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া বিধি-বিধান আগে যেভাবে ছিল তার চেয়ে বরং কঠিন কঠিন বিধি বিধান যুক্ত হয়েছে। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে শাস্তির পরিমাণ কমেছে; কিন্তু বাস্তবিক অর্থে বেড়েছে।’ ‘আমরা যা প্রস্তুাব করেছি তারা রাখা হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। এ পর্যন্ত যা জানা গেছে তাতে নতুন ডিজিটাল আইনে বিতর্কিত তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নতুন আইনের ১৮ এবং ১৯ ধারায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ৩২ ধারায় যে বিধান রাখা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এবং স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হবে।’
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান-
‘এ আইনটি আগের আইসিটি এ্যাক্ট এর চেয়েও নিবর্তনমূলক করা হয়েছে। এ আইনে বিশেষ করে সাংবাদিক, লেখক ও মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা নিগৃহীত হবার আশঙ্কা আরো বেড়ে গেছে। সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট বন্ধ করতেই এ আইন।’
বিশিষ্ট সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার-
‘এর ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে যা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তন করে ৫৭ ধারার বিকল্প হিসেবে চারটি ধারা আনা হয়েছে। সেগুলো কিন্তু স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কিছুটা অন্তরায়।’ ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যেভাবে সাংবাদিকরা কাজ করে সে পথটিতেই কিন্তু অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়েছে। এটাকে গুপ্তচরবৃত্তি বলে সেই অপরাধে অপরাধী করা হচ্ছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এটুকুই করতেই হয়। এটা সারা দুনিয়াতেই আছে।’
সিপিজে-
‘প্রস্তাবিত আইনে যে ভাষা ব্যবহার করা হেেছ তারা নির্দোষ সমালোচনাও সাইবার ক্রাইম হিসেবে ধরে নেওয়ার সুযোগ তৈরী করেছে।’
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম-
‘কালো আইনের বদলে কুচকুচে কালো আইন জাতিকে উপহার দিচ্ছে। এ আইন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার সব গণআন্দোলনের ইতিহাস এবং স্বৈরাচারী আন্দোলনের শহীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার পদক্ষেপ নিয়েছে।’
রাজনীতিবিদ খন্দকার মোশারফ হোসেন-
‘বাকশালী কায়দায় অতীতে যেভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছিল, আজও এ আইনের মাধ্যমে তা করা হচ্ছে। কারণ সরকার অলিখিতভাবে বাকশালের পথেই হাঁটছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়ায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় চেয়েও ভয়ঙ্কর।’
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ-
‘গণমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন, তাতে তাদের মান ইজ্জত থাকেনা। তাদের সম্মান ক্ষুন্ন হয়। তারা তো জনপ্রতিনিধি। তাই এগুলো ঠেকাতেই এ আইন করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ চিন্তা ভাবনা করেই করা হয়েছে। আগের আইসিটি এ্যাক্টটি বিএনপির সময়ে করা ছিল। যেখানে অনেক বিষয় অস্পষ্ট ছিল। নতুন আইনে বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট করা হয়েছে। গণমাধ্যমে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট বন্ধ করতে এ আইন করা হলেও আমার বিশ্বাস আপনাদের ঠেকানো যাবে না।’
রাজনীতিবিদ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল-
‘শুধু বোতল পাল্টানো হয়েছে। মানে নতুন বোতলে পুরোনো মদ।’
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার-
‘অতীতে আমরা নানা ধরনের কালা কানুন দেখেছি। কিন্তু এই আইনটি শুধু কালা কানুন না। এই আইন কার্যকর করলে মধ্যযুগের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো পার্থক্য থাকবে না। সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে গণমাধ্যমেরও টুটি চেপে ধারা হচ্ছে। কোনো সভ্য সমাজে এই আইন সম্ভব না। কোনো অপরাধীর অপরাধ নিয়ে লেখা যাবেনা। এই খারাপ আইনের ব্যবহার ভালো হবে কিভাবে?’
সাংবাদিক শ্যামল দত্ত-
‘এটা ভিন্ন নামে একই জিনিস’
উল্লিখিত বিশিষ্টজনের আশঙ্কার কথাগুলে পরবর্তীতে বাস্তবেই মিলেছে। অর্থাৎ অগনিত মানুষ নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হন। এবং হচ্ছেন। উল্লেখ্য যে- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, ২০০৬ কার্যকর হওয়ার পর দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে। বিশেষ করে বিতর্কিত ৫৭ ধারা-সহ অপরাপর কয়েকটি ধারার অপরাধ বিলপ্ত করা হলেও; এ ধারার অপরাধগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২৫, ২৮, ২৯, ৩১ ধারায় ভাগ করে বিন্যাস্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ৫৭ ধারার অপরাধ ০৪টি ধারায় কৌশলে ভাগ করে বন্টিত হয়েছে।
আইসিটি আইন, ২০০৬ এর ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে-  কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক্স বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে আইন শৃঙ্খলার অবনতি হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসাকানি প্রদান করা হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে।
এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদন্ড দেওয়ার বিধান আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর  ২৫, ২৮, ২৯ এবং ৩১ ধারায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৫৭ ধারার অপরাধগুলো ভাগ করে রাখা হয়। এসব ধারায় মানহানি, মিথ্যা ও অশ্লীল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং শত্র“তা সৃষ্টি ও আইন শৃঙ্খলার অবনতি সংক্রান্ত অপরাধগুলো রয়েছে। এতে অপরাধের ধরণ অনুযায়ী শাস্তির মাত্রাগত কিছুটা তারতম্য হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ কার্যকর হওয়ার পর এ আইন ‘কালোর চেয়েও কুচকুচে কালো’ আইন হিসেবে গণধিকৃত হয়েছে। এ আইন প্রয়োগের ফলে জনসাধারণের বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। মত প্রকাশের ক্ষেত্রে হয়রানির প্রবল আশঙ্কায় স্বাধীন সাংবাদিকতা বাঁধাগ্রস্থ হয়েছিলো। মুক্তচিন্তার অন্তরায় এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মোক্ষম এক হাতিয়ার হিসেবে দেখা দিয়েছিলো। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও গবেষণা কার্যক্রমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিলো।
সাংবাদিক ও মুক্তচিন্তার মানুষের হাত-পা বাঁধার জন্যে এ রকম একটি আইনই যথেষ্ট। এ আইন পাশ করে জনস্বার্থ বিরোধী হবে জেনেও সরকার তাঁর স্বার্থে পাশ করে প্রয়োগের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষকে নিপীড়ন-নির্যাতন করেছে। এবং অদ্যাবধি তা-চলমাল। ফলে রাষ্ট্র ও জাতীকে গভীর সঙ্কটের মুখে দাঁড় করিয়েছে। আইনের অপপ্রয়োগ করে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, অন্যায়কারী, হীন বা কায়েমী স্বার্থে সুযোগ ও সুবিধা নিয়েছে।
মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের দুর্নীতির খবর ছাপানোর মতো সাহস কোনো সাংবাদিক বা সংবাদপত্র সাহস তেমন একটা দেখাতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সমালোচনা করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যায়। দেখা যায় সামাজিক মাধ্যমে লিখে অনেকেই গ্রেফতার, কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিয়েছেন। নিপীড়ন-নির্যাতন ভোগ করছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে- গণবিরোধী এ আইনের মাধ্যমে। নাগরিকদের বাক স্বাধীনতায় বাঁধা দেওয়া মানে গণতন্ত্র চর্চায় আঘাত করা; যা-কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কালো আইন কোনভাবেই মানুষের মঙ্গল করতে পারেনা; বরং যারা এ আইন পাশ করে তারা প্রকৃতপক্ষে গণবিমুখ ও গণধিকৃত হিসেবে ইতিহাসে স্থান পায়। সাময়িক সুবিধার জন্যে এই আইন করা হলেও চূড়ান্ত বিবেচনায় তা-আত্মঘাতি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ দেশ-বিদেশে বেশ সমালোচনার সম্মূখীন হয়। ফলে সরকার এ আইন বাতিলের উদ্যোগ নিয়ে বাতিলক্রমে নতুন আইন প্রণয়ন করে। যার নাম- সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩। এ আইন খসড়া প্রণয়নের সময়ও ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠ। এতৎসত্বেও সরকার কর্নপাত না-করে অনেকটা ‘নতুন বোতলে পুরানো মদ’ হিশেবে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ চূড়ান্তভাবে পাশ করে। এ আইন অদ্যাবধি চলমান। সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়-
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-তে নেতিবাচক যা-ছিলো মোটাদাগে এর সব বিদ্যমান, নতুনভাবে প্রণীত সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এ। এর মধ্যে লক্ষ্য যায় কতিপয় ধারার কারাদণ্ড  ও অর্থদণ্ড  হ্রাস করার পাশাপাশি অপরাধ জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এ আইনে অপরাধ বা মূল বিষয়ের প্রাধান্য না- দিয়ে মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। তুচ্ছ পরিবর্তন করে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতার আলগা প্রলেপ দেওয়া হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর  ২১ ধারায় উল্লেখ আছে, কেউ ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রোপাগান্ডা চালালে ১০ বছরের জেল বা ০১ কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ কেউ দ্বিতীয়বার করলে তার সাজা দ্বিগুণ হবে।একই অপরাধের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ০৩ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারায় পরিবর্তনক্রমে দণ্ডের মেয়াদ ১০ বছরের বদলে ০৭ বছর করা হয়। অর্থদণ্ড ও অ-জামিনযোগ্য বিষয়টি বহাল রাখা হয়।দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলেও দণ্ডের বিষয়টি বাতিল করা হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ৩০ ধারায় উল্লেখ আছে, যদি কেউ কোনো ব্যাংক, বিমা বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে অনুমতি ছাড়া ই-ট্রানজেকশন করেন, তাহলে অনধিক ৫ বছরের জেল বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে ৭ বছরের জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান আছে। এক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা আইনে ৩০ ধারায় পরিবর্তন এনে কারাদণ্ডের বিধান বাতিল করা হয়। অর্থদণ্ড ০৫ গুণ বাড়িয়ে ২৫ লক্ষ টাকা করা হয়। দ্বিতীয়বার অপরাধে দণ্ডের  বিষয়টি বাতিল করা হয়।
মূলত অপরাধ জামিনযোগ্য করার বিষয়টিকে শুভংকরের ফাঁকি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদের কারণে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ বাতিল করে নবরূরে বা অন্য মোড়কে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ নামে প্রণয়ন করে। যে-সব কার্য কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ বাতিল করা হয়, সে-সব বিষয় বিদ্যমান রেখে কেবলমাত্র  দণ্ড বা শাস্তির ধারাসমূহের আংশিক বদলক্রমে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ সরকার পাশ করে। এ কারণেই বলতে হয়- ‘নতুন বোতলে পুরানো মদ’
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং সর্বশেষ প্রণীত সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, এ আইনগুলো শাসন, শোষণ, দমন, নিপীড়ন-নির্যাতন  ইত্যাদি করার উদ্দেশ্যই প্রণীত। অর্থাৎ গণমানুষের স্বার্থে উপেক্ষা করে এগুলো প্রণীত হয়েছে। গণবিরোধী এ আইন সংশ্লিষ্টজন গনমাধ্যমসহ আইনবিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ-আলোচনাক্রমে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যমান সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ বাতিল বা সংশোধন করে গণমুখী আইন পাস করতে হবে।
লেখক: আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক